4152
Published on মার্চ 23, 2023সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং ত্রিকালদর্শী পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবনের পুরোটাই ব্যয় করেছেন বাঙালি জাতির মুক্তির লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য। প্রায় দুই যুগ ধরে বিভিন্ন অধিকার আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি ঘুমন্ত বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তুলেছেন এবং ক্রমেই আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছেন। ২৬ মার্চ সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার আগে, ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে জাতিকে সর্বশেষ জাগরণী বার্তা দিয়েছেন তিনি। এদিন থেকেই মূলক পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ফেলে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা ওড়াতে থাকে বাঙালি জাতি।
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর আগে, ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চূড়ান্ত যুদ্ধের রণকৌশল ঘোষণা করেন তিনি। তারপর থেকে জাতির পিতার নির্দেশনা অনুসারে দেশজুড়ে যেমন একদিকে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল, তেমনি অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটির মাধ্যমে চূড়ান্ত যুদ্ধের রণপ্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছিলো। ঠিক এরকম একটি অগ্নিগর্ভ সময়ে ঢাকায় আসে পাকিস্তানের জান্তা-প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও ১৯৭০ এর নির্বাচনে পরাজিত পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। তাদের উপস্থিতিতেই ২৩ মার্চ 'পাকিস্তান দিবস'কে 'প্রতিরোধ দিবস' ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু।
২৩ মার্চ সকালে হাজার হাজার জনতার সামনে নিজ হাতে লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলন করেন বঙ্গবন্ধু। এরপর উপস্থিত জনতা সম্মিলিত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে 'জয় বাংলা, বাংলার জয়' গানটি। সামরিক কায়দায় জাতীয় পতাকাকে অভিবাদন জানায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী।
পতাকা উত্তোলন শেষে জনতার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, '৭ কোটি মানুষের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে। সংগ্রাম চলছে, সংগ্রাম চলবে। বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত। ঐক্যবদ্ধ হও। প্রস্তুত হও। বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না ইনশাআল্লাহ্...জয় বাংলা।' ভাষণ শেষে বঙ্গবন্ধু নিজে স্লোগান ধরেন, 'আমার দেশ তোমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ। জাগো জাগো, বাঙালি জাগো।'
সকালে বঙ্গবন্ধুর হাত দিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের খবর ছড়িয়ে পড়ে শহরে। এরপর প্রতিটি ঘরে ঘরে মানুষ উত্তোলন করে মানুষ লাল-সবুজের মধ্যে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত জয় বাংলার পতাকা। 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' মিছিলে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ঢাকা।
পাকিস্তানের নিশানা মুছে দিয়ে উড়তে শুরু করে স্বাধীন বাংলার পতাকা
১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পত্রিকাগুলো থেকে জানা যায়- ২৩ মার্চ কড়া পাহারায় প্রেসিডেন্ট ভবন, গভর্নর হাউস ও সেনানিবাস ছাড়া কোথাও পাকিস্তানের পতাকা দেখা যায়নি। এমনকি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঢাকার সচিবালয়, হাইকোর্ট, গণপরিষদ, ইপিআর, রাজারবাগ পুলিশ সদর দফতর, ঢাকা বেতার, টেলিভিশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রধান বিচারপতি ও মুখ্য সচিবের বাসভবনসহ সব সরকারি-বেসরকারি ভবন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলা হয় এদিন। ওই সময় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থান করছিল জুলফিকার আলী ভুট্টো। ওই হোটেলেও সেদিন স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়াতে বাধ্য করে বীর জনতা।
ঢাকায় বিভিন্ন দেশের কনসুলেট ভবনেও এদিন স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ে। যুক্তরাজ্যের ডেপুটি হাই কমিশন ও সোভিয়েত কনসুলেটে সকাল থেকেই স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছিল। চীন, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল নিজেদের পতাকার পাশে শুরুতে অন্যান্য দিনের মতো পাকিস্তানের পতাকা ওড়ালেও, পরবর্তীতে জনদাবির মুখে তা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলে।
২৩ মার্চের ব্যাপারে শহীদ জননী জাহানা ইমাম তার 'একাত্তরের দিনগুলি' গ্রন্থে জানান, 'আজ প্রতিরোধ দিবস। খুব সকালে বাড়িসুদ্ধ সবাই মিলে ছাদে গিয়ে কালো পতাকার পাশে আরেকটা বাঁশে ওড়ালাম স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন পতাকা। বুকের মধ্যে শিরশির করে উঠল।'
