5917
Published on জুন 24, 2022অধ্যাপক ড. মো: মিজানুর রহমান:
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল একটি ক্ষুধা-দারিদ্র মুক্ত বৈষম্যহীন সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর জাতির জনক সেই স্বপ্ন পূরনের লক্ষ্যে সমগ্র দেশের যোগাযোগ ব্যবস্হা উন্নয়নের জন্য দেশের বড় বড় নদীর উপর সেতু নির্মানের পরিকল্পনা গ্রহন করেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট জাতির জনকের শাহাদাৎ এর পর বাংলাদেশের ইতিহাসের চাকা উল্টা দিকে ঘূরতে শুরু করে। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সনে জাতির জনকের সুযোগ্যা কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর দেশ আবার বঙ্গবন্ধুর দেখানো উন্নয়নের পথে ফিরে আসে। ১৯৯৮-১৯৯৯ সনে শেখ হাসিনার সরকার এর সময়ে পদ্মা সেতুর প্রি-ফিজিবিলিটি সমীক্ষা শেষ করা হয়। কিন্তু পরর্বতী কালে জামাত-বি এন পি জোট সরকার নানা টালবাহানা করে সময়ক্ষেপন করে ২০০৩-২০০৫ সনে পদ্মা সেতুর ফিজিবিলিটি সমীক্ষা শেষ করে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়ে দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি সরকার গঠনের পর থেকেই পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নের দিকে মনযোগী হন। ২০০৯-২০১১ সনে পদ্মা সেতুর ডিজাইন নকশা চূড়ান্ত করা হয় এবং বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেন।
এর পরের ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নে আশাংকা দেখা দেয়। নানান টালবাহানা ও সময় ক্ষেপন করে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর প্রকল্পে তাদের প্রতিশ্রুত লোন দিতে অস্বীকৃতি জানায়। বিশ্বব্যাংক এর দেখানো পথে এডিবি, জাইকা এবং আইডিবি ও তাদের প্রতিশ্রুত লোন দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সময়ক্ষেপন এর ফলে পদ্মা সেতুর প্রকল্পের ব্যয় ও বেড়ে প্রায় দ্বিগুন হয়ে যায়। এমত অবস্হায় দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ সরকার যখন বিব্রতকর অবস্হার সম্যূক্ষীন ঠিক তখনই দেশরত্ন্ শেখ হাসিনা তাঁর সাহসী, বিচক্ষন, বলিষ্ঠ ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্বগুনের পরিচয় দেন ও ঘোষনা দেন পদ্মা সেতু নির্মান করা হবে ইনশাআল্লাহ এবং তা হবে পুরোপুরি নিজস্ব অর্থায়নে। আবার ও দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা হৈ হৈ করতে শুরু করে এবং নানাভাবে সরকারকে নিরৎসাহিত করতে থাকে পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মান করা থেকে । ষড়যন্ত্রকারীরা প্রপাগান্ডা চালাতে থাকে যে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মান করার চেষ্টা করলে বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর যে চাপ তৈরী হবে তা সামলানোর ক্ষমতা সরকার এর নেই এবং নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মান করার জন্য আন্তর্জাতিক কোন ঠিকাদার পাওয়া যাবে না। কিন্তু জাতির জনক এর মতই নির্ভীক ও দৃঢ়চেতা দেশরত্ন শেখ হাসিনা ষড়যন্ত্রকারীদের প্রপাগান্ডায় বিচলিত না হয়ে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, বাংলাদেশের জনগন ও শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের প্রতি আকুন্ঠ সর্মথন ব্যক্ত করেন। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে। আগামী ২৫ জুন ২০২২ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সক্ষমতার নিদর্শন, আত্মগৌরবের পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন করবেন।
পদ্মা বহুমুখী সেতু শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিই বদলে দেবে। আরো বিশদভাবে বলতে গেলে এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে এই সেতু আসলেই দেশের মানুষের স্বপ্নের সেতু হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া এই সেতুটি ভবিষ্যতে ট্রান্স-এশীয় রেলপথের অংশ হবে। তখন যাত্রীবাহী ট্রেন যত চলবে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি চলবে মালবোঝাই ট্রেন। ডাবল কন্টেইনার নিয়ে ছুটে চলবে ট্রেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হবে মোংলা ও পায়রা বন্দর। অর্থনীতিতে যুক্ত হবে নতুন সোনালি স্বপ্ন এবং দেশের প্রবৃদ্ধিতে এ সেতু ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে।
যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে একটি দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আবর্তিত হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে কৃষিপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল এবং শিল্পজাত পণ্যসামগ্রী সহজে ও স্বল্প ব্যয়ে স্থানান্তর করতে সুবিধা হয়। এর ফলে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, শিল্প ও ব্যবসার প্রসার ঘটে। এ জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পদ্মা সেতু এক্ষেত্রে অর্থনীতির ভিত্তি ও সোনালি সোপান হিসেবে কাজ করবে। পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা ঘুরে যাবে দ্রুত বেগে। বাড়বে জীবনযাত্রার মান ও কর্মসংস্থান। সেতুর এক প্রান্ত ছুঁয়ে থাকবে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া, অন্য প্রান্ত শরীয়তপুরের জাজিরা। পদ্মার বুকে যে স্বপ্নের যাত্রা হয়েছিল তা এখন বাস্তব । এ সেতু নির্মাণের সুফল হিসেবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অন্যতম প্রধান উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হবে। কোটিরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। দেশের অর্থনীতির জন্য বয়ে আনবে সুসংবাদ। