পদ্মা মহাসেতু: জাতীয় প্রত্যয়, শৌর্য এবং অগ্রযাত্রার সোপান

1072

Published on জুন 29, 2022
  • Details Image

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী:  

প্রমত্তা পদ্মাকে নিয়ে এই অঞ্চলের মানুষ শত শত বছর ধরে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে আসছে । পদ্মাকে কেন্দ্র করে অসংখ্য সুখ জাগানিয়া গান যেমন আছে, খরস্রোতা পদ্মার ভাঙ্গন ও দুর্ঘটনার বিষাদ স্মৃতিও রয়েছে। পদ্মার একূল ভাঙ্গে ওকূল গড়ে, আবার এই পদ্মায় ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ভাসে , যার স্বাদ নিতে মানুষ মুখিয়ে থাকে। পদ্মা বাংলা ও বাঙ্গালির জীবনের সুখ দুঃখের ইতিহাস হয়ে আছে। আবার এই পদ্মাই এপাড় ওপাড়ে মানুষের জীবনকে বিভাজিত করে রেখেছিলো। সেকারণেই শুধু পদ্মাপাড়ের মানুষই নয় , দুই অঞ্চলের মানুষজনও দেখা, সাক্ষাৎ ও যাতায়াত করতে পারছিলো না সহজে কিংবা ইচ্ছেমতো।

একসময় নৌকা, পরবর্তীকালে স্টিমার আর ফেরি ছাড়া, দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের সঙ্গে দক্ষিণ- পূর্বাঞ্চলের তথা গোটা দেশের মানুষের যোগাযোগ ও যাতায়াত ছিলো খুবই কষ্টের এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সেকারণেই পদ্মাকে কেন্দ্র করে মানুষের স্বপ্ন দেখা নানা জটিল বাস্তবতায় মিলিয়ে যেতে থাকে। কবে ঘুচবে পদ্মার এপাড় ওপাড়ের মানুষের দূরত্ব, কবে যাতায়াত হবে সহজ- সেই স্বপ্ন দেখতে দেখতেই এত বছর কেটে গেলো। কেউ কল্পনা করতে পারেনি প্রমত্তা পদ্মার উত্তাল স্রোত আর প্রস্থের বিশালতাকে জয় করা যাবে।

স্বাধীনতার পর থেকে কেউ কেউ স্বপ্ন দেখেছেন এই পদ্মার ওপর দিয়ে একদিন সত্যি সত্যি ব্রিজ উঠবে, গাড়ি চলবে, মানুষ সহজে যাতায়াত করবে। কিন্তু এটি দীর্ঘদিন স্বপ্নেই থেকে গিয়েছিলো। কারণ প্রমত্তা পদ্মার ওপর সেতু করার চ্যালেঞ্জ নেওয়া মোটেও সহজ ব্যাপার ছিলো না। তারপরও দক্ষিণ বাংলার মানুষ বার বার দাবি জানিয়ে আসছিলো পদ্মার ওপর একটি সেতু নির্মাণের । বিশেষত বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুত যমুনা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার পর পদ্মা সেতুর চিন্তা ধীরে ধীরে স্থান করে নিতে থাকে। তবে যমুনার ওপর সেতু নির্মাণ করতেই আমাদের ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সময় কেটে গিয়েছিলো। তখনই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া ঘাটে তিনি পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। এরপর পদ্মা নদীতে প্রবাহিত হয়েছে অনেক স্রোত। কিন্তু পদ্মার ওপর সেতু করার উদ্যোগ ২০০৮ সাল পর্যন্ত তেমন এগোয়নি ।

২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় গেলে তিনি পদ্মা সেতু নির্মাণ করবেন। পদ্মা সেতু নিয়ে সত্যিকার অর্থে অগ্রসর হওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়। এটি কোনো সাধারণ সেতু হবার নয় এমনকি বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু প্রযুক্তি, কারিগরি জ্ঞান এবং সেতু সম্পর্কীয়, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, বিশেষজ্ঞ জ্ঞান, আর্থিক সক্ষমতা ইত্যাদি জটিলতা পদ্মার বিশালতার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কত বড় চ্যালেঞ্জ সেটি কেবলমাত্র বিশেষজ্ঞগণই উপলব্ধি করতে পারছিলেন। তবে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সরকারের দৃঢ়তা কতখানি জরুরি সেটিও উপলব্ধির বিষয় । ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয় সকল উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করে।