গণমাধ্যমে দেওয়া তৎকালীন ছাত্রনেতাদের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়- বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এদিন সাধারণ ছুটি পালিত হয় বাংলাদেশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলার পর প্রভাতফেরি বের করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এরপর পল্টন ময়দানে 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' সংগীত পরিবেশন ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। বঙ্গবন্ধুর প্রতিনিধি হিসেবে জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজের মাধ্যমে জনতার অভিবাদন গ্রহণ করেন ছাত্রনেতারা। পুরো ঢাকা যেনো পতাকার নগরীতে পরিণত হয়। এমনকি পত্রিকায় পতাকার ডিজাইন দেখে সাধারণ মানুষ নিজেরাই পতাকা তৈরি করে বাড়ির ছাদে ছাদে তা ওড়ায়। রাজধানীর পাশাপাশি দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত শুধু স্বাধীন বাংলার পতাকাই উড়তে দেখা গেছে সেদিন। রাজপথ, ভবন, গাছের চূড়া ও লাঠি-বর্শা-বন্দুকের মাথায় পতাকা উড়িয়ে মিছিলে মিছিলে গর্জে উঠেছে বীর বাঙালি।
পল্টনের কর্মসূচি শেষে জনতার ঢল বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির সামনে ভিড় করে। এসময় বঙ্গবন্ধু একহাতে পতাকা নিয়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়ান। জনতার উদ্দেশে বলেন, 'বাংলার মানুষ কারও করুণার পাত্র নয়। আপন শক্তির দুর্জয় ক্ষমতাবলেই তারা স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনবে।'
জাতীয় পতাকা উত্তোলনই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণার পূর্ব সংকেত
এরপর, আলোচনা পরিহার করে ২৫ মার্চ বিকালে সিভিল পোশাকে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে জান্তা-প্রধান ও পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া। যাওয়ার আগে ঢাকায় গণহত্যা চালানোর নির্দেশ দেয় সে। আর সেই গণহত্যা নিজ চোখে পর্যবেক্ষণের জন্য ঢাকায় থেকে যায় জুলফিকার আলী ভুট্টো। ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানে পাকিস্তানি সৈন্যরা। তবে পাকিস্তানিদের এই পরিকল্পনার তথ্য একাধিক সূত্রে আগেই জানতে পারেন বঙ্গবন্ধু। এরপর তিনি শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের নিরপদ আশ্রয়ে গিয়ে যুদ্ধ পরিচালনার নির্দেশ দেন। আগে আক্রমণে গিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীতার অভিযোগে বাঙালি জাতিকে বিশ্বের বুকে দায়ী করতে চাননি তিনি। সবাইকে বিদায় জানিয়ে নিজে থেকে যান ধানমন্ডির বাড়িতেই।
তবে সন্ধ্যার পর থেকেই বঙ্গবন্ধুর বাসার টেলিফোন থেকে বিভিন্ন স্থানে ফোন দিয়ে যুদ্ধের জন্য নির্দেশনা দেন তিনি এবং তার সহচররা। তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ড. কামাল হোসেনদের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'যখনই পাকিস্তানিরা আক্রমণ শুরু করবে, তখন থেকেই আমরা স্বাধীন। ড. কামাল বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই রাতের প্রসঙ্গে জানান, বঙ্গবন্ধু সবাইকে বিদায় দিয়ে নিজে থেকে যান। কারণ তাকে না পেলে পাকিস্তানিরা পুরো ঢাকা শহর ধ্বংস করে ফেলতো। ওই রাতেই মরতে হতো লাখ লাখ মানুষকে।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা হামলার পরপরই, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে অয়্যারলেসের বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে সম্প্রচারিত হয় সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা। বেলুচিস্তানের কসাইখ্যাত জেনারেল টিক্কা খানের এক সৈন্য সেই ঘোষণা শুনে সরাসরি টিক্কার কাছে যায়। টিক্কা খান ওই কণ্ঠকে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ বলেই নিশ্চিত করে এবং এরপরেই তাকে গ্রেফতার করে। ততক্ষণে চট্টগ্রাম বন্দরে থাকা বিদেশি সব জাহাজের অয়্যারলেসের মাধ্যমে এই ঘোষণার কথা জানতে ইউরোপ-আমেরিকার রাষ্ট্রগুলো।
২৬ মার্চ সকালে ঢাকার ধ্বংসস্তূপ দেখার পর পাকিস্তানের উদ্দেশে রওনা দেয় জুলফিকার আলী ভুট্টো। কিন্তু ততক্ষণে আন্তর্জাতিক সব গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সংবাদ। দেশব্যাপী প্রতিরোধে নেমে পড়ে বীর বাঙালি। 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' স্লোগানের মাধ্যমে শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি পরাজিত জেনারেলদের সাক্ষাৎকার ও আত্মজীবনী, ২৬ ও ২৭ মার্চের ইউরোপ-আমেরিকার প্রধান পত্রিকাগুলোয় প্রকাশিত সংবাদ, মার্কিন গোপন নথি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের লেখা গ্রন্থ, সাক্ষাৎকার ও স্মৃতিচারণ থেকে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঘটনাবলী সংগ্রহ করা হয়েছে।