1390
Published on এপ্রিল 17, 2022এম. নজরুল ইসলাম:
১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় দিন। এইদিনে বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথগ্রহণ করে। সংক্ষিপ্ত এই অনুষ্ঠানে দেশী-বিদেশী শতাধিক সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে যুদ্ধকালীন এই সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে থাকা জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলাম গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন।
বৈদ্যনাথতলাকে মুজিবনগর নামকরণ করেন তাজউদ্দীন আহমদ। এই ঐতিহাসিক কর্মকা-ে সহায়তা করেছিলেন স্থানীয় একটি গির্জার কর্মীরা। যেখানে দর্শকরা বসেছিলেন বসার সেই বেঞ্চও গির্জা থেকে আনা হয়েছিল। সেদিন শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষ হয়েছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে। শপথবাক্য পাঠের সময় উড়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। সংক্ষিপ্ত অথচ এই ঐতিহাসিক কর্মসূচী চলাকালীন অনুষ্ঠানস্থলের নিরাপত্তার বিধান করেছিল স্থানীয় জনগণ ও গোলক মজুমদারের নির্দেশে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী।
মুজিবনগরের আম্রকাননে উপস্থিত অনেকের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় সেদিন সকাল ১১টা ১০ মিনিটে দলের শীর্ষ নেতারা দৃপ্ত পদক্ষেপে মঞ্চের দিকে এলে দেশ স্বাধীন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সমবেত সংগ্রামী জনতা ‘জয় বাংলা’ জয়ধ্বনি দেয়। মুজিবনগরে শপথ অনুষ্ঠানস্থলে একটি ছোট্ট মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছিল। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথমে মঞ্চে আরোহণ করেন। ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সশস্ত্র দল ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধানকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করে। এরপর মঞ্চে আসেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী। উপস্থিত স্বেচ্ছাসেবকরা ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে নেতাদের বরণ করে নেয়।
সরকারের মুখপত্র ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদকম-লীর সভাপতি আবদুল মান্নান এমসিএর উপস্থাপনায় শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রথমেই নতুন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক দলিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন চীফ হুইপ অধ্যাপক মোঃ ইউসুফ আলী। অনুষ্ঠানের সূচনায় পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরান তেলাওয়াত, গিতা ও বাইবেল থেকে পাঠ করা হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা মায়ের চার বীর সন্তান প্রাণ ঢেলে গাইলেন জাতীয় সঙ্গীত- ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। উপস্থিত সবাই তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলালেন। অপূর্ব এক ভাবগম্ভীর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ইংরেজীতে প্রদত্ত ভাষণের শুরুতে বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমি তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করেছি এবং তার পরামর্শক্রমে আরও তিনজনকে মন্ত্রীরূপে নিয়োগ করেছি।’ এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর ঘোষণা করেন প্রধান সেনাপতি পদে কর্নেল ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ পদে কর্নেল আবদুর রবের নাম।
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার আবেগময় ভাষণের শেষে দৃপ্তকণ্ঠে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণনন্দিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দী। তাঁর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়ী হবেই।’ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পর তাজউদ্দীন আহমদ অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয় বক্তৃতায় বলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন।’ মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বক্তৃতার শেষে তিনি বলেন, ‘আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছোট-বড় জাতির বন্ধুত্ব। বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম। বিশ্বের আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশি দাবিদার হতে পারে না। কেননা আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি, অধিকতর সংগ্রাম করেনি। জয় বাংলা।’
একটি সরকার সম্পূর্ণ বৈধতা পায় যখন সেই সরকার সংবিধান অনুযায়ী শপথ গ্রহণ করে। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই তৎকালীন বাস্তবতায় যা বলার প্রয়োজন ছিল তা-ই বলেছেন। শীর্ষ দুই নেতার এই দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ ছিল ঐতিহাসিক এবং অনন্য। পাবনার জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান, মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, রাজনৈতিক নেতা, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিকসহ আরও অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
মুজিবনগর সরকারের যোগ্য নেতৃত্ব, সঠিক দিকনির্দেশনা ও রণকৌশল মুক্তিযুদ্ধকে সফল পরিসমাপ্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাসহ বিশ্ব দরবারে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি, শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশবাসীর পাশে দাঁড়ানোসহ মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার পরিচালনায় এ সরকার সার্বিক দায়িত্ব পালন করে।
এর আগে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল সমবেত জনপ্রতিনিধিরা সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি মন্ত্রিসভা গঠন করে। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও তাঁর অবর্তমানে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। গণপরিষদ সদস্য কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। একই সঙ্গে কী প্রেক্ষাপটে এই সরকার গঠন করা হয় তা ব্যাখ্যা করতে একটি প্রস্তাবনা প্রস্তুত করা হয়। সরকার গঠনের এই সংবাদটি ভারতের আকাশবাণী থেকে প্রচার করা হলেও সে সম্পর্কে খুব বেশি মানুষ জানতে পারেনি।
তখন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাদের কোন কমান্ড কাঠামো না থাকায় যুদ্ধ চালাতে বেশ অসুবিধাই হচ্ছিল। বিশ্ববাসীর কাছে এটি প্রমাণ করার প্রয়োজন ছিল যে, বাংলাদেশে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা একটি বৈধ সরকার গঠন করেছে। কারণ সেই সময় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া অন্য কারও সরকার গঠন করার সুযোগ ছিল না।
জনপ্রতিনিধিদের ইচ্ছার শতভাগ প্রতিফলন ঘটিয়ে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রেখে, রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করে সেদিন রাষ্ট্র ও সরকার গঠিত হয়েছিল। আর এ সবকিছুর বৈধ ভিত্তি ছিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’। পরে ৩০ লক্ষাধিক মানুষের রক্তস্নাত আত্মদান ও তিন লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সার্বিক সাফল্য নিশ্চিত হয়েছিল এই দিনটিতেই। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তথা ১৯৭১ সালের এপ্রিলের ১০ ও ১৭ তারিখে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল সাংবিধানিকভাবে রাজনৈতিক বৈধতা নিশ্চিত করে মুক্তিযুদ্ধ তথা জনযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে সুমহান বিজয় ছিনিয়ে আনা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই দিনের গুরুত্ব অপরিসীম।
লেখক: সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী