3863
Published on জুন 14, 2022প্রণব কুমার পান্ডে:
পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছে। বিশেষত বিশ্ব ব্যাংকের কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন না করার সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে অনেক কথাবার্তা হয়েছে বিভিন্ন সময়। সেই সময় পদ্মা সেতুতে প্রভাব বিস্তারের জন্য বিশ্ব ব্যাংক অনৈতিকভাবে দুর্নীতির বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল। তবে বিশ্ব ব্যাংককে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে রাষ্ট্রের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে আত্মবিশ্বাসী করেছে এবং বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে। পরবর্তীতে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হলে এই বিষয় নিয়ে তেমন কোনো কথাবার্তা হয়নি।
অনেকেরই ধারণা ছিল, বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করতে পারবে না। কিন্তু পদ্মা সেতুর কার্যক্রম যখন সমাপ্ত হয়ে গেল এবং দৃশ্যমান হলো সেতু, তখন অনেকেরই মধ্যেই জ্বালা শুরু হলো নতুন ভাবে। বিশেষত যখন সরকারের তরফ থেকে পদ্মা সেতু জনগণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো, তখনই শুরু হল পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যাচার। মিথ্যাচারের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে এক ধরনের ধোঁয়াশা সৃষ্টির অপপ্রয়াস বিএনপি’র পক্ষ থেকে চলমান রয়েছে।
পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক বিএনপির বিভিন্ন নেতা-কর্মীদের মিথ্যাচারের খেলা অনেকদিন ধরেই চলছে। কিন্তু সেটি সকল স্তরকে অতিক্রম করল যখন বিএনপির সেক্রেটারি জেনারেল মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করলেন পদ্মা সেতুর ফাউন্ডেশন বা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তার এই বক্তব্যের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তার এই বক্তব্য নিয়ে অনেকেই হয়তো সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন এই জন্য যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হয়তো এ ধরনের মিথ্যাচার করবেন না।
অনেকে আবার এটিও ধারণা করেছিলেন যে এই বক্তব্যটি হয়তো এডিট করা। কিন্তু সেই বক্তব্য যারা দেখেছেন এবং শুনেছেন তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে সেই বক্তব্য মির্জা ফখরুল ইসলামের নিজস্ব বক্তব্য। এই বক্তব্যটি সম্পর্কে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হওয়ার পরেও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যেহেতু সেই বিষয়টি অস্বীকার করেননি, অতএব এটা নিয়ে সন্দেহ করার কোনও অবকাশ নেই যে এ ধরনের মিথ্যাচার মির্জা ফখরুল ইসলাম নিজেই করেছেন।
বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের সেকেন্ড ইন কমান্ডের মুখ থেকে এই ধরনের মিথ্যাচার জাতি কখনো প্রত্যাশা করে না। তার এই ভিডিওটি ভাইরাল হবার পরে বিভিন্ন মিডিয়া এবং পত্রিকার সাংবাদিকরা বিষয়টির সত্যতা যাচাই করবার চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন টেলিভিশনে রিপোর্ট হয়েছে এই বিষয়ে। কোনও সাংবাদিকই তার এই বক্তব্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেননি। বরং আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন ১৯৯৬-২০০১ সালের মেয়াদকালে– এই বিষয়টি প্রমাণ হয়েছে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারিত খবরে।
