2336
Published on মার্চ 2, 2022বিভুরঞ্জন সরকারঃ
বাঙালির জাতীয় জীবনে কয়েকটি মাস বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়।ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস, মার্চ স্বাধীনতার মাস, আগস্ট শোকের মাস, ডিসেম্বর গণঅভ্যুত্থান ও বিজয়ের মাস। ফেব্রুয়ারি এলে ১৯৫২ সালের কথা মনে পড়ে। মার্চ এলে ১৯৭১ সালের কথা মনে পড়ে। আগস্ট এলে চোখ ভিজে আসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভয়াল স্মৃতি মনে করে। ডিসেম্বরে মনে হয় ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১-এর বিজয়ের কথা।
১৯৭১-এর মার্চ মানেই উত্তাল ও বিক্ষুব্ধ এক সময়। মার্চ আমাদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, সাহস ও আত্মত্যাগের গৌরবগাথা রচনার মাস। অগ্নিঝরা মার্চ আমাদের জীবনে আর আসবে না। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করবে, সেটা সম্ভবত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হিসেবে ছিল না। বাঙালি যে শেখ মুজিবকেই তাদের নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছে, তার সাহস ও অনমনীয় দৃঢ়তা যে বাঙালিকে জাদুর পরশ বুলিয়ে মোহগ্রস্ত করেছে সেটা পরিষ্কার হয় নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর। আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ে আতঙ্কিত হয়ে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কোনোভাবেই বাঙালির হাতে ক্ষমতা ছাড়তে চায়নি। তারা যুক্তির ভাষা বোঝে না, তারা জোরের ভাষায় অভ্যস্ত।
গণতন্ত্র নয়, স্বেচ্ছাচারিতাই ছিল তাদের শক্তি। আওয়ামী লীগের ছয় দফা ছিল তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু যেহেতু নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ,তাই ছয় দফা বাস্তবায়ন হবেই, এটা বুঝতে পেরে ছল খুঁজতে থাকে পাকিস্তানি দুষ্টুদের পালের গোদা ইয়াহিয়া খান এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা।
একাত্তরের ১২ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার দুই দফা আলোচনা হলো। বঙ্গবন্ধু জানিয়েছিলেন, আলোচনা সন্তোষজনক এবং প্রেসিডেন্ট খুব শিগগিরই ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করতে সম্মত হয়েছেন। ইয়াহিয়া খানের বক্তব্যও ঠিক অনুরূপ ছিল। তিনি বললেন, ‘শেখ মুজিব তার সঙ্গে যে কথা বলেছেন, যে আলোচনা তুলেছেন সেসব যৌক্তিক ও সঠিক।’ শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী বলেও উল্লেখ করেন ইয়াহিয়া।
কিন্তু পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে ইয়াহিয়া খান গোপন বৈঠকে মিলিত হলেন লারকানায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাসভবনে। ভুট্টো পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করেছিলেন। ওই গোপন বৈঠকে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকজন জেনারেল উপস্থিত থেকে শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার নীতিগত সিদ্ধান্তে পৌঁছান বলে মনে করা হয়। এরপর তারা যা যা করেছে তা টালবাহানা ছাড়া আর কিছু নয়।
জানুয়ারির শেষ দিকে দলের অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আসেন। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই জাতীয় পরিষদের বৈঠকে ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার কথা বললে ভুট্টো আরও আলোচনার কথা বলে কালক্ষেপণের কৌশল নেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। প্যাচ কষেন ভুট্টো। আওয়ামী লীগ তাদের ৬ দফার বিষয়ে আপস বা পরিবর্তন না করলে ভুট্টো জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের বিরোধিতা করলেন। এরপর ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর মধ্যে আলোচনা হয়েছিল। সেই আলোচনার পর ভুট্টো জানালেন তার দেওয়া শর্ত না মানলে তিনি কোনোভাবেই অধিবেশনে যোগ দেবেন না। বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝলেন ওদের আসল মতলব। পাকিস্তানিরা নির্বাচনের ফল বানচাল করার জোরালো চেষ্টা করছে।
ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো মিলে তাদের আঁকা ছক অনুযায়ী ১ মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলেন ইয়াহিয়া। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হওয়ার ঘোষণা শুনে বাংলাদেশের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা চলছিল। মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যায় খেলা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের অপেক্ষা করেনি কেউ। রাস্তায় নেমে পড়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। এমন তীব্র ক্ষোভ আগে দেখেনি কেউ। বঙ্গবন্ধু তখন আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির সভা করছিলেন হোটেল পূর্বাণীতে, ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছিল সেখানে। বিক্ষোভ মিছিল পূর্বাণীর সামনে এলে জনতার সামনে উপস্থিত হয়ে বঙ্গবন্ধু শান্তিপূর্ণ আন্দোলন জোরদার করার পরামর্শ দিয়ে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারা বাংলায় দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতালের ডাক দেন।
২ মার্চ ইত্তেফাকের প্রধান শিরোনাম ছিল ‘জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত’। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হওয়ার পর সংগ্রামী ছাত্র সমাজের উদ্যোগে ২ মার্চ বিক্ষোভ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণের বটতলায়। বেলা ১১টার দিকে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, ডাকসুর তৎকালীন সহসভাপতি আ স ম আব্দুর রব। ওই সভামঞ্চেই প্রথম ওড়ানো হয়েছিল সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্য, তার ওপর বাংলাদেশের মানচিত্র দিয়ে তৈরি পতাকা। রব ছাড়াও সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছিলেন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখন ও শাহজাহান সিরাজ। পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছিল। সমাবেশ শেষে বের হয়েছিল বিশাল মিছিল। তৎকালীন জিন্নাহ অ্যাভিনিউ তথা বায়তুল মোকাররম পর্যন্ত গিয়ে মিছিল শেষ হয়।
সেদিন দুপুরে ও রাতে যথাক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সচিবালয়ে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়েছিল। রাতে পাকিস্তান রেডিওতে ঢাকায় কারফিউ জারির ঘোষণা এসেছিল। কারফিউ ভঙ্গ করে ছাত্র শ্রমিক জনতা শহরের বহু জায়গায় ‘কারফিউ মানি না’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’সহ নানা স্লোগানে বিক্ষোভ করেছিল। ছাত্র-জনতা কারফিউ ভেঙে গভর্নর হাউজের দিকে যেতে শুরু করলে ডিআইটি মোড় ও মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসের সামনে মিছিলে গুলি চালায় সেনাবাহিনী।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩ মার্চ ১৯৭১ পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভায় স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা শাহজাহান সিরাজ। বঙ্গবন্ধু নিজে তার ধানমন্ডির বাসভবনে বাংলাদেশের নতুন পতাকা উত্তোলন করেছিলেন একাত্তরের বিক্ষুব্ধ ২৩ মার্চ,যেদিন ছিল পাকিস্তান দিবস।
পরবর্তী ঘটনাবলি এখন আমাদের গৌরবের ইতিহাস, সবারই জানা। মার্চের শুরু থেকেই প্রকৃতপক্ষে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসন কার্যত অচল হয়ে পড়ে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে দেন তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং এক ঐতিহাসিক কাব্যিক ভাষণ। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে যার যা আছে তা-ই নিয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ’।
এটা ছিল এক আত্মপ্রত্যয়ী নেতার দৃঢ় অঙ্গীকার। আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি বলে বঙ্গবন্ধু আসলে অনেক কিছুই বলেছিলেন ৭ মার্চ। তারপর শাসকগোষ্ঠী কালক্ষেপণ করেছে। আলোচনার নামে বাঙালি জাতিকে বিভ্রান্ত করার কৌশল নিয়ে ২৫ মার্চ রাতে অতর্কিতে শুরু করেছে বাঙালি নিধনপর্ব। কিন্তু তার আগেই নির্ধারিত হয়ে গেছে ইতিহাসের গতিপথ।
একাত্তরের মার্চ থেকে দুই হাজার বাইশের মার্চ। এই পঞ্চাশ বছরে আমরা অনেক কিছু পেয়েছি। অনেক কিছু অর্জন করেছি। আমরা পেয়েছি এক স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র। আবার হারিয়েছিও বেশ কিছু। আমাদের সমস্যা হলো আমরা বিজয় ধরে রাখতে পারি না, সংহত করতে পারি না। পাওয়ার আনন্দ স্থায়ী হয় না, পেয়ে হারানোর কষ্ট আর না পাওয়ার বেদনা আমাদের পিছু ছাড়ে না। এবার মার্চে আমরা মুক্তিযুদ্ধের যেসব অর্জন তার একটিও যাতে আর বেহাত না হয় তার দৃঢ় অঙ্গীকার করতে হবে। একাত্তরে আমাদের যুদ্ধ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, বৈষম্য ও অনাচারের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও এগুলোর সব আমরা পরিপূর্ণভাবে পাইনি। তাই শপথ হোক,একাত্তরের চেতনা সমুন্নত রেখে আমরা সামনে এগিয়ে যাব।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।
সৌজন্যেঃ সময় নিউজ