630
Published on জুন 9, 2022ড. আতিউর রহমান:
পদ্মা সেতু আমাদের আবেগের নাম। জাতীয় অহংকার ও সাহসের আরেক নাম। সক্ষমতার প্রতীক। আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামের এক উজ্জ্বল মাইলফলক। হঠাৎ করে বিশ্বব্যাপী করোনা সংকট দেখা না দিলে আরো আগেই ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু চালু হয়ে যেত। শুরু থেকেই নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে পদ্মা সেতুর কাজটি এগিয়েছে। রাজনৈতিক, কারিগরি ও আর্থিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। একটি স্বাধীন দেশ তার জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজের অর্থে এমন একটি চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প সম্পন্ন করার যে সাহস দেখিয়েছে তার পেছনে নিশ্চয় একটি লড়াকু মন আছে। আর প্রতিকূলতা জয় করে সফল হওয়ার এই সংস্কৃতি আমাদের জাতির পিতাই আমাদের শিখিয়েছেন। সেই সংগ্রামী মননের স্বাভাবিক বিস্তার আমরা তার কন্যা শেখ হাসিনার মধ্যেও দেখতে পাই। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে পা রেখে দুর্বার গতিতে স্বদেশ গড়ার এক অসামান্য লড়াইয়ে নেমেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। স্বীকার করতেই হবে পদ্মা সেতু সাহসী নেতৃত্বের এক কালজয়ী পরম্পরার ফসল।
আবেগ ও উচ্ছ্বাস বাদেও পদ্মা সেতুর প্রভাবে বাংলাদেশের, বিশেষ করে দক্ষিণ বাংলার অর্থনীতির ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে সে বিষয় নিয়ে কিছু বলতে চাই। নিশ্চিতভাবেই দক্ষিণ বাংলার অর্থনীতিতে পড়বে ব্যাপক প্রভাব। এ অঞ্চলের একুশটি জেলার অর্থনীতি ও সমাজে আসবে অকল্পনীয় পরিবর্তন। এই সেতু চালু হওয়ার পর সড়ক ও রেল—দুই পথেই দক্ষিণ বাংলার মানুষ অল্প সময়ে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবেন। দিনের পর দিন আর পণ্যবাহী ট্রাকগুলো ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় বসে থাকবে না। আর ঝড়বৃষ্টিতে ফেরি বন্ধ থাকার কারণে মানুষের যাতায়াতও থমকে থাকবে না। সেতুটির কারণেই এই প্রথম বারের মতো পুরো দেশ একটি সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোতে চলে আসবে। দক্ষিণ বাংলার গ্রামেও পরিবর্তনের হাওয়া লাগবে। এই অঞ্চলের কৃষক, মৎস্যজীবী, তাঁতি, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভোক্তার সমাবেশ যে রাজধানী ঢাকা তার সঙ্গে অনায়াসে সংযুক্ত হতে পারবেন। অন্য দিকে তারা রাজধানী থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে পারবেন তাদের গ্রামের ও আশপাশের এসএমই উদ্যোগগুলোর জন্য। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু হবে শুনেই ব্যবসায়-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নত হতে শুরু করেছে। নতুন নতুন ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিল্পকারখানা, আবাসন প্রকল্প, রিসোর্ট, বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক, মানবসম্পদ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, রেস্টুরেন্ট ও নানা ধরনের এসএমই উদ্যোগ স্থাপনের হিড়িক পড়ে গেছে। খুলনা ও বরিশালে জাহাজ নির্মাণশিল্পের প্রসার ঘটতে শুরু করেছে।
কুয়াকাটায় পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটছে দ্রুত গতিতে। আগামী দিনগুলোতে বিকাশের এই ধারা আরো বেগবান হবে। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে রেলের পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেট অবকাঠামোও স্থাপিত হবে। এর ফলে কলকাতার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগের সময় প্রায় অর্ধেকে নেমে আসবে। এর প্রভাব বাংলাদেশ এবং ভারত, ভুটান ও নেপালের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। পায়রা ও মোংলা সমুদ্র বন্দরের পণ্যসেবার পরিমাণ বাড়বে। নতুন নতুন জাহাজ ভিড়বে। ইন্টারনেট-সেবা সহজেই পেলে দক্ষিণাঞ্চলে ডিজিটাল ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যা বাড়বে। আর গ্যাস ও বিদ্যুৎ সহজলভ্য হলে এ অঞ্চলে ব্যবসায়-বাণিজ্যের বিকাশও ঘটবে। আর সেটা হলে এখন যে জলবায়ু চ্যালেঞ্জের শিকার অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসে ঝুঁকিপূর্ণ অনানুষ্ঠানিক কাজকর্ম করতে বাধ্য হচ্ছে, তাদের সংখ্যা কমে আসবে। দক্ষিণ বাংলায় নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। নতুন নতুন শহরও গড়ে উঠবে।
শোনা যাচ্ছে, পদ্মার চরাঞ্চলে অলিম্পিক ভিলেজ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, হাইটেক পার্ক, আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, বিমানবন্দরসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কথা ভাবছে সরকার। পদ্মা সেতুর কাছেই ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি গড়ে উঠছে। এখানে থাকবে আধুনিক আবাসন, শিক্ষা, চিকিত্সাসহ সব সুযোগ-সুবিধা। পদ্মা সেতুর আশপাশে গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রসার ঘটবে। খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালীতে শিপ-বিল্ডিং শিল্পের বিকাশ ঘটবে। মোংলা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, মোংলা ইপিজেড, পায়রাবন্দর, রূপপুর প্রকল্পের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা গেলে এসব প্রকল্পে বিপুল কর্মসংস্হান ঘটবে। একটি গবেষণায় বলা হচ্ছে যে, পদ্মা সেতু চালু হবার পর বছরে প্রায় বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ১.০৪ শতাংশের কর্মসংস্থান হবে। আরো সহজ করে বলা যায় আগামী পাঁচ বছরে ১০ লাখ অর্থাৎ বছরে ২ লাখ মানুষের নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে। ১০ বছর পর এই সংখ্যা তিন গুণ হয়ে যাবে।
দক্ষিণ বাংলায় বাংলাদেশের ২৭ শতাংশ মানুষের বাস। বিচ্ছিন্ন থাকা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই অঞ্চলের দারিদ্রের হার সারা দেশের গড় হার থেকে ৫ শতাংশ বেশি। সেতুর কারণে যোগাযোগ ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত হলে এই অঞ্চলের দারিদ্রের হার ফি বছর ১ দশমিক ০১ শতাংশ হারে কমবে। এর প্রভাবে সারা দেশের দারিদ্র্য কমবে ০ দশমিক ৮৪ শতাংশ হারে। বিসিক বলছে, আগামী পাঁচ বছরে শুধু বরিশাল বিভাগেই ৫০০ থেকে ১ হাজার নতুন শিল্প কারখানা স্থাপিত হবে।
পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক লাভের হার (ইআরআর) ১৮-২২ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার ফলে ৩১ বছরের মধ্যেই এই সেতুর পুরো খরচ উঠে আসবে। সেতু চালু হবার পর উপযুক্ত সহায়ক সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ উত্সাহিত করা গেলে আরো কম সময়ের মধ্যে এই বিনিয়োগ বাবদ অর্থ পুরোপুরিই উঠে আসবে। বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর উত্তরবঙ্গে যে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এ দক্ষিণাঞ্চলের আর্থসামাজিক পরিবর্তন আরো দ্রুত লয়ে ঘটবে। কেননা পদ্মা সেতুর কারণেই আঞ্চলিক যোগাযোগ এক নতুন মাত্রা পাবে। ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে ও রেলওয়ের সঙ্গে পুরো বাংলাদেশের সংযোগ ঘটবে। তাছাড়া তামাবিল থেকে বেনাপোল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের ফলে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্যে বিস্ফোরণ ঘটবে।
অর্থনীতিবিদরা মডেলিং করে হিসাব করছেন যে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলের জিডিপি অন্তত ২ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়বে। সামগ্রিকভাবে তখন দেশের জিডিপি বাড়বে অন্তত আরো ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। ট্রান্স এশিয়ান রেল ও সড়ক এই সেতুর মাধ্যমেই যুক্ত হবে। রেলের প্রভাবে জাতীয় জিডিপিতে আর ১ শতাংশ যোগ হবে প্রতি বছর। ২০২৪ সাল নাগাদ ২৪ হাজার যান চলাচল করবে এই সেতু দিয়ে। প্রতি বছর তা বাড়বে। ২০৫০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা ৬৭ হাজারে উঠে যাবে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের অংশ হিসেবেই সেতুর আশপাশে অনেকটা নদীর পাড় নদীশাসনের আওতায় আনা হয়েছে। এর ফলে ঐ এলাকায় নদীভাঙন রোধ করা গেছে। সেতু নির্মাণের কারণে যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তাদের জমির দামের কয়েক গুণ ক্ষতিপূরণ ছাড়াও পরিকল্পিত উপায়ে তাদের পুনর্বাসন করা হয়েছে। তাই এই অঞ্চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষাসহ মানবোন্নয়নে ব্যাপক অগ্রগতির ভিত্তি তৈরি করা হয়েছে। আমরা লক্ষ করেছি যে, বঙ্গবন্ধু সেতুর প্রভাবে প্রতি বছর ২ শতাংশের মতো নতুন করে দেশের জিডিপিতে যোগ হচ্ছে। উত্তরবঙ্গ থেকে চরম খাদ্যাভাব বা মঙ্গা পালিয়েছে। পদ্মা সেতুর কল্যাণে দক্ষিণ বাংলাতেও অনুরূপ ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে—তেমনটিই আমরা আশা করছি।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
সৌজন্যেঃ দৈনিক ইত্তেফাক