1377
Published on জুন 27, 2022পটুয়াখালীর বাউফলের স্কুল শিক্ষক মাসুমা আক্তার ২০১০ সালের এক দুপুরে যখন সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হলেন, রক্তাক্ত অবস্থায় প্রথমে তাকে নেওয়া হল উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সেখান থেকে পটুয়াখালী সদর হাসপাতাল, এরপর বরিশাল মেডিকেল, তারপর অ্যাম্বুলেন্সে করে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে পরদিন ভোরবেলা।
সে যাত্রা বেঁচে গিয়েছিলেন মাসুমা। তবে সে সময় আতঙ্ক নিয়ে দুটো দিন কাটানো তার সন্তানরা এখন ভাবেন, সেদিন যদি পদ্মা নদীতে একটি সেতু থাকত!
দক্ষিণ জনপদের সাড়ে তিন কোটি মানুষের সেই স্বপ্নের সেতু এখন বাস্তব। এই সেতুর কারণেই বাগেরহাটের চিতলমারীর কৃষক অসীম বাড়ৈ আজ ভাবতে পারছেন, তার কষ্টের ফসলের লাভের ভাগ আর ফড়িয়াকে দেবেন না। ভোরে রওনা দিয়ে ঢাকায় পাইকারের কাছে তাজা সবজি বিক্রি করে বিকালের মধ্যে বাড়ি ফিরে হয়ত ভাত খেতে পারবেন।
প্রমত্তা পদ্মার দুই তীরকে সড়কপথে সরাসরি যুক্ত করা ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতু কেবল ২১ জেলার মানুষের জীবন বদলে দেবে- তা নয়, ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণশক্তি যোগাবে বলে অর্থনীতিবিদদের বিশ্বাস।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেছেন, “শুধু এক পদ্মা সেতুই দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে, যার হাত ধরে মাত্র একটি প্রকল্পই দেশের জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) বাড়িয়ে দেবে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ।”
সেই পরিবর্তনের হাওয়া কি শুধু বাংলাদেশে বইবে? পদ্মা সেতুর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান, প্রয়াত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর প্রত্যাশা ছিল, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে পদ্মা সেতু।
সেই প্রত্যাশায় পদ্মাপাড়ের মাওয়া আর জাজিরায় এখন সাজ সাজ রব। শনিবার এ সেতুর উদ্বোধন ঘোষণা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সেজন্য সারা দেশে চলছে উৎসবের প্রস্তুতি।
বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে দীর্ঘ টানাপড়েন আর তিক্ততার পর ঠিক দশ বছর আগে শেখ হাসিনাই সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন- ঋণ নয়, পদ্মা সেতু নির্মণ করা হবে বাংলাদেশের মানুষের টাকায়। ঠিক ২ হাজার ৩৮৭ দিন আগে তিনিই পদ্মাপাড়ে বিপুল নির্মাণযজ্ঞের উদ্বোধন ঘোষণা করেছিলেন।
বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার যে স্বপ্ন শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানুষকে দেখিয়ে আসছেন, সেখানে পৌঁছাতে হলে মাথপিছু আয় হতে হবে বছরে ১২ হাজার ৫৬ ডলারের বেশি, যা এখন ২ হাজার ৮২৪ ডলার।
পাশাপাশি আগামী দিনগুলোতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে হবে দুই অংকের ঘরে, যা দুই বছর আগে ছিল ৮ শতাংশের বেশি, মাঝে মহামারীর কারণে কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও আবার পুরনো গতিতে ফেরার পথে রয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে এই পদ্মা সেতুর বড় ভূমিকা থাকবে বলেই সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বিশ্বাস।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দুদিন আগে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এ সেতু কেবল জিডিপি বাড়াবে না, প্রতি বছর দশমিক ৮৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্যও কমাবে।
“আমাদের লক্ষ্য ২০৩০-৩১ সালের মধ্যে এসডিজি পূরণসহ উচ্চ-মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়া। জনগণের সহযোগিতায় আমরা অতীতের প্রতিশ্রুতিগুলোর মত এসব প্রতিশ্রুতিও পূরণ করব।”
পরিবর্তনের ভূগোল