এরপরও পদ্মা সেতু নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপ্রাসঙ্গিক এবং মিথ্যাচার করে চলেছে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্যরা। বিএনপির সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা যেভাবে পদ্মা সেতুকে ভারতের ভূপেন হাজারিকা সেতুর সাথে তুলনা করে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন– সেটিও জনগণের কাছে এখন হাস্যকর বক্তব্যে পরিণত হয়েছে। আমাদের সকলের মনে রাখা উচিত সমালোচনার জন্য সমালোচনা করা কখনোই কোনো নাগরিকের দায়িত্ব নয়। সংসদে দাঁড়িয়ে এই ধরনের অযৌক্তিক বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের বিভ্রান্ত করা এবং জাতিকে বিভ্রান্ত করা কোনও রাজনৈতিক দলের সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব নয়। তিনি পদ্মা সেতু সম্পর্কে বিশদভাবে না জেনেই ভারতের ভূপেন হাজারিকা সেতুর সাথে পদ্মা সেতুকে তুলনা করে নিজেকে হাসির পাত্রে পরিণত করেছেন।
তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি মহোদয়কে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে চায় এই জন্য যে তিনি অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ, তথ্যনির্ভর এবং প্রাঞ্জল ভাষায় বিএনপির সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানার মিথ্যাচারের জবাব দিয়েছেন। তিনি যে সমস্ত তথ্য সংসদে উপস্থাপন করেছেন তার মাধ্যমে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে রুমিন ফারহানা ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে শুধু বিরোধিতার খাতিরে এই ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে জাতিকে বিভ্রান্ত করবার চেষ্টা করেছেন। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী তার বক্তব্যে সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন যে ভূপেন হাজারিকা সেতুর পাইল লোড ক্যাপাসিটি ছিল মাত্র ৬০ টন, অন্যদিকে পদ্মা সেতুর পাইল লোড ক্যাপাসিটি ৮২০০ টন।
শুধু তাই নয় ভূপেন হাজারিকা সেতুর একটি পিলারের ওজন ১২০ টন, আর পদ্মা সেতুর একটি পিলারের ওজন ৫০ হাজার টন। এই প্রেক্ষাপট থেকে বিচার করলে পদ্মাসেতু ভূপেন হাজারিকা সেতুর তুলনায় ২৫০ গুণ বেশি ভারী এবং শক্তিশালী। তাছাড়া এই পাইলিং করবার জন্য যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে সেটিও বিশ্বে বিরল। জার্মানির একটি প্রতিষ্ঠান থেকে বিশেষভাবে তৈরি করে আনা হয়েছে পাইলিং-এর মেশিন যা মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তাছাড়া পদ্মা সেতু তৈরির সময় ১৬ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নদী শাসন করতে হয়েছে যেখানে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে সরকারকে। ফলে ভূপেন হাজারিকা সেতুর সাথে পদ্মা সেতুকে তুলনা করে প্রকারান্তরে রুমিন ফারহানা নিজেকেই হাসির পাত্রে পরিণত করেছেন।
পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ এতটা সহজ ছিল না। এখানে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল। পদ্মা সেতুর প্রধান চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলার সময় পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সাথে যুক্ত বিশেষজ্ঞ সদস্য প্রয়াত প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী এক সময় বলেছিলেন যে “এই সেতুর প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পদ্মা-যমুনার মিলিত প্রবাহ। প্রতি সেকেন্ডে মাওয়া পয়েন্টে এক লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। এমন হিসাব মিলছে ১০০ বছরের তথ্য থেকে। আমাজন নদীর পরেই কোন নদী দিয়ে এত পানি প্রবাহিত হয়। বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে প্রবাহিত হয় প্রতি সেকেন্ডে ৯০ হাজার ঘনমিটার পানি। ফলে, পদ্মা সেতুর ডিজাইন করতে গিয়ে আরেকটি বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হয়েছে- এখন