2815
Published on মে 19, 2022জেবউননেছা:
উত্তাল ১৯৭১। বিক্ষুব্ধ সেই সময়ে কলমসৈনিক কবি ও নাট্যকার মু. জালাল উদ্দিন নলুয়া তাঁর ‘১৯৭১-এর দিনলিপি’–তে ৮ মার্চ লেখেন, ‘গতকাল রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাবেশে ভাষণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। ভাষণ ঢাকা থেকে রিলে করার কথা ছিল, কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষ তা হতে দেয়নি। তাই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ঢাকা বেতারের ৩য় অধিবেশন প্রচারিত হয়। পরে আজ ৮.৩০ মিনিটে ভাষণ পুনঃপ্রচার হয়। বেতারে বঙ্গবন্ধুর দলীয় বার্তা প্রচার করার জন্য ৮.৫৫ মিনিট ও দুপুর ১.৩০ মিনিটে স্পেশাল বুলেটিনের ব্যবস্থা করা হয়। বর্তমানে রাজধানী ঢাকা বঙ্গবন্ধুর বশে। আর পূর্ব বাংলার প্রতিটি লোক টলছে গণতন্ত্রের পতাকাবাহী বঙ্গবন্ধুর আদেশে।’
অন্যদিকে, ১৩ আগস্ট ‘১৯৭১-এর দিনলিপি’–তে ‘বেতারের বাংলা’ শিরোনাম দিয়ে কবি ও নাট্যকার মু. জালাল উদ্দিন লেখেন, ‘ঢাকা বেতারে আজকাল যে হারে বাংলা সংবাদে কথিকায় আর খুঁটিনাটি ব্যাপারে উর্দুকে অহেতুকভাবে টেনে আনা হচ্ছে, এতে কৌতুকের উদ্রেক করে। আমার মনে হয় খাঁটি বাংলাটা হিন্দুয়ানিতে পূর্ণ মনে করে ঢাকা বেতার এক্ষণে বাংলায় উর্দুর মিশ্রণ ঘটিয়ে এটাকে মুসলমানত্বে পরিণত করতে চাচ্ছে। কাককে ময়ূরের পুচ্ছ পরালে আপামর জনসাধারণের কাছে তা কাকের রূপেই থাকবে।’
একজন নিভৃতচারী লেখকের এ দুটি দিনলিপি থেকে এটি স্পষ্ট, তৎকালীন সময়ে পূর্ব বাংলার প্রতিটি মানুষ আত্মচোখে, অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কিছু শোনার অপেক্ষায় ছিলেন। অথচ যখন তিনি এ কথা লিখছেন, তখন বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ, শিক্ষক, লেখক, বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ৫৭/৮ নম্বর বাড়ি থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রচার করে যাচ্ছেন স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য নানা অনুষ্ঠান। এই বাড়িতে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা থাকতেন। কিন্তু বেতারের জন্য অফিসটি ছেড়ে দেন তাঁরা। উল্লেখ্য, পূর্ব বাংলার ঢাকাতে ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেডিও সম্প্রচার শুরু হয়। ঢাকায় নাজিমুদ্দিন রোডে একটি ভাড়া করা বাড়িতে বর্তমানে যেটি শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ। বেতার কেন্দ্রটির নাম ছিল অল ইন্ডিয়া রেডিও, ঢাকা ‘ঢাকা ধ্বনি বিস্তার কেন্দ্র’।
১৯৭১ সালে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের সংগীত বিভাগের অনুষ্ঠান প্রযোজক বীর মুক্তিযোদ্ধা জালাল উদ্দিন রুমী তাঁর লেখা ‘রেডিও পাকিস্তানের আমার শেষ দিন’ শিরোনামে এক লেখায় লেখেন, ‘আমরা বেতার কেন্দ্র ছেড়ে চলে যাওয়ার ফন্দি আঁটছিলাম। যাবই যখন, কিছু গানের টেপ নিয়ে পালাতে হবে। তখন আমাদের টেপ লাইব্রেরিয়ান ছিল স্নেহধন্য হামিদুল ইসলাম। আমরা যখন পালাবার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম, ঠিক তখনই বিশ্বস্তসূত্রে খবর পেলাম যে রেডিও পাকিস্তান ঢাকার ঊর্ধ্বতন অফিসার হেমায়েত হোসেন, যিনি খুব সম্ভবত রেডিওর পত্রিকা “এলান”-এর সম্পাদক ছিলেন, তিনি এবং “দৈনিক সংগ্রাম” পত্রিকার সম্পাদক আখতার ফারুক সমেত আরও কারা কারা যেন মিলে একটি “ব্রডকাস্টিং কমিটি” গঠন করেছে। কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য হলো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রেডিও থেকে কোনো কথা বা গান প্রচার হতে পারবে না। প্রচার হলেই তারা তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানি সেনাদের জানিয়ে দেবে এবং দেশদ্রোহের অপরাধে তাদের শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করবে।’ এসব বাধা অতিক্রম করে দেশের মুক্তিকামী জনগণ বেতারে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রাবন্ধিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর ‘ইতিহাসের রক্ত পলাশ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর’ গ্রন্থে লিখেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশজুড়ে যখন বর্বর গণহত্যা চলছে, তখন মাহমুদ আলী ছিলেন পাকিস্তানিদের সবচেয়ে বড় দোসর। তাঁর মেয়ে তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে যে অশালীন ভাষায় স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং মুজিববিরোধী প্রচারণা চালিয়েছেন, তা নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করা বড়ই কঠিন।
গাফ্ফার চৌধুরীর মতো তৎকালীন সময়ে অনেকেই ঢাকা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকায় এ বিরুদ্ধাচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করেছেন। তিনটি পর্যায়ে এ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (বিপ্লবী), যার শুভসূচনা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে কালুরঘাট (চট্টগ্রাম) প্রচার ভবনে ১০ কিলোওয়াট মধ্যম তরঙ্গ ট্রান্সমিটারের সাহায্যে। এ প্রচার ভবন বিমান হামলায় আক্রান্ত হয় ১৯৭১ সালের। এ কেন্দ্রের প্রথম তথা প্রতিষ্ঠা পর্যায়ের স্থিতি ছিল ২৬ থেকে ৩০ মার্চ দুপুর পর্যন্ত। ২৬ মার্চ বেলাল মোহাম্মদের কণ্ঠ থেকে প্রচারিত হয় প্রথম বেতার কথিকা। ‘হানাদার-দুশমন। ওদের ক্ষমা নেই-ক্ষমা নেই। স্বাধীন বাংলার প্রতিটি গৃহ এক একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ। বাঙালি আজ জেগেছে, জয় নিপীড়িত জনগণের জয়/ জয় সব অভিযান, জয় নব উত্থান। জয় স্বাধীন বাংলা।’
এরপর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করেন। আবুল কাশেম সন্দ্বীপ বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন ভাষণ এবং স্বাধীনতাসংগ্রামের কথা প্রচার করেন। ২৭ মার্চ সকালে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের ১০ জন বেতারকর্মী বসে কাজ করছেন। এর মধ্যে লেফটেন্যান্ট শমসের এবং মেজর জিয়া আসেন। মেজর জিয়াকে অনুরোধ করা হয়, বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে একটি ঘোষণা পাঠ করার জন্য। ২৭ মার্চ বিকেলবেলা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় পর্যায়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম অধিবেশন প্রচার করা হয় ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল রাত ৯টায় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বগাফা বিএসএফ ৯২ হেড কোয়ার্টারসে একটি ২০০ ওয়াট ক্ষুদ্র তরঙ্গ ট্রান্সমিটার