বাংলাদেশে সাতশর বেশি নদনদী থাকলেও পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও মেঘনা অববাহিকা দিয়ে এ দেশ চার ভাগে বিভক্ত। ওই তিন অববাহিকার সীমা ধরেই বাংলাদেশ মানুষ উত্তর, পূর্ব, উত্তরপশ্চিম ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল চেনে।
মেঘনা সেতু, মেঘনা-গোমতি সেতু, মেঘনার ওপর ভৈরব সেতু, যমুনার ওপরে বঙ্গবন্ধু সেতু এবং কুষ্টিয়ার ওপরে লালন শাহ সেতু (হার্ডিংঞ্জ ব্রিজ) রাজধানীর সঙ্গে দেশের উত্তর, পূর্ব ও উত্তরপশ্চিম অঞ্চলের মানুষের চলাচল ও পণ্য পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
কিন্তু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে এতদিন বিভক্ত করে রেখেছে পদ্মা নদী। ফলে ফেরি বা লঞ্চে নদী পার হয়ে এ অঞ্চলের মানুষকে ঢাকায় যাতায়াত করতে ব্যয় করতে হয় দীর্ঘ সময়। গরমের সময় দূরের পথের পণ্য ট্রাকেই পচে যায় অনেক সময়।
সেই দুর্দশার অবসান ঘটাতে উদ্বোধনের পরদিন থেকেই গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে পদ্মা সেতু। এ দিনটির জন্য দক্ষিণ জনপদের মানুষের অপেক্ষা বহু দিনের।
পদ্মা সেতুর কারণে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ১৬ জেলা এবং ঢাকা বিভাগের ৬ জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসবে আমূল পরিবর্তন। পণ্য পরিবহনে সময় কমে আসবে বলে কৃষি উৎপাদন ও বিপণনে আসবে নতুন জোয়ার। সেতু দিয়ে ট্রেন যাবে, যাবে গ্যাস। তাতে শিল্প-কারখানার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির যোগান হবে।
খুলনা থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটারের বেশি যে মহাসড়কটি রয়েছে, তার দুই পাশের অধিকাংশ জমি বিক্রি হয়ে গেছে। শিল্প কারখানা স্থাপন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়- এমন নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কাজে লাগানো হবে এসব জমি।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দরনগরী খুলনার এ মহাসড়কটিই শুধু নয়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলাতেই জমির দাম বাড়ছে হু হু করে, পর্যটনকেন্দ্রগুলো সাজছে নতুন করে, নতুন নতুন কারখানা গড়ে উঠছে। সড়ক ব্যবস্থা যেমন বদলাচ্ছে, তেমনি কর্মসংস্থান বৃদ্ধির নানা উদ্যোগ সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
শিল্পে পিছিয়ে থাকা দক্ষিণবঙ্গে নতুন কারখানা খোলার মানে হল, তার প্রভাবে ব্যস্ততা বাড়বে পায়রা বন্দর, মোংলা বন্দর আর বেনাপোল স্থলবন্দরে।
পাশাপাশি রাজধানী এবং বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। যাতায়াত সহজ হলে পর্যটনে আসবে নতুন প্রাণ। কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিই বদলে যাবে।
উৎপাদনে বিপ্লব
বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের ২১ শতাংশের যোগান আসে দক্ষিণ-পশ্চিমের এই ২১ জেলা থেকে। আর তাতে মূল ভূমিকা কৃষির।
২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট উৎপাদিত পাটের ৬০ শতাংশ, গমের ২৮ শতাংশ, ধানের ২৩ শতাংশ এ অঞ্চলেই উৎপাদিত হয়েছে। পেঁয়াজ, সবজি ও ফল উৎপাদনেও এ অঞ্চলের অবদান গুরুত্বপূর্ণ।
২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৩৮ লাখ মেট্রিক টনের বেশি মাছ উৎপাদন হয়েছে, যার ৩২ শতাংশের যোগান দিয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। আর সারাদেশে চিংড়ির যোগানের প্রায় ৯০ শতাংশ শুধু খুলনা বিভাগ থেকেই আসে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ২০২০ সালের একটি প্রতিবেদন বলছে, পদ্মা সেতু চালু হলে এসব জেলার জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। আর তাতেই পুরো দেশের জিপিডি ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়বে।
শুধু একটি সেতু যে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ২১ দশমিক ১৫ শতাংশের জীবন-মান আমূল পাল্টে দিতে চলেছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের।