যে নদীর তলদেশ, আগামী ১০০ বছর পর তেমনটি কি থাকবে? অর্থাৎ যদি তলদেশের মাটি উধাও হয়ে যায়? সমীক্ষায় দেখা গেছে আগামী ১০০ বছরে নদীর তলদেশের ৬২ মিটার পর্যন্ত পানি সরে যেতে পারে। এই ‘৬২ মিটার’ বিবেচনায় নিয়ে ডিজাইন করতে হয়েছে। আমরা নিশ্চিত নই মাটির স্তর থাকবে কি থাকবে না? সেতুর খুঁটি এমন গভীরতায় নিতে হবে, যাতে সেতু এবং তার উপর দিয়ে চলা গাড়ির চাপ নিতে পারে। প্রবল ভূমিকম্প হলেও যেন সেতুটি বসে না যায়। যমুনায় ৬৫ মিটার নিচে একটি পাথরের লেয়ার পাওয়া গেছে। কিন্তু পদ্মায় যে আরও অতল। এখানে ৬২ মিটার ঝুঁকিপূর্ণ। তাই পাইল ১২০ মিটার পর্যন্ত হবে। যে কোন সেতুর জন্য এটি এ পর্যন্ত গভীরতম পাইল বলে জানিয়েছিলেন প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী (আজয় দাশগুপ্ত, জামিলুর রেজা চৌধুরীর ভাষ্যে পদ্মা সেতু সাতকাহন, সমকাল, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৫)।
এই সময় পদ্মা সেতুতে ব্যয় বৃদ্ধি সম্পর্কে প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেছিলেন বিশ্ব ব্যাংক-এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক-জাইকা যখন পদ্মাসেতুতে যুক্ত ছিল, তখন ঠিক হয়েছিল কাস্টমস শুল্ক ও ভ্যাট পরিশোধ করবে সরকার। এ হিসেব থাকত কাগজে-কলমে। সে কারণে ব্যয় কিছুটা কম দেখা গেছে। এখন তা দেবে ঠিকাদার। তবে তারা এ অর্থ তো আমাদের সরকারের কাছ থেকে নেবে। প্রকৃতপক্ষে আগের সঙ্গে বর্তমান ব্যয়ের তেমন পার্থক্য নেই। কিছু ব্যয় মূল্যস্ফীতির কারণে বেড়েছে (সমকাল, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৫)।
তাছাড়া নদী শাসনের অনেক ধরনের সরঞ্জাম কিনতে হয়েছে জার্মানি এবং অন্যান্য দেশ থেকে। বিদেশি কনসালটেন্টদের বেতন-ভাতা দিতে হয় ডলার-ইয়েন-পাউন্ডে। পদ্মা সেতুর ব্যয় যখন প্রথমে প্রাক্কলন করা হয়েছিল, তখন ডলারের মূল্য ৬৮/৬৯ টাকার মতো ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে যখন ব্যয় করা হয়, তখন প্রতি ডলার পেতে ব্যয় করতে হয়েছে ৮৪.৮০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ডলার কিনতে প্রায় ২৪ থেকে ২৫ শতাংশ বেশি ব্যয় করতে হয়েছে। ফলে সঙ্গত কারণেই প্রাক্কলিত ব্যয়ের বেশি ব্যয় হয়েছে পদ্মা সেতু নির্মাণে।
পরিশেষে, পদ্মা সেতু নিশ্চিতভাবেই পৃথিবীর বুকে একটি অনন্য উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের আত্মমর্যাদার প্রতীক এবং আমাদের দেশকে আরও আত্মবিশ্বাসী করেছে। এমতাবস্থায় দাঁড়িয়ে শুধু সরকারের সমালোচনা করা অথবা বিরোধিতার জন্য মিথ্যাচার করে জাতিকে বিভ্রান্ত করবার কোনও অবকাশ নেই। এই মিথ্যাচারের পেছনে আরেকটি কারণ থাকতে পারে। পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হবার সাথে সাথে জনগণের মধ্যে বিশেষত দক্ষিণাঞ্চলের জনগণের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হবে, যেটি আগামী নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে। এই ভয় থেকেই হয়তো বিএনপির নেতৃবৃন্দ মিথ্যাচারের মাধ্যমে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন।
ফলে সকলের কাছে আহ্বান জানাতে চাই, আসুন বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা না করে পদ্মা সেতুর সফলতাকে আমরা সকলে মিলে ভাগ করে নিই। আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হবার সাথে সাথেই বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাথে অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে চলেছে। এর মাধ্যমে ওই অঞ্চলের অর্থনীতি এবং সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক দিগন্ত উন্মুক্ত করবে পদ্মা সেতু– এটিই সকলের বিশ্বাস।