2263
Published on জানুয়ারি 4, 2022এনামুল হক শামীম:
বাঙালি জাতির মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষিত উপমহাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। আজ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭৪তম শুভ জন্মদিন। যৌবনের প্রথম প্রেম, প্রেরণার উচ্ছ্বাস, ছাত্রলীগ আমার অহংকার। গৌরবের সংগঠনের শুভ জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করছি ১৯৭৫ সালে ঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে নিহত শহীদদের। শ্রদ্ধা জানাই ছাত্রলীগের সব প্রয়াত নেতাকর্মীকে। শুভেচ্ছা জানাই ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমানের নেতাকর্মীদের। সময়ের প্রয়োজনে জন্ম নেওয়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সময়ের সাহসী সন্তানদের নিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে চলেছে। জন্মলগ্ন থেকেই ভাষার অধিকার, শিক্ষার অধিকার, বাঙালির স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান, সর্বোপরি স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সাত দশকের সবচেয়ে সফল সাহসী সারথি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘শিক্ষা শান্তি প্রগতি’—এই মানবীয় স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ গঠন করেন ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি। প্রজ্ঞাবান জাতির পিতা জানতেন, অক্ষয় মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে হলে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আর ঐক্যবদ্ধ ছাত্রসমাজই পারে মানবীয় দেশ গড়ে তুলতে। তারুণ্যের উচ্ছল প্রাণবন্যায় ভরপুর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা দেশের ইতিহাসকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, লড়াই করেছেন প্রতিটি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে। ঠিক এ কারণেই বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালি জাতির ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস।’
বাংলা ও বাঙালির প্রায় সাড়ে সাত দশকের সংগ্রাম, গৌরব ও সাহসের সারথি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলাদেশের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের গর্বিত অংশীদার এই ছাত্রসংগঠন। জাতির ইতিহাসের প্রায় প্রতিটি অধ্যায়েই রয়েছে ছাত্রলীগের প্রত্যক্ষ ভূমিকা। মেধাবী ও আধুনিকমনা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে দেশে আবারও প্রজ্বলিত হবে ছাত্রলীগের গৌরবগাথা, ছাত্রলীগের ঐতিহ্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা। ছাত্রলীগ মানেই পড়াশোনার পাশাপাশি গভীর দেশপ্রেম, আদর্শবোধ ও ত্যাগের মহিমায় জাতি গঠনে অনন্যসাধারণ ভূমিকা রেখে যাওয়া একটি সাহসী ছাত্রসংগঠন। ছাত্রসমাজের নেতৃত্বদানকারী এই ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠাতালগ্ন থেকেই ছিল গৌরবদীপ্ত ও মহিমান্বিত। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের নেতৃত্ব ছাত্রদের হাতেই তুলে দিয়েছেন।
ছাত্রলীগ শুধু বিরোধী দলেই নয়, মূল দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এবং মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছে। ছাত্রসমাজের ন্যায্য দাবি আদায়ে জোরালো ভূমিকা রেখেছে। হলের সমস্যা নিয়ে আন্দোলনে নেমেছে। যখনই অশুভ শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে, তখনই রাজপথে সক্রিয় ছিল ছাত্রলীগ।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে বাঙালির ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ পরিশ্রমে যুক্তফ্রন্টের বিজয় নিশ্চিত হয়। আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনে ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। ৬ দফা নিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া, ছয় দফাকে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসককে পদত্যাগে বাধ্য করা এবং বন্দিদশা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করাসহ সত্তরের নির্বাচনে ছাত্রলীগ অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখসমরে ছাত্রলীগের অংশগ্রহণ, স্বাধীনতা-পরবর্তী সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রলীগের অসামান্য অবদান দেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠনের নেতাকর্মীরা পরে জাতীয় রাজনীতিতেও নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এখনো দিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমান জাতীয় রাজনীতির অনেক শীর্ষনেতার রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছে ছাত্রলীগ থেকে। তবে সংগঠনটির চলার পথ অনেক ক্ষেত্রে কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই সংগঠনটি বড় ধরনের ভাঙনের মুখে পড়ে। তবে থেমে যায়নি বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া সংগঠন। বরং যাঁরাই ছাত্রলীগ থেকে সরে গেছেন তাঁরাই ক্রমান্বয়ে হারিয়ে গেছেন কালের অতলগহ্বরে। শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির পতাকাবাহী এই সংগঠনটি একটি ইতিহাস।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ একটি সংগঠন হিসেবে দুর্জয়ী কাফেলায় পরিণত হয়েছে। এ জন্য হারাতে হয়েছে অসংখ্য নেতাকর্মীকে। সংগঠনের অসংখ্য শহীদ, অগণিত নেতাকর্মীর জেল-জুলুম-কারাবরণ, নির্যাতন-নিপীড়ন ভোগ, আর নেতাকর্মীদের এক নদী রক্তের বিনিময়ে রচিত হয়েছে এক সফল রক্তাক্ত ইতিহাস ও স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর প্রথমে খুনি মোশতাক সরকার এবং পরে জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার শাসনামলেও জেল-জুলুম-হুলিয়ার শিকার হয়ে অগণিত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে কারাবরণ, দেশত্যাগ, অমানবিক নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে।
ছাত্রলীগ মেধাবী ছাত্রদের সংগঠন। সমাজের সব স্তরেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর বিচরণ রয়েছে। ছাত্রলীগের সাবেক নেতাকর্মীরা তাঁদের নিজস্ব মেধা ও কর্মের মাধ্যমে আজকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে সুপ্রতিষ্ঠিত। আজকে ছাত্রলীগের সাবেক নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দৃঢ়তা, সততা, নিষ্ঠা ও সাহসিকতার সঙ্গে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করছেন বিশ্বনেতারা।
ছাত্রলীগের সাবেক কর্মী হিসেবে বর্তমান নেতাকর্মীদের আহ্বান জানাই, ছাত্রলীগের কাজের দ্বারা যেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি প্রশ্নের সম্মুখীন না হয়। ছাত্রলীগকে সবাই ভালোবাসবে। সবাই পছন্দ করবে। ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কথা বলবে ছাত্রলীগ। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ, মাদকবিরোধী কার্যক্রমে বেশি সক্রিয় হবে ছাত্রলীগ। বিপদে-আপদে ছাত্রদের পাশে দাঁড়াবে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের প্রতি মানুষের ভালোবাসা-শ্রদ্ধা ও আস্থা থাকবে। সে কাজটির দায়িত্বভার বর্তমান ছাত্রলীগকেই নিতে হবে। কারো কর্মকাণ্ডে যেন ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ ইতিহাস, ঐতিহ্য, গৌরব, অহংকার, স্বর্ণালি অতীতের ধারক-বাহক বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগ। আজকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক সব নেতাকর্মীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। সফল ও সার্থক হোক ৭৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক: পানিসম্পদ উপমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও সাবেক জাকসু ভিপি
সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ
(মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)