পদ্মা সেতু নিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে জাপানের বিদেশি অর্থায়নকারী সংস্থা জাইকা বলেছিল, “বহুল আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করবে এবং অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা দেশের ওই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করবে।”
বদলের জীবনচিত্র
প্রায় এক যুগ ধরে ঢাকায় গাড়ি চালক হিসেবে কাজ করছেন শরীয়তপুরের মোহাম্মদ শাকিল। রাজধানীর শ্যামলী এলাকায় টিনশেড ভাড়া বাসায় এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সংসার। যা বেতন পান তার তিন ভাগের একভাগই চলে যায় বাসা ভাড়া দিতে।
শাকিল এবার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন, স্ত্রী, ছেলে-মেয়েকে গ্রামে রেখে আসবেন। আর সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো গ্রামে গিয়ে কাটাবেন, তাহলেই মাসের খরচ অনেকটা বেঁচে যাবে।
শাকিলের বাড়ি শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের ঢুলিকান্দী গ্রামে। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া থেকে এসে এই জাজিরাতেই নেমেছে পদ্মা সেতু।
তিনি বলেন, “অনেকেই গ্রামে আইতাছে। ব্রিজ চালু হইলে আমরা দুই ঘণ্টায় বাড়ি থিকা ঢাকায় যাইতে পারুম। এই কারণে গ্রামে বাপে যে এক কাঠা জমি দিছে ওইহানে ঘর করা শুরু করছি। দেড় লাখ জমাইছিলাম, গাছ বেইচ্চা কিছু পাইছি, কোরবানির সময় ছাগলের ব্যবসা করুম। সব মিল্যা দুইটা ঘর আর একটা বাথরুম হইলেই হইল। ঢাকার খরচে আর পোষান যায় না। বাটারবনের দামও এহন ১৫ টাকা।”
সেতু হওয়ার আগে থেকেই সম্ভাবনার হাতছানিতে পদ্মার ওপাড়ের জাজিরার গ্রামগুলোর জমির দাম বাড়তে শুরু করে। গত ১০ বছরে জমির দাম অন্তত ১০ গুণ বেড়েছে জানিয়ে শাকিল বলেন, “আশপাশে রোডের ধারে নাকি অনেক বড় বড় কোম্পানি জমি কিনতাছে। আবার যাগো ট্যাকা আছে তাদেরও অনেকে জমি কিন্যা রাখছে। হ্যারাই জমির দামডা বাড়াইল।”
তার ভাষ্য, গ্রামে আগে যে জমির বিঘা ছিল পাঁচ লাখ টাকা, এখন তার কাঠাও দুই লাখের কম না। ঘর করার জমির দাম কম করে হলেও চার লাখ টাকা, ক্ষেতের জমির দামও দুই লাখ টাকা।
পদ্মা সেতুর ১৪ কিলোমিটার নদী শাসন প্রকল্পের মধ্যে পৌনে ১৩ কিলোমিটারেরই সুবিধা পাচ্ছে জাজিরার মানুষ। নদীর ভাঙন প্রবণতার কারণেও এতদিন এ এলাকায় জমির দাম অনেক কম ছিল। ভাঙন না হওয়ার নিশ্চয়তার পাশাপাশি যোগাযোগ সহজ হওয়ার বিষয়টিও জমির দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে বলে জানালেন জাজিরা পৌরসভার মেয়র মো. ইদ্রিস মাদবর।
তিনি বললেন, মানুষ এখন এলাকায় বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় আগ্রহী হচ্ছে। রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুড, বিভিন্ন বাহারী পণ্যের দোকান হচ্ছে।
মাদারীপুরের শিবচর ও শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা মিলিয়ে ১২০ একর জমিতে শেখ হাসিনা তাঁত পল্লী গড়ে তোলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে ওই তাঁত পল্লীতে ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। আরও শিল্প-কারখানা ওই এলাকায় আসছে বলে মানুষ জানাচ্ছেন। সে কারণেও এলাকার জমির দাম কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।
জাজিরা উপজেলা চেয়ারম্যান মোবারক শিকদার ঢাকায় তৈরি পোশাকের ব্যবসা করেন। তিনিও এলাকায় ভবিষ্যত বিনিয়োগের জন্য কিছু জমি কিনেছেন। তিনি বললেন, পদ্মা ‘বিরাট সুযোগ’ সৃষ্টি করছে। সেটা কাজে লাগাতে অনেকেই জমি কিনে রাখছেন।
কোম্পানিগুলোর দখলে চলে গেছে। আবার একেবারে সাগরপ্রান্তে জমি কিনে রেখেছে বড় কোম্পানিগুলো। যার ফলে জমির দাম বেড়েছে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা ও পায়রা বন্দর সংলগ্ন এলাকাগুলোতেও।
বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মো. আমিন উল আহসান বলছেন, পদ্মা সেতু চালুর আগেই প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় পায়রা সেতু চালু হয়েছে। এর ফলে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগে ফেরি লাগছে না। পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগের ক্ষেত্রে শুরু হবে নতুন অধ্যায়। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসার ঘটবে।
সুবিধা হবে আরও অনেক ক্ষেত্রে। শরীয়তপুরের ডামুড্যার মান্নান সরদারকে মূত্রথলির জটিলতার জন্য চিকিৎসা নিতে যেতে হয় বরিশালের শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পদ্মা সেতু যেহেতু চালু হয়ে যাচ্ছে, আগামীতে আর বরিশালে না এসে ঢাকাতেই যাবেন বলে তিনি ঠিক করেছেন। তাতে আসা-যাওয়ার খরচ আর সময় দুটোই কমবে।
বরিশাল চেম্বারের সদস্য ও নগরীর অমৃত লাল দে অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভানু লাল দে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগে ফেরিঘাটে ট্রাক আটকে পড়ে সমস্যা হত। একদিন-দুদিনও ঘাটে আটকে থাকত পণ্যবাহী গাড়ি। তাতে অনেক সময় পণ্য নষ্ট হত, খরচ বাড়ত। এখন সময়মত পণ্য পৌঁছানো যাবে।”
বাগেরহাট সদর উপজেলার ডেমা গ্রামের কবির হোসেন ঘেরে বাগদা, গলদা ও সাদা মাছের চাষ করছেন দেড় দশক ধরে। তার অভিযোগ, হিমায়িত রপ্তানিকারকরা তাদের যে দাম দিতেন, তার চেয়ে বেশি দামে ঢাকার বাজারে মানুষ চিংড়ি কিনে খায়। পদ্মা সেতু চালু হলে তাদের আর রপ্তানিকারকদের হাতে ‘আটকা থাকতে’ হবে না।
পদ্মাসেতু চালুর পর ঢাকা থেকে বাগেরহাটের দূরত্ব হবে ১৭০ কিলোমিটার। এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল কৃষিবান্ধব অর্থনীতি হিসেবে গড়ে উঠবে বলে আশা করছেন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) পরিচালক মো. শহীদ মেহফুজ রচা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখানে বাইরের পাইকাররা এসে প্রতিদিন ৫০/৬০টি ট্রাক বোঝাই করে বিভিন্ন ধরনের সবজি কিনে নিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করেন। এই জেলার কৃষকরা কিন্তু নায্যমূল্য পান না। পদ্মা সেতু চালুর পর এই কৃষক তাদের ক্ষেতের ফসল এখানে বিক্রি না করে সরাসরি ঢাকায় বা দূরের জেলায় বিক্রি করতে পারবেন। তাতে তাদের লাভ বেশি হবে। তাতে উৎপাদনও বাড়বে।”
অর্থনীতির বিশ্লেষণ
এডিবির পূর্বাভাস ঠিক হলে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর আটভাবে বদলে যেতে থাকবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলা।
প্রথমত, সমগ্র দেশের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় পরিবর্তন আসবে।
ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৮০ কিলোমিটারের এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য জেলার সঙ্গে যুক্ত সড়ক ও মহাসড়কগুলোর উন্নয়ন হচ্ছে। উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে যেতে একসময় আটটি ফেরি পার হতে হত। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ ফেরিরও অবসান হতে চলেছে।
খুলনা ও বরিশাল বিভাগ এবং বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে ঢাকার যাতায়াতের সময় এখন দুই থেকে পাঁচ ঘণ্টা কমে যাবে।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর মোংলা, আরেকটি সমুদ্র বন্দর পায়রা এবং সবচেয়ে বড় স্থল বন্দর বেনাপোল থেকে খুব সহজে পণ্য পৌঁছাবে ঢাকায়। আগে খুলনা বা যশোর থেকে ঢাকা যেতে পাটুরিয়া দিয়ে সময় লাগত গড়ে ১৩ ঘণ্টা, মাওয়া দিয়ে প্রায় ৯ ঘণ্টা। সেই সময় এখন ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কমে যাবে।
এডিবির গবেষণা বলছে, ১০ শতাংশ ভ্রমণ খরচ কমলে ভ্রমণ বাড়বে ১০ শতাংশ। আর বাংলাদেশের হিসাবে ১০ শতাংশ ভ্রমণের সময় কমলে সেই এলাকায় উৎপাদন বাড়বে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ।
