701
Published on জানুয়ারি 17, 2022ড. প্রণব কুমার পান্ডে:
আমি যখন এই লেখাটি লিখছি তখন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফল প্রকাশ হচ্ছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী ডাক্তার সেলিনা হায়াৎ আইভী প্রায় ৬৯০০০ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিএনপি থেকে সদ্য বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারকে হারিয়ে তৃতীয় বারের মতো নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হলেন।
বিপুল ভোটের ব্যবধানে আইভীর নির্বাচনে জিতে যাওয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত বিভিন্ন মিডিয়ায় নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ইঙ্গিত দিলেও ভোটের দিন পরিস্থিতি পাল্টে যায়। স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার আশঙ্কা করলেও নির্বাচনের দিনের পরিবেশ ছিল খুবই উৎসবমুখর। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের নির্বাচনের মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং উৎসবমুখর পরিবেশে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
২০১১ সালে যখন প্রথম বারের মতো নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, ঠিক সেই সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেই নির্বাচনকে ঘিরে উত্তেজনা তৈরি করেছিল। সকল উত্তেজনাকে পেছনে ফেলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আইভী সেই নির্বাচনেও বিজয়ী হয়েছিলেন। এই নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে একদিকে যেমন ডাক্তার আইভীর জনপ্রিয়তা প্রমাণ পেলো, ঠিক তেমনি ভাবে আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের আস্থার বিষয়টিও প্রমাণিত হয়েছে।
আমরা সকলেই জানি যে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের দুটি ধারা বিদ্যমান। একটি ধারার নেতৃত্ব দেন ডাক্তার আইভী, অন্য ধারার নেতৃত্ব দেন শামীম ওসমান এবং তার পরিবার। এই দুইটি ধারার মধ্যে অনৈক্যের বিষয়টি সর্বজনবিদিত। ফলে নির্বাচন আসলেই দুটি ধারার মত পার্থক্য এমন একটা অবস্থায় পৌঁছে যায় যেখানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। নির্বাচনের কয়েক দিন আগ পর্যন্ত শামীম ওসমানকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন ধরনের সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে।
অনেকেই বলবার চেষ্টা করছিলেন যে শামীম ওসমান এবং তার সমর্থকরা সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিরুদ্ধে তৈমূর আলম খন্দকারকে সমর্থন করছে। এমনকি আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সামনে এই ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। এ আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতেই নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারাও বিভিন্ন সময় ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে এই ধরনের কোন ঘটনা ঘটলে কেন্দ্র কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের পরে নির্বাচনের ঠিক তিন-চার দিন আগে শামীম ওসমান তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন মিডিয়ার সামনে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে। যদিও এই ধরনের প্রেস কনফারেন্স করা নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের শামিল। তবুও তিনি যে বার্তাটি দেবার চেষ্টা করেছেন সেটি হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের মানুষ আওয়ামী লীগের, বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার সমর্থক। ব্যক্তিগত মত পার্থক্য থাকলেও সেখানে নৌকার বিরুদ্ধে যাওয়া বা ভোট করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
শামীম ওসমান এবং তাঁর অনুসারীদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের আশঙ্কা থাকলেও ভোটের ফলাফলের মাধ্যমে যে বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে তা হল নির্বাচনে সকলেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে ভোট প্রদান করেছেন। যাই হোক নারায়ণগঞ্জে নির্বাচনের দিন উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। উভয় প্রার্থীই নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে তাদের সন্তুষ্টির কথা মিডিয়ার সামনে তুলে ধরেছেন। এমনকি নির্বাচন পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা পর্যবেক্ষক দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু এবং উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
তাছাড়া এই নির্বাচনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ইভিএম এর ব্যবহার। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের সাধারণ ভোটারদের কথা বিবেচনা করলে ইভিএম ব্যবহার কিছুটা সমস্যা তৈরি করতে পারে। এছাড়া নেটওয়ার্ক এর কারণে অনেক সময় সমস্যা তৈরি হয়। তার পরেও ইভিএম এর ব্যবহার এটাই প্রমাণ করেছে যে বাংলাদেশ এখন নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত। ইভিএম এর মাধ্যমে ভোট অনুষ্ঠিত হলে কারচুপির সম্ভাবনা যেমন কমে যায়, তেমনি অল্প সময়ের মধ্যে জনগণ সুষ্ঠুভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সকল বুথে ইভিএম ব্যবহারের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতার বিষয়টি ওঠে এসেছে।
নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতাকে কটাক্ষ করে গত পাঁচ বছর অনেকে বিভিন্ন ধরনের কথা বলেছেন। এমনকি নির্বাচন কমিশনের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং একজন কমিশনের মধ্যে দ্বন্দ্ব মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন প্রমাণ করেছে যে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শুধু নির্বাচন কমিশন দায়ী নয়। নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার দায়িত্ব রয়েছে ভোটারদের এবং রাজনৈতিক দলগুলোর।
আমরা সকলেই জানি যে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বিগত পাঁচ বছর নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। সেই মাহবুব তালুকদার নির্বাচন শেষে মিডিয়ার সামনে বলেছেন যে তাদের দায়িত্ব নেবার পরে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন এবং শেষ পর্যায়ে এসে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সবচেয়ে সুষ্ঠু হয়েছে। তার এই বক্তব্যের মাধ্যমে যে বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে তা হল সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকার কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। নির্বাচন কমিশন চাইলেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। তবে একথা ঠিক যে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সাথে যারা যুক্ত রয়েছেন তাদের দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে জনগণকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। তবেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের মাধ্যমে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে সেটি হল ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ অনেক বেশি শক্তিশালী। বঙ্গবন্ধু যেমন এক সময় জনগণকে সাথে নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ কখনো পরাজিত হবে না। বাংলার মাটিতে এই বার্তাই প্রদান করেছে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। যদিও কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি ছিল দুই পক্ষের মধ্যে, তবে কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে মাধ্যমে এই বিষয়গুলোর সমাধান হয়েছে ভোটের আগেই। তবে একথা ঠিক দুই দুই পক্ষকে নিজেদের আচরণ সংযত করে একে অপরকে সম্মান প্রদর্শন করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে যাতে নারায়ণগঞ্জের পরবর্তী প্রজন্ম ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে।
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন রাজনৈতিক দল। এই দলের সাংগঠনিক কাঠামো প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মতবিরোধ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া প্রায় ১৩ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে দলটি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে বিভিন্ন দল থেকে আসা নেতা-কর্মীদের আওয়ামী লীগের ভিড় জমেছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই নেতা-কর্মীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়। আবার অনেক নেতা-কর্মীরা দলে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করবার জন্য নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীদের দূরে সরিয়ে রাখে।
এই বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব খুব গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে বলেই আমার ধারণা। আর এই কারণেই আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দলীয় সঙ্গতির বিষয়টি সম্পর্কে বারবার কথা বলতে শুনেছি। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটি বড় অংশ যেভাবে নির্বাচন পরিচালনা করেছে তা প্রমাণ করেছে যে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করলে রাজনীতিতে যে কোন অর্জন সম্ভব। তাছাড়া সেলিনা হায়াৎ আইভী গত দশ বছরে যে ভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং নারায়ণগঞ্জকে একটি মডেল সিটি কর্পোরেশন হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন তার এই প্রচেষ্টার উপর আস্থা রেখেছে নারায়ণগঞ্জবাসী।
পরিশেষে যে কথাটি বলতে চাই তা হল রাজনীতিতে দলাদলি থাকবে। এমনকি বিভিন্ন উপদলের মধ্যে মতবিরোধ থাকবে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে রাষ্ট্র। এই বিষয়টি মাথায় রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে কাজ করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তাঁর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তাঁকে অকুণ্ঠ সমর্থন প্রদান করতে হবে। তবেই বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর
সৌজন্যেঃ জাগো নিউজ২৪