ওই বছরের ১৮ই মে জাইকা ৪০ কোটি ডলার , ২৪ মে আইডিবি ১৪ কোটি ডলার এবং ৬ জুন এডিবি ৬২ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি করে। তখন থেকে গোটা জাতি পদ্মা সেতুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের চিন্তা শুরু করে । কিন্তু এই চিন্তার মধ্যেই গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হলো কাল্পনিক দুর্নীতির। এর পেছন ছিলো দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র। দেশের গণমাধ্যমে তখন দুর্নীতির নানা কল্পকাহিনী নিয়ে লেখালেখি, আলোচনা, সমালোচনা ডালপালা বিস্তার করছিলো। অথচ কেউ তলিয়ে দেখেনি প্রচারিত কল্পিত দুর্নীতি গুজব নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ছড়ানো হচ্ছিলো । দুর্নীতির বিষয়টি এতটাই প্রাধান্য পাচ্ছিলো যে, পদ্মা সেতু তখন গৌণ হয়ে গেলো। এর ফাকেই বিশ্বব্যাংক কৌশলে ঋণ প্রদান স্থগিত করে দিলো। উস্কে দেওয়া হল দুর্নীতির প্রচার প্রচারণাকে। রাজনীতি, গণমাধ্যম, সমাজ সবকিছুতেই তখন পদ্মা সেতুর দুর্নীতি প্রাধান্য পেয়েছিলো ! সরকার থেকে যতই এইসব কাল্পনিক দুর্নীতির কথা প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছিলো, গণমাধ্যম ও রাজনীতির কোথাও থেকে তা মানা হয়নি। চারদিকের প্রচার প্রচারণায় অনেকেই ঢোল বাজাতে বাজাতে মাতম করছিলেন। এরপর ২০১২ সালের ২৯ জুলাই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু ঋণদান চুক্তি বাতিল করে দেয়।

বিশ্বব্যাংকের পর অন্যরাও পিছিয়ে যায়। এনিয়ে কানাডার আদালতে দুর্নীতি প্রমাণের মামলাও হয়। মামলায় দুর্নীতির প্রমাণ না পাওয়ার পরও অনেকে তা বিশ্বাস করতে চায়নি। সবাই ধরে নিয়েছিলো পদ্মা সেতু আর হচ্ছে না, অনেকেই খুশি হলো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলেন পদ্মা সেতু হবেই। তার এই দৃঢ় প্রত্যয় আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। কিন্তু আমাদের দেশে অনেকেই তা অসম্ভব ব্যাপার কিংবা দেশের অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করছিলেন। এরা আসলে বাংলাদেশের সক্ষমতাকে মোটেও উপলব্ধি করতে পারছিলেন না। বাংলাদেশ এই সময়ে অর্থনৈতিকভাবে যেমন ঘুরে দাঁড়াতে থাকে, একইভাবে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে ’৭১ এর মতো প্রতিকূলতাকে জয় করতে দৃঢ় নেতৃত্বের পদক্ষেপও দেখতে পারছিলো।

শেখ হাসিনা সেই দৃঢ়তা ও সতর্ক পদক্ষেপ গুনে গুনে গ্রহণ করতে থাকেন। পদ্মা সেতুর নির্মাণ আয়োজনে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ, কারিগরি , প্রকৌশলী, প্রমত্তা পদ্মার বিশেষজ্ঞ জ্ঞানকে একাত্ম করা হয়। পদ্মার ভবিষ্যৎ সেতু রূপ নিতে থাকে এক মহাসেতুতে । বিশ্বের ১১তম বৃহত্তম এবং অন্যতম প্রধান প্রমত্তা খরস্রোতা নদীর ওপর এই মহাসেতুটি অসম্ভব এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করায় শেখ হাসিনার সরকারকে। কিন্তু তিনি সেই চ্যালেঞ্জ অত্যন্ত ভিশনারি মিশনারি নেতৃত্বের অবস্থান থেকে গ্রহণ করেন। ২০১৪ সালের ১৭ জুন চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সই করা হয় এবং ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। সেই থেকে পদ্মা তীরে নির্মিত হতে থাকে নতুন এক সেতু যাকে মহাসেতু নামে আখ্যায়িত করাই শ্রেয় । এই সেতুর নির্মাণ শৈলী , প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আমাদের বিশেষজ্ঞগণ সঞ্চয় করেছেন বিশ্বের বড় বড় মহাসেতু থেকে। পদ্মার পলিবাহিত স্রোত আমাজন নদীর মতই ভয়াবহ । তবে আমাজনের ওপর এখনো কোনো সেতু বা মহাসেতু হয়নি। সেকারণে একই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী খরস্রোতা পদ্মার ওপর মহাসেতু তৈরি এক দুঃসাধ্য বিষয়। সেই দুঃসাধ্যকে বিশেষজ্ঞগণ আয়ত্তে আনতে এর প্রতিটি পিলারকে ১০ হাজার টন রড ও সমপরিমাণ সিমেন্ট ও বালি দ্বারা স্থাপন করেছেন যা ৩৮৩ ফুট মাটির গভীরে গিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে।

