মহামানবের জন্ম ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা

992

Published on মার্চ 17, 2022
  • Details Image

ড. প্রণব কুমার পান্ডে:  
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে অপরিসীম তাৎপর্য বহন করে। কারণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দিন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আমাদের সবার উচিত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের উৎপত্তির ইতিহাসের আলোকে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত হিসেবে তার জন্মের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া।

সত্যই, বঙ্গবন্ধু না জন্মালে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় অনেক বছর পিছিয়ে যেত। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অস্তিত্ব যত দিন অব্যাহত থাকবে আমাদের দেশের নাগরিকদের তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে এবং তার অবদানকে স্বীকৃতি দিতে হবে। তার চিন্তাশীল এবং বাস্তববাদী নেতৃত্বের কারণেই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন বাস্তবে সম্ভব হয়েছিল। সুতরাং বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশ থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়, কারণ তিনি আমাদের ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রয়েছেন।

এখন প্রশ্ন হলো বঙ্গবন্ধু কীভাবে টুঙ্গিপাড়ার ‘খোকা’ থেকে ‘জাতির পিতা’ হয়েছিলেন? ‘জাতির পিতা’ উপাধি কেবল তখনই প্রদান করা হয় যখন রাষ্ট্র গঠনের লড়াইয়ে কোনো ব্যক্তির অবদান ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচিত হয়। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই নেতাদের ভূমিকা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়। সুতরাং বাংলাদেশী রাষ্ট্র গঠনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা যাচাই করা সহজ নয়, কারণ তিনি অন্যের তুলনায় অতুলনীয়।

বঙ্গবন্ধু তার গৌরবময় নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে সমগ্র জাতিকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করেছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে এবং বাংলাদেশ গঠনে তার অবদান ও ত্যাগের স্বীকৃতি হিসেবে, রাশিয়ার পিটার-১, চীনের সান ইয়াত-সেন, অস্ট্রেলিয়ার স্যার হেনরি পার্কস, ভারতের মহাত্মা গান্ধী এবং তুরস্কের মোস্তফা কামালসহ অন্যান্য বিশ্ব নেতার মতো, যারা তাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন ত্যাগ করেছিলেন, বাংলাদেশের জনগণ বঙ্গবন্ধুকে সম্মানসূচক ‘জাতির জনক’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল।

তিনি তার যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালিত করেছিলেন। তিনি একজন সত্যিকারের দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ছিলেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হয়ে, ১৯৬২ সালের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ১৯৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন পথ পরিক্রমা শেষে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। বঙ্গবন্ধু প্রতিটি আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি তার সব ব্যক্তিগত সুখ ত্যাগ করে জাতির নৌকার হাল ধরে ছিলেন শক্তভাবে। তার নিষ্ঠা লাখ লাখ বাংলাদেশিকে তার দর্শনকে হৃদয়ে ধারণ করতে উৎসাহিত করেছিল।

বঙ্গবন্ধুর আগে অনেক রাজনৈতিক নেতা হয়তো স্বাধীন রাষ্ট্রের বাসিন্দা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। গত শতাব্দীর প্রথমদিকে, বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদ একটি স্বাধীন জাতি সম্পর্কে কথা বলতে পারেন। তবে, এই নেতারা স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং মানুষকে স্বাধীনতার লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারেনি। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সামনে তারা স্বাধীনতা অর্জনের সর্বাত্মক কৌশল প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে স্বাধীনতার জন্য একটি বিস্তৃত রোডম্যাপ উপস্থাপন করেছিলেন, যা দেশবাসীকে নিরলসভাবে মুক্তিযুদ্ধের দিকে চালিত হতে উৎসাহিত করেছিল। সে কারণেই, বাংলাদেশ ও বাঙালিকে নিয়ে যে কোনো আলোচনায় বঙ্গবন্ধুর নাম সবার আগে উঠে আসে কারণ তার নামটি দেশ গঠনের ইতিহাসের সাথে একীভূত হয়ে রয়েছে।

স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবদানের মহাকর্ষ বিবেচনা করে, ব্রিটিশ মানবতাবাদী আন্দোলনের প্রবর্তক লর্ড ফেনার ব্রোকওয়ে বলেছিলেন: ‘এক অর্থে শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী এবং ডি ভ্যালেরা এর চেয়ে বড় নেতা।’ এভাবে বঙ্গবন্ধুর অবদান তাকে বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্ব নেতায় পরিণত করেছিল।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ সরকারের অনুপস্থিতিতে বেশ কয়েকটি সরকার বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নামকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু উভয়ই অবিচ্ছেদ্য হওয়ায় তারা তাদের প্রচেষ্টায় সফলতা অর্জন করতে পারেনি। তাই আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবের অন্যতম শক্তিশালী সমালোচক ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ একবার তার একটি লেখায় লিখেছিলেন যে ‘শেখ মুজিবের উপস্থিতি বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের বৃহত্তম ঘটনা ছিল। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার দাফন হয়নি। শেখ মুজিবের চেয়ে আরও বাস্তববাদী, দক্ষ, সক্ষম ও গতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়তো আবির্ভূত হতে পারে বা উদ্ভব হতে পারে। তবে, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া চ্যালেঞ্জিং হবে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এবং এর জাতীয় পরিচয় তৈরিতে আরও বেশি অবদান রেখেছে।’

প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক নেতার এই উপলব্ধি আমাদের বিশ্বাস করতে সাহায্য করে যে বঙ্গবন্ধু তার সব জীবনে বাঙালির মঙ্গল নিশ্চিতকরণের লক্ষে কাজ করেছেন। তার চূড়ান্ত লক্ষ্যগুলো অর্জন করার পথে তিনি কখনও অন্যদের সাথে সমঝোতা করেননি। তাই বাংলাদেশের নাগরিকরা তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ এবং ‘জাতির জনক’র সম্মান দিয়েছে।

আমাদের জীবনের বিভিন্ন স্তরে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে ধন্যবাদ জানানো উচিত। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্তেরও আমাদের প্রশংসা করা উচিত। এই দিবস উদযাপনের মৌলিক লক্ষ্য হলো দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তার দর্শন অনুসরণ করতে উৎসাহিত করা। আমাদের তরুণ প্রজন্ম যদি তার আদর্শ থেকে উপকৃত হয় তবে তারা উন্নত নাগরিকদের মতো জাতিকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে।

দেশের তরুণ প্রজন্ম ও প্রগতিশীল জনগণের জাতির পিতার জীবন সংগ্রামের ঘটনাপ্রবাহ থেকে অনুপ্রেরণা অর্জন করা প্রয়োজন। কেউ যদি তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’টি পড়েন, তাহলে বুঝতে পারবেন যে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তার কি অকৃত্রিম ভালোবাসা ছিল। তিনি তার জীবনের বেশিরভাগ সময় জনগণ এবং স্বাধীনতার জন্য কারাগারে কাটিয়েছেন। পাকিস্তানপন্থিরা বঙ্গবন্ধুকে তার কাঙ্ক্ষিত ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠা করতে দেয়নি। ঘাতকের বুলেটের আঘাতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে যে পরিবর্তনই হোক না কেন, তা হয়েছে তার কন্যা শেখ হাসিনার কারণে। ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তার পিতার অসম্পূর্ণ এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি যেভাবে কাজ করছেন, আমরা বলতে পারি যে সেদিন খুব বেশি দূরে নয় যখন আমরা বলব যে আমরা ‘সোনার বাংলার’ নাগরিক।

এদিকে, আমরা যখন এই মহান নেতার জন্ম শতবার্ষিকী এবং আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি তখন আমরা উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের সিডিপির সুপারিশ পেয়েছি। ২০৩১ সালের মধ্যে আমাদের দেশ উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে। শেখ হাসিনার নিরলস প্রচেষ্টার ফলে এ জাতীয় অর্জন সম্ভব হয়েছে।

শেখ মুজিবুর রহমান ব্যক্তিকে অতিক্রম করে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। অতএব, আমাদের তার মহিমাকে একটি নির্দিষ্ট ফ্রেম এবং গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করা উচিত নয়। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুকে নির্দিষ্ট ফ্রেমে সীমাবদ্ধ না রাখতে প্রেরণা জোগাবে। তার শারীরিক মৃত্যু তার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হতে আমাদের বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।
সৌজন্যেঃ  jagonews24.com

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত