4893
Published on মার্চ 23, 2024১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। ফলে বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রাম বেগবান হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার চূড়ান্ত নির্দেশনা দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২৩ মার্চ ধানমন্ডির নিজ বাসভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র-খচিত পতাকা উত্তোলন করেন তিনি। দেশজুড়ে উড়তে থাকে লাল-সবুজ পতাকা। এরমধ্যেই বাঙালি জাতির ওপর গণহত্যা চালানোর নির্দেশ দিয়ে, ২৫ মার্চ পাকিস্তানি জান্তাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে।
ইয়াহিয়া খান চেয়েছিল, অপারেশন সার্চলাইটের নামে এক বীভৎস গণহত্যা চালাতে, যাতে বাঙালি জাতি আর কোনো দিন স্বাধীনতার কথা মুখেও না আনে। বেলুচিস্তানে গণহত্যা চালানো টিক্কা খানকে তাই বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশে ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টার দিকে অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর হামলে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা।
তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক জানান, ''২৫ মার্চ দুপুরে মেজর জেনারেল খাদিম হুসেইনকে ফোন করে টিক্কা খান। সরাসরি জানায় ''খাদিম, আজই করতে হবে কাজটা। 'খাদিম এই নির্দেশের জন্যেই অপেক্ষাই করছিল। সঙ্গে সঙ্গে নিজের কর্মচারীদের ওই আদেশ পালনের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেয় সে।''
উইটনেস টু সারেন্ডার বইতে সিদ্দিক সালিক আরো লিখেছেন, "ক্র্যাকডাউনের সময় ঠিক করা হয়েছিল ২৬ মার্চ রাত ১টায়। কিন্তু ২৫ মার্চ সন্ধ্যার পর একজন কমান্ডার টিক্কা খানকে ক্র্যাকডাউনের সময় এগিয়ে আনার পরামর্শ দেয়। এরপর রাত সাড়ে ১১টায় পুরো শহরে হামলা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী।"
নিজস্ব সূত্রে বঙ্গবন্ধুও পাকিস্তানিদের এই পরিকল্পনা খবর জানতে পারেন। ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে টেলিফোনে সারা দেশে যুদ্ধের প্রস্তুতির নির্দেশনা দেন তিনি। সেদিনের ঘটনার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর সহকারী সাক্ষাৎকারে জানান, "পঁচিশ তারিখ সন্ধ্যার দিকে আমরা রিপোর্ট পাওয়া শুরু করলাম যে, সব ট্যাংক ক্যান্টনমেন্টে লাইন আপ করা হচ্ছে, আক্রমণ করার প্রস্তুতি চলছে। আমরা এটা বঙ্গবন্ধুকে রিপোর্ট করলাম। এরপর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছিল খুবই সুস্পষ্ট। তিনি বললেন- যে মুহূর্তে তারা আক্রমণ শুরু করবে, সেই মুহূর্ত থেকে আমরা স্বাধীন।'
বিচ্ছিন্নতাবাদের ফাঁদে না পড়ার জন্য আগবাড়িয়ে আক্রমণে যাননি বঙ্গবন্ধু। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণে যাওয়ার পরপরই ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তিনি। ওয়্যারলেসের বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে সম্প্রচার করা হয় বঙ্গবন্ধুর সেই স্বাধীনতার ঘোষণা, যা চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্থানকারী বিদেশি জাহাজগুলোর ওয়্যারলেস এবং পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের ওয়্যারলেস থেকে স্পষ্ট শোনা যায়।
বঙ্গবন্ধুর কন্ঠেই স্বাধীনতার ঘোষণাটি এম ভি সালভিস্তা, এম ভি মিনি লা ট্রিয়া, এম ভি ভি ভি গিরিসহ আরো বেশ কয়েকটি জাহাজের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করা হয়। এরপরেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানি সেনারা। কসাই টিক্কা খান পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে এবং সিদ্দিক সালিক তার বইতেও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা নিজের কানে শোনার কথা উল্লেখ করেছেন।
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার পর চট্টগ্রাম থেকে সম্প্রচার শুরু করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এর অন্যতম সংগঠক বেলাল মোহম্মদ জানান, ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সেই ঘোষণা প্রথম সম্প্রচার করা হয়। বেতারে বঙ্গবন্ধুর নামে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান। এছাড়াও ২৬ মার্চ সকাল থেকে বিভিন্ন এলাকায় মাইকিংয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাটি ছড়িয়ে দেওয়া হয়। দুপুরের মধ্যে ঘোষণাটি বাংলায় অনুবাদ করে লিফলেট আকারে বিলি করা হয়েছে। এমনকি বেতারের কর্মীরাও নিজ কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি সম্প্রচার করতে থাকে। ২৭শে মার্চ সন্ধ্যার পর বঙ্গবন্ধুর নামে আবারো ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন মেজর জিয়া।
১৯৭১ সালের ২৬ ও ২৭ মার্চের আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিশ্বের কমপক্ষে ২৫টি দেশের পত্রপত্রিকায় বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ২৬ মার্চ রাতে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি, এনডিপি ও পিটিআই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ প্রচার করে। ইউনাইটেড নিউজ অব ইন্ডিয়ার সংবাদে বলা হয়: স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।
এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স ইনটেলিজেন্স এজেন্সি (ডিআইএ)-এর স্পট রিপোর্টে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছেপাকিস্তানের পূর্ব অংশকে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমস-এর খবরে বলা হয়, 'স্বাধীনতা ঘোষণার পরই শেখ মুজিব আটক।' বার্তা সংস্থা এপি জানায়- ইয়াহিয়া খান পুনরায় মার্শাল-ল দেওয়ার এবং আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয়েছে।" ব্রিটেনের অন্যতম পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের সংবাদে বলা হয়, গ্রেফতার হওয়ার আগে মুজিব তার দেশের মানুষের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।
দ্য ডেইলি টাইমস-এর সংবাদে বলা হয়েছে, বীরোচিতভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের জবাব দিয়েছেন বাঙালি জাতির সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলেছেন, 'আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।'
ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারে ব্রিটেনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক ডেভিড লোশাক লিখেছেন, '...শব্দ খুব ক্ষীণ ছিল। খুব সম্ভবত, ঘোষণাটি আগেই রেকর্ড করা ছিল।'
১৯৭১ সালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এডওয়ার্ড হিথ। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি এ বিষয়ে বলেন, '১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন। ইউরোপের জেনারেলরা মনে করে যে, শেখ মুজিব জীবিত থাকুন বা না থাকুন, পাকিস্তানিরা আর বাঙালি জাতিকে সম্পূর্ণ পরাজিত করতে সমর্থ হবে না।'
মূলত- সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১-এর মার্চের শুরু থেকেই জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করেন। তখন থেকেই পাকিস্তান সরকারের বদলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে শুরু করে বাংলাদেশ। ২৬ মার্চ তিনি চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে, আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের বুকে স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় বাঙালি জাতি।