থেকে। ১৯৭১ সালের ২৪ মে পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ভারতের তথ্যমন্ত্রী ড. ত্রিগুণা সেন এবং ভারতের কেন্দ্রীয় তথ্য প্রতিমন্ত্রী নন্দিনী শৎপথী সাহায্য করেন। তাঁরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের আশ্বাস দেন যে অচিরেই প্রবাসী সরকারের অধীন একটি ৫০ কিলোওয়াট মধ্যম তরঙ্গ ট্রান্সমিটার দেওয়া হবে মুজিবনগরে। ১৯৭১ সালের ২২ মে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে একটি গোপন বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত অনেকের মধ্যে থাকেন আবদুল মান্নান, এম আর আখতার মুকুল। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনকে সামনে রেখে ২৫ জ্যৈষ্ঠ, ২৫ মে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। মিডিয়াম ওয়েভ ৩৬১.৪৪ মিটার ব্যান্ডে প্রতি সেকেন্ড ৮৩০ কিলোসাইকেলে প্রতিধ্বনিত হয় বাঙালি জাতির মর্মবাণী। বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এম আর আখতার মুকুল, পটুয়া কামরুল হাসান, আমিনুল হক, আশফাকুর রহমান ও তাহের সুলতান। দৈনিক সকাল ৭টা ও সন্ধ্যা ৭টায় দুই অধিবেশনে প্রচারিত হতো অনুষ্ঠান। প্রথম গান বাণীবদ্ধ করেন রংপুর বেতারের তৎকালীন পল্লিগীতিশিল্পী শাহ আলী সরকার।
এ বেতার কেন্দ্রের প্রথম কোনো স্টুডিও ছিল না। তিন কামরার দোতলার একটি জানালা-দরজা বন্ধ করে রেকর্ডিংয়ের কাজ শুরু হয়। বিএসএফের পক্ষ থেকে এক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একটি জিপ গাড়ি করে এ রেকর্ডেড স্পুল টেপ একটি নির্দিষ্ট পোর্টফোলিও ব্যাগে পৌঁছে দিতেন। প্রথম দিনের কর্মসূচি ছিল সকাল ৭টায় পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত ও তরজমা, ৭টা ১০ মিনিটে দৈনিক দুটি অধিবেশনের প্রচারসংক্রান্ত ঘোষণা, ৭টা ১৫ মিনিটে বাংলা সংবাদ, ৭টা ২৫ মিনিটে ইংরেজি সংবাদ, ৭টা ৩০ মিনিটে আবৃত্তি ও গানের অনুষ্ঠান ‘অগ্নিশিখা’। সাহিত্যের অনুষ্ঠান ‘রক্তস্বাক্ষর’, বঙ্গবন্ধুর ভাষণভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘বজ্রকণ্ঠ’ ও ‘চরমপত্র’।
আশফাকুর রহমান, তাহের সুলতান, টি এইচ শিকদার ঢাকা থেকে কলকাতা যাওয়ার সময় রেডিও স্টেশনের টেপ লাইব্রেরি থেকে অসহযোগ আন্দোলনের সময়কার বেশ কিছু গানের টেপ নিয়ে গিয়েছিলেন বালিশের মধ্যে। এতে স্পুলগুলো ভেঙে গিয়েছিল। তাহের সুলতান সেই স্পুলগুলো সারা দিন পরিশ্রম করে নতুন স্পুলে উঠিয়েছিলেন। এম আর আখতার মুকুলের লেখার নাম ‘চরমপত্র’ দিয়েছেন আশফাকুর রহমান। প্রথম দিনে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত রেকর্ডিং হলো ‘সাপ্তাহিক জয় বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদক মরহুম মোহাম্মদউল্লাহ চৌধুরীর কণ্ঠে। মিসেস টি হোসেন, পারভীন হোসেন ছদ্মনামে প্রথম ইংরেজি সংবাদ পড়লেন। বাংলা সংবাদের দায়িত্বে রইলেন কামাল লোহানী। চিত্রাভিনেতা হাসান ইমাম, সালেহ আহমদ ছদ্মনামে প্রথম ইংরেজি সংবাদ পড়লেন। অনুষ্ঠান ঘোষণা ও প্রোগ্রামের সার্বিক দায়িত্ব দেওয়া হয় আশফাকুর রহমানকে। নিউজ রুম কামাল লোহানীর দায়িত্বে রাখা হয়। বেতার কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠার পর তিন সপ্তাহের মধ্যে বহু গুণী ব্যক্তি এসে হাজির হলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত অনুষ্ঠান ছিল ‘প্রতিনিধির কণ্ঠ’, সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদের ‘পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে’, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘বিচার প্রহসন’, আমির হোসেনের ‘সংবাদ পর্যালোচনা’ ধারাবাহিকভাবে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সৈয়দ আলী আহসানের ‘ইসলামের দৃষ্টিতে’, ধারাবাহিক কথিকা ডক্টর মাযহারুল ইসলাম, অধ্যাপক আবদুল হাফিজ ও সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্তের ‘দৃষ্টিপাত’, সাদেকীনের ‘বিশ্ব জনমত’, মাহবুব তালুকদারের ‘মানুষের মুখ’, আবদুল রাজ্জাক চৌধুরীর ‘পর্যালোচনা ও সূর্য শপথ’, মাহমুদুল্লাহ চৌধুরীর ‘দখলীকৃত এলাকা ঘুরে এলাম’, বদরুল হাসানের ‘বেইমানের দলিল’, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পাণ্ডুলিপি লিখন ও কণ্ঠদান করেন মোহাম্মদ মুসা, নাসিম চৌধুরীর ‘গেরিলাযুদ্ধের কলাকৌশল’, চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান স্বকণ্ঠে প্রচার করেন ‘পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ’। শওকত ওসমানের ‘ইয়াহিয়া জবাব দাও’। সিকান্দর আবু জাফরের ‘অভিযোগ ইসতেহার’। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান ‘অগ্নিশিখা’র দায়িত্ব দেওয়া হয় টি এইচ শিকদারকে। সংগীত পরিচালক সমর দাস অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন। নাট্যকার কল্যাণ মিত্রের লেখা ‘জল্লাদের দরবার’ ইয়াহিয়ার খানের ভূমিকায় রাজু আহমেদ।
বাচ্চাদের জন্য সপ্তাহে দুদিনে ‘ওরা রক্তবীজ’ অনুষ্ঠানটি দু-তিন সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয়নি। কেননা, যে উদ্দেশ্যে এই অনুষ্ঠান চালু করা হয়েছিল, তা সফল হয়েছিল। প্রতিরক্ষাসচিব আবদুস সামাদের সহযোগিতায় প্রত্যেক সমরদাতাকে একটি করে টেপরেকর্ডার দিয়ে রণাঙ্গনে পাঠানো হলো। তাঁদের পাঠানো সংবাদ পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সংবাদ বুলেটিনে বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ড. আনিসুজ্জামানের লেখা ‘অমর ১৭ সেপ্টেম্বর’ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অমূল্য সম্পদ। জাহিদ সিদ্দিকী ছিলেন উর্দু খবর পর্যালোচক। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছেলে কাজী সব্যসাচী আবৃত্তি করতেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ইংরেজি ভাষার অনুষ্ঠান আলী যাকের, ছদ্মনাম আবু মোহাম্মদ আলী নামে পরিচালনা করতেন। আরেকজন ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্র পরিচালক আলমগীর কবির, ছদ্মনাম আহমেদ চৌধুরী। তাঁরা দুজন অনুষ্ঠান সফল করার জন্য অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন। যেসব ছাত্রনেতা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মূল্যবান ভাষণ এবং কথিকা প্রচার করেছেন, তাঁদের মধ্যে নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, এম এ রেজা প্রমুখ। অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার ৬টি বেতার কেন্দ্র থেকে ভয়াবহ অপপ্রচার চালানোর বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল অন্যতম একটি প্ল্যাটফর্ম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম অধিবেশনের যেসব নারী সংগঠক হিসেবে ছিলেন, তাঁরা হলেন ডা. মঞ্জুলা আনোয়ার, কাজী হোসনে আরা ও বেগম মুশতারী শফী। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কিছু কর্মী একটি ট্রান্সমিটারসহ আগরতলায় উপস্থিত হলে ভারতীয় জনগণ ও সরকারের সহযোগিতায় তাঁরা বাংলাদেশের নামে বেতার প্রচারণাও শুরু করতে সমর্থ হন। তা ছাড়া অল ইন্ডিয়া রেডিওর সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র্রের প্রচারকাজ শুরু করেছিল। এসব অনুষ্ঠানে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল সংবাদ। সংবাদের মাধ্যমে জাতি উদ্বুদ্ধ হতো নতুন নতুন উদ্যোগে। আর এই সংবাদ বিভাগ সমৃদ্ধ হয়েছিল যাঁদের মাধ্যমে, তাঁরা হলেন জারিন (নাসরিন) আহমাদ (ইংরেজি), পারভীন হোসেন (বাংলা), তাজিন শাহনাজ মুর্শিদ, শেফালী দাস প্রমুখ।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব নাটকে নাট্যকার, নাট্য প্রযোজক ও নাট্যশিল্পীদের মধ্যে যেসব নারী অংশ নেন, তাঁদের মধ্যে মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, সুমিতা দেবী, করুণা রায়, লায়লা হাসান, কাজী তামান্না, উম্মে কুলসুম, সুফিয়া খাতুন, দিলশাদ বেগম প্রমুখ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত জীবন্তিকা ‘জল্লাদের দরবার’, ‘জনতার আদালত’ ও মীর জাফরের রোজনামচার মধ্যে ‘জল্লাদের দরবার’ নাটকটিতে পাকিস্তানি বাহিনীর হতাশা ও পরাজয়ের চিত্র ব্যঙ্গবিদ্রুপের মাধ্যমে প্রকাশ করা হতো। পুরুষের পাশাপাশি এতে অমিতা বসু ও আলেয়া ফেরদৌসী চমৎকার অভিনয় করেন। এ নাটকে জারীন আহমাদ ও মুশতারী শফীও অভিনয় করেন। নমিতা ঘোষ ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম নারী শিল্পী। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী কণ্ঠশিল্পী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সংগীত পরিবেশন করেছেন, যাঁরা ইতিহাসে সুরসৈনিক হিসেবে সমাদৃত।
এ বেতার কেন্দ্রের সীমিতসংখ্যক বাদ্যযন্ত্র ও যন্ত্রশিল্পী ছিল, সাউন্ডপ্রুফ রেকর্ডিং স্টুডিও ছিল না। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িটিতে দোতলার যে ছোট কক্ষটিতে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ থাকতেন, সেই কক্ষটির চারদিকের দেয়ালে বিছানার চাদর ও কাপড় ঝুলিয়ে দরজা ও জানালার ছিদ্র বন্ধ করে রেকর্ডিং স্টুডিও ছিল। সেখানে ছিল দুটি ভাঙা টেপরেকর্ডার। দুটি কক্ষে প্রায় ৭০ জন করে রাত যাপন করতেন, টয়লেট ছিল দুটি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম শিল্পী সংস্থার সদস্য এবং রূপান্তরের গান এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক বলেন, বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁদের ডাকা হতো, ৮ থেকে ১০টি করে গান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে দলীয় সংগীত রেকর্ড করার জন্য। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গান ছিল ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’, ‘সুখহীন নিশিদিন’, ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট, ’ ‘ঔ পোহাইল তিমির রাতি ’, ‘পাক পশুদের মারতে হবে’, ‘চলো রে নাও বাইয়া’ ইত্যাদি। বেশ কয়েকবার মাহমুদুর রহমান বেণুর নেতৃত্বে শিলা মোমেন, শর্মিলা দাস, শাহীন সামাদ, মিলিয়া গুনী, জিয়াউদ্দিন তারিক আলী, ডালিয়া নওশীন, মোশাদ আলী, বিপুল ভট্টাচার্য, স্বপন চৌধুরী, শারমীন মুর্শীদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যেতেন গান রেকর্ড করার জন্য। সেই§স্মৃতিগুলো তিনি এখনো মনে করে আবেগতাড়িত হন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ৫১ বছরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে যাঁদের কথা না বললেই নয়, যাঁরা ছিলেন প্রথম ১০ জন প্রতিষ্ঠাতা কর্মী। তাঁরা হলেন বেলাল মোহাম্মদ (দলনেতা, পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠান সংগঠক), আবুল কাশেম সন্দ্বীপ (প্রথম কণ্ঠ, পরবর্তী সময়ে সাব-এডিটর বার্তা), সৈয়দ আবদুস শাকের (প্রকৌশলী), আবদুল্লাহ আল ফারুক (অনুষ্ঠান প্রযোজক), আমিনুর রহমান, রাশেদুল হাসান, শারফুজ্জামান, রেজাউল করিম চৌধুরী (সবাই প্রকৌশলী সহযোগী), মোস্তফা আনোয়ার (নাটক) ও কাজী হাবিবউদ্দিন (অনুষ্ঠান সচিব)। এই ১০ জন ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উদ্যোক্তা এবং প্রাণ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নীতিনির্ধারণ, মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা, অর্থ সংগ্রহ, কর্মচারী নিয়োগ ইত্যাদির দায়িত্ব পালন করতেন তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য কামরুল হাসান, মুজিবনগরের সরকারের তথ্যসচিব আনোয়ারুল হক খান এবং তথ্য ও প্রচার বিভাগের পরিচালক এম আর আখতার।
এ কেন্দ্র দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ বেতার’। এ বেতার কেন্দ্র আনুষ্ঠানিকভাবে সম্প্রচার শুরু করে ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর থেকে। তবে ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরপরই ঢাকা রেডিও স্টেশনের কর্মীরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের গান ও কথিকা প্রচার করে। ২৫ মে স্বাধীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় ফ্রন্ট স্বাধীন বাংলাদেশের বেতার কেন্দ্রের ৫১ বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। এ পূর্তিতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব কলাকুশলীকে অবনতমস্তকে শ্রদ্ধা জানাই।
তথ্যসূত্রঃ
মুকুল, এম আর (১৯৮৫), আমি বিজয় দেখেছি, অনন্যা প্রকাশনী: ঢাকা।
চৌধুরী, আবদুল গাফ্ফার (২০১৭), ইতিহাসের রক্ত পলাশ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর, আগামী প্রকাশনী: ঢাকা।
প্রধান, জাহিদ হোসেন, সম্পাদিত, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইতিহাস, ইত্যাদি প্রকাশনা।
বেতার প্রকাশনা দপ্তর (বেতার বাংলা), ২০২১, সুবর্ণ বিজয়ে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা, ২০২১।
রুমী, জালাল উদ্দিন, (২০০৬), এই আমি সেই আমি, বিশ্ব সাহিত্য ভবন: ঢাকা।
শব্দসৈনিক অধ্যাপক ড. নাসরিন আহমাদের সাক্ষাৎকার, ১০. ০৩.২০২২।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী এনামুল হকের সাক্ষাৎকার, ১০.০৫.২০২২
একাত্তরের কলমসৈনিক কবি ও নাট্যকার মু. জালাল উদ্দিন নলুয়ার ১৯৭১-এর দিনলিপি।
পুনশ্চ: লেখাটি ঈষৎ সংক্ষেপিত
লেখকঃ অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়