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রথম কোনো সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এমনিতেই কৃষিতে উন্নত। এই সেতু হয়ে গেলে তাদের কৃষিপণ্য খুব সহজেই ঢাকায় চলে আসবে। মোংলা ও পায়রা বন্দর এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরে চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পুরো দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে।
আমাদের সক্ষমতার নিদর্শন ও আত্মগৌরবের পদ্মা সেতু
পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত হবে। এতে দক্ষিণাঞ্চলের কুয়াকাটা ও সুন্দরবন সংলগ্ন ছোট ছোট বিভিন্ন দ্বীপে মালদ্বীপের মতো পর্যটন উপযোগী করা যাবে। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন ও পায়রা বন্দরকে ঘিরে দেখা দেবে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন চর ও দ্বীপকে কেন্দ্র করে পর্যটনের বিশাল জগৎ তৈরি করা সম্ভব। পদ্মা সেতু চালুর পরে সেই সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যাবে। পদ্মা সেতুর ফলে কক্সবাজারের চেয়ে কম সময়ে সুন্দরবন ও কুয়াকাটায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। কক্সবাজার যেতে যেখানে সময় লাগে ১০-১২ ঘণ্টা সেখানে কুয়াকাটায় পৌঁছানো যাবে মাত্র ৬ ঘণ্টায়, ফলে নিঃসন্দেহে পর্যটকের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে। পায়রা বন্দরের সঙ্গে বুলেট ট্রেন চালুর কথা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে কুয়াকাটা ও আশপাশে বেশকিছু দ্বীপের সঙ্গে ভালো ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হবে। তাহলে পর্যটকরা আকৃষ্ট হবে। এ জন্য ইতোমধ্যে অনেক দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর ও এর আশপাশে বিনিয়োগ করা শুরু করেছে।
পদ্মা সেতুর ফলে প্রতিবছর দারিদ্র্য নিরসন হবে শূন্য দশমিক ৮৪ ভাগ। এর মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় ৬ কোটি মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন আনবে পদ্মা সেতু। একসময় দেশের উত্তরাঞ্চলে মঙ্গা দেখা দিত। এখন মঙ্গার কথা আর তেমন একটা শোনা যায় না। বঙ্গবন্ধু সেতু উত্তরাঞ্চলের এই মঙ্গা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। ঠিক একইভাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো এখনও শিল্পের দিক দিয়ে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। এ এলাকার বেশ কয়েকটি জেলার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। পদ্মা সেতুর ফলে সবার আগে উপকার হবে এই পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর। কারণ পদ্মা সেতুর কল্যাণে ওইসব এলাকায় ব্যাপক আকারে শিল্পায়ন হবে, Industrial revolution এর ফলে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। মানুষের আয় বাড়বে এবং জীবন জীবিকায় পরিবর্তন আসবে।
এডিবির সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০২২ সালে সেতু দিয়ে প্রতিদিন চলাচল করবে প্রায় ২৪ হাজার যানবাহন। সংখ্যাটি প্রতিবছরই বাড়বে। ২০৫০ সালে প্রায় ৬৭ হাজার যানবাহন প্রতিদিন চলবে পদ্মা সেতু দিয়ে। এর সুফল পাবেন ২১ জেলার মানুষ। এডিবির সমীক্ষায় আরও বলা হয়, পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণের জেলাগুলোতে যেতে বাসের ক্ষেত্রে গড়ে দুই ঘণ্টা ও ট্রাকের ক্ষেত্রে ১০ ঘণ্টা সময় সাশ্রয় করবে। পদ্মা সেতুর ফলে ঢাকা থেকে সবচেয়ে কাছের সমুদ্র বন্দর হবে মোংলা। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকার দুরত্ব ২৬৪ কিলোমিটার আর মোংলার দুরত্ব হবে ১৭০ কিলোমিটার। প্রায় ১০০ কিলোমিটার কম হবে। এই সুবিধাটা মোংলা বন্দর পাবে। আশা করা যায়, বন্দর ব্যবহারকারীদের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পাবে। এরই মধ্যে অনেক আমদানি-রপ্তানিকারক বন্দর ব্যবহারে তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।
এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ২০৪১ সালে বাংলাদেশ যে উন্নত দেশ হবে, সে ক্ষেত্রেও এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, স্বপ্নের এই সেতুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ।
পরিশেষে বলা যায় যে, মনণের কবি যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বাধীনতার কবি যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তেমনি উন্নয়নের কবি দেশরত্ন শেখ হাসিনা । দেশরত্ন্ শেখ হাসিনার সরকারই পারে এই সরকারই পারবে বাংলাদেশের জনগণের স্বপ্নপূরন করতে।
লেখক: অধ্যাপক পুরকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়