দ্বিতীয়ত, এই সেতুর মাধ্যমে শুধু যাতায়াতেরই সুবিধা হবে না, টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এবং প্রাকৃতিক গ্যাস পরিবহনের ক্ষেত্রেও এ সেতু প্রধান ভূমিকা পালন করবে। বিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক গ্যাস পরিবহনে খরচ কমবে।
ইতোমধ্যে পটুয়াখালীর পায়রায় প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হাব গড়ে তোলা হচ্ছে। মোংলা বন্দরের পাশেও হচ্ছে একাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
তৃতীয়ত, শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন বাড়বে এবং নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান বাড়বে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায় এখন যে শিল্প কারখানা আছে, তারা উৎপাদন বাড়াতে পারবে। ২১ জেলায় গড়ে উঠবে ছোট-বড় শিল্প।
মোংলা বন্দরের ইপিজেডের সক্ষমতা ইতোমধ্যে বাড়তে শুরু করেছে। বর্তমানে ৫০টির বেশি শিল্প-কলকারখানা আছে সেখানে, যা ৮০ থেকে ৯০-এ উন্নীত হবে বলে আশা করছে বাগেরহাট জেলা প্রশাসন। এ ছাড়া এখানে ১৪টি এলপিজি ফ্যাক্টরি ও কয়েকটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরিও হয়েছে।
চতুর্থত, পর্যটক বৃদ্ধির ফলে বাড়তে থাকবে এ অঞ্চলের জিডিপি। সুন্দরবন ও কুয়াকাটা ছাড়াও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে বেশ কয়েকটি পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। কুষ্টিয়ায় লালন শাহের মাজার ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি, গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর সমাধি, মেহেরপুরের মুজিবনগর, বরিশালে নদী পর্যটনসহ বেশ কয়েকটি গন্তব্যে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার বদৌলতে পর্যটক বাড়ার সম্ভাবনা থাকছে।
পঞ্চমত, কৃষকরা পণ্যের দাম ভালো পেলে জিডিপিতে তার প্রভাব পড়বে। যেমন- দেশের বেশিরভাগ পেঁয়াজই উৎপাদিত হয় বৃহত্তর ফরিদপুর, কুষ্টিয়া ও যশোর জেলায়। এছাড়া এসব জেলায় সবজি ও ফলের আবাদ বাড়ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে কৃষকরা পণ্যের দাম ভালো পাবেন এবং তাতে উৎপাদন বাড়বে। পণ্যের বিপণন ও বাজার সম্প্রসারণে এ সেতু ভূমিকা রাখবে।
ষষ্ঠত, মোংলা বন্দর যথাযথভাবে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধিতে তা ভূমিকা রাখবে। ইতোমধ্যে এ বন্দরের কর্যক্রম বাড়ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬২৩টি দেশি-বিদেশি জাহাজ এ বন্দরে ভিড়েছিল, ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ৯৭০টি। পটুয়ালীর পায়রা বন্দরের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সপ্তমত, এশিয়ান হাইওয়ে চালু হওয়ায় অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের পাশাপাশি বৈদেশিক যোগাযোগও ত্বরান্বিত হবে পদ্মা সেতুর কারণে।
অষ্টমত, জমির দাম বাড়ার ফলে তা উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। এছাড়া পদ্মা সেতু এই জেলাগুলোতে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান বাড়াবে বলে এডিবির ধারণা।
সব মিলিয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়াবে বলে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক হিসাব করেছে।
বাংলাদেশের পঞ্চবার্ষিক ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনার মত দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য বর্তমান প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম।
তার ভাষায়, মূল বিষয়টা এখানে হবে সময়। প্রতিদিন মাথাপিছু যে কর্মঘণ্টা পদ্মা সেতু বাঁচিয়ে দেবে, তাই দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণশক্তি যোগাবে। খুলে দেবে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার।
সৌজন্যেঃ bdnews24.com