এই ব্রিজের ভিত্তি প্রস্তর এতটাই মজবুত করা হয়েছে যা রিক্টার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও ধ্বসে পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তেমন শক্তপোক্ত মজবুত ৪২টি বিশালাকার পিলারের ওপর ৪১ টি স্প্যান বসানো হয়েছে। দৈর্ঘ্যে ৬.১৫ কি.মি. ও প্রস্থে ১৮.১০ মি. এর এই মহাসেতুটি বাস্তবে সকলের চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো। এ যেন এক স্বপ্নের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার বাস্তবতা। বাংলাদেশ ও চীনের ৭০০ প্রকৌশলী রাতদিন এর নির্মাণকাজে ২০১৫ এর ডিসেম্বর থেকে যুক্ত ছিলেন। দুই তীরে দিনে ১২- ১৩ হাজার শ্রমিক ও সহযোগী নির্মাণযজ্ঞে কর্মরত ছিলেন। এই মহাসেতুর সঙ্গে জাইকার সহযোগিতায় রেল সেতুর নির্মাণের কাজও অব্যহত আছে।

যার হাত ধরে এই সেতুর নির্মাণ শুরু হয়েছিলো সেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বসাধারণের যান চলাচলের জন্য ২৫ জুন তারিখ সেটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন ঘোষণা করতে যাচ্ছেন। পদ্মার এপাড় ওপাড় ২৫ জুন থেকে দুই তীরের মানুষের জন্য এক নতুন সোপানের সৃষ্টি হতে যাচ্ছে।

মহাসেতু পদ্মার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ দেশি এবং বিদেশি সকল ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকসহ অনেকেই এখন বাংলাদেশের এই আত্মপ্রত্যয় দেখে বিস্মিত হচ্ছে। কিন্তু ১৯৭১ সালে আমরা এর চাইতেও বড় আত্মপ্রত্যয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি, মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। এ ধরনের বিজয়ের জন্য চাই যথার্থ নেতৃত্ব। ১৯৭১ এ ছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং তার নিকটতম সহযোগীরা, এবার নেতৃত্ব দিয়েছেন তার জ্যেষ্ঠকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার দৃঢ়তা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৯ থেকে ক্রমবর্ধমানভাবে অব্যহত থাকার কারণেই দুই বছর অতিমারি করোনার সংক্রমণকালেও মহাসেতু পদ্মার কাজ থেমে থাকেনি, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাও থেমে থাকেনি।

মহাসেতু পদ্মার উদ্বোধন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার নতুন প্রভাতেরই শুভ উদ্বোধন করছে। দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের ২১ টি জেলার সঙ্গে বাকি সব জেলার মানুষের সংযোগ ও যোগাযোগ স্বাভাবিকভাবে গতিময়তা পেতে যাচ্ছে। দুই অঞ্চলের মধ্যে হাজারো বছরের বিচ্ছিন্নতা ঘুচিয়ে দিয়েছে। দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতি নতুনভাবে মাথা তুলে দাঁড়াবে। আবার রাজধানীসহ সারাদেশের শিল্প, কৃষি, ব্যবসা বাণিজ্য একসঙ্গে নতুনভাবে প্রাণ ফিরে পাবে।

শুধু তাই নয়, মহাসেতু পদ্মা প্রতিবেশী ভারত, নেপাল, ভুটানের সঙ্গেও বাংলাদেশের যোগাযোগ , অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে নতুন দিগন্ত রচনা করতে যাচ্ছে। ফলে এই মহাসেতু হয়ে উঠবে শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, এমনকি বিশ্বের জন্যও একটি নতুন অর্জন। পৃথিবীর মানুষ বাংলাদেশকে ১৯৭১ সালে একবার চিনেছে, এবার মহাসেতু পদ্মার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয়বার জানতে সুযোগ পেয়েছে। মহাসেতু পদ্মা তাই আমাদের কাছে আরেক প্রত্যয় , শৌর্য-বীর্য এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রার নতুন এক সোপান হয়ে উঠেছে।

সৌজন্যেঃ  ঢাকানিউজ২৪.কম 

 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত