980
Published on ডিসেম্বর 20, 2021ডা. মামুন আল মাহতাব:
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের স্বাস্থ্যখাতে অন্যতম অর্জন একটি জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন। ২০০০ সালে সর্বশেষ হালনাগাদকৃত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে এই সরকারের মেয়াদকালেই ২০১১ সালে যুগোপযোগী করা হয়েছে। একইভাবে হালনাগাদ করা হয়েছে জাতীয় ওষুধনীতিও।
বর্তমানে দেশের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করার পাশাপাশি বিশ্বের শতাধিক দেশে আমাদের ওষুধ রপ্তানি করা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে একটি আধুনিক জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির পাশাপাশি একটি যুগোপযোগী ওষুধনীতির প্রয়োজনীয়তা ছিল অনস্বীকার্য। আওয়ামী লীগ সরকার সেই দায়িত্বটি সুনিপুনভাবে পালন করেছেন।
স্বাস্থ্যখাতে আওয়ামী লীগ সরকারের আরেকটি নন্দিত অর্জন কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রতি ছয় হাজার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তার প্রথম মেয়াদেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১০ হাজারেরও বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক। পরবর্তীতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার এসব ক্লিনিকগুলোকে গবাদি পশুর চারণক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। আবারও ক্ষমতায় এসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুধু যে এই অনন্য মানবিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যাই বাড়িয়েছেন তাই নয় বরং একে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যেও নিয়ে এসেছেন যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ খামখেয়ালির বশে কমিউনিটি ক্লিনিককে বন্ধ করে দিতে না পারে। বর্তমানে এই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো থেকে ত্রিশ ধরনের অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে।
পাশাপাশি দেশে বিদ্যমান সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিরবিচ্ছিন্নভাবে চিকিৎসা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার তাগিদে গত এক যুগে বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিশ হাজারেরও বেশি চিকিৎসককে। ঢেলে সাজানো হয়েছে দেশের স্বাস্থ্য প্রশাসনকে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি বিভাগকে দুটি বিভাগে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে প্রশাসনিক কার্যক্রমে গতিশীলতা আনা হয়েছে। নিয়মিত পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হয়েছে স্বাস্থ্য প্রশাসক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের। বৃদ্ধি করা হয়েছে প্রান্তিক পর্যায়ে কর্মরত চিকিৎসক এবং চিকিৎসা প্রশাসকদের আবাসন, পরিবহনসহ অন্যান্য সুবিধাদি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিকিৎসকদের প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার মর্যাদা দিয়েছিলেন আর তার সুযোগ্য কন্যা দায়িত্বে এসে নার্সদের দিয়েছেন দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার সম্মান।
দেশে অসংখ্য নতুন বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি, নিউরো সাইন্স, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, ইএনটিসহ একাধিক ন্যাশনাল পোস্ট গ্রাজুয়েট ইন্সটিটিউট। কুর্মিটোলা, মুগদা, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ইউনিট-২, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ইউনিট-২, শেখ ফজিলাতুননেছা চক্ষু হাসপাতাল ইত্যাদি নতুন নতুন হাসপাতাল শেখ হাসিনার সরকারেরই অর্জন। নতুন শয্যা সংযোজন আর আধুনিকায়নের মাধ্যমে সেবার সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে জাতীয় হৃদরোগ, কিডনি, মানসিক স্বাস্থ্য এবং শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য, অর্থোপেডিক ইন্সটিটিউট, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আর আজিমপুরের মা ও শিশু হাসপাতালসহ অসংখ্য হাসপাতালের। পাইপ লাইনে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল এবং জাতীয় লিভার ও ফিজিক্যাল মেডিসিন ইন্সটিটিউটের মতো অতি প্রয়োজনীয় হাসপাতালগুলো।
পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২৪টি নতুন সরকারি মেডিকেল কলেজ আর এগুলো স্থাপিত হয়েছে জেলায় জেলায়। এর ফলে ভবিষ্যতে চিকিৎসার জন্য এদেশে চিকিৎসকের ঘাটতিজনিত হাহাকার যে আর থাকবে না তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। পাশাপাশি চিকিৎসকদের আন্তর্জাতিক মানের বিশেষজ্ঞ হিসেবে গড়ে তোলা আর দেশে চিকিৎসা ক্ষেত্রে গবেষণার প্রসারের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে আর চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেটে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নতুন পাবলিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। ক্ষমতায় ফিরে এসে দেশের অবশিষ্ট বিভাগগুলোতেও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
স্বাস্থ্যখাত বাদ যায়নি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটালাইজেশনের সুফল থেকে। দেশের কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে জাতীয় ইন্সটিটিউট পর্যন্ত সকল হাসপাতালে ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রবর্তন করা হয়েছে ই-গর্ভনেন্স ও ই-টেন্ডারিং। সরকারি হাসপাতালগুলোকে সদ্যই আনা হবে অটোমেশনের আওতায়। স্বাস্থ্য বাতায়ন কল সেন্টার চালু করার মাধ্যমে চব্বিশ ঘণ্টা তাৎক্ষনিকভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ ও স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।
দেশব্যাপী চিকিৎসা ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সরকারের যে বিপুল অর্জন তার স্বীকৃতিতে ভুল করেননি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও। তার আরও অসংখ্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পাশাপাশি স্বাস্থ্যখাতে অর্জিত সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড, এমডিজি ফোর অ্যাওয়ার্ড ইত্যাদিও আমাদের রাষ্ট্রীয় তোশাখানা জাদুঘরকে আলোকিত করে রাখবে।
করোনাকালে মহামারি মোকাবিলায়ও ঈর্ষণীয় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরকার। একদিকে যেমন মৃত্যুর সংখ্যা মহামারির শুরু থেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা গেছে তেমনি পরপর দুই-দুইবার সীমিত সামর্থ্য নিয়েও করোনার ওয়েভকে বশে আনার কাজটি করে দেখিয়েছে আমাদের স্বাস্থ্যখাত।
করোনা চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রতিটি ওষুধই দ্রুত দেশে উপলব্ধি হয়েছে আমাদের দক্ষ ওষুধ শিল্পের দক্ষতায়। তবে এক্ষেত্রে আমাদের একটি বড় সাফল্য করোনার ভ্যাকসিন বিনামূল্যে রোল আউট করার বিষয়টি। আমরা যে শুধু পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের আগেই করোনা ভ্যাকসিন রোল আউট করেছি তাই নয়, বাংলাদেশ পৃথিবীর সেই গুটিকয় হাতেগোনা দেশের অন্যতম যারা বিনামূল্যে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের জন্য করোনার ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে যাচ্ছে।
আর এই ভ্যাকসিনের জায়গায় যুক্ত হতে যাচ্ছে সাফল্যের এক নতুন পালক, রচিত হতে যাচ্ছে এক অসামান্য সাফল্যগাথা। দেশে আবিষ্কৃত প্রথম করোনা ভ্যাকসিন বঙ্গভ্যাক্স মানুষের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য সম্প্রতি অনুমোদন পেয়েছে। এই ভ্যাকসিন যেদিন দেশে চলমান করোনা গণটিকা কার্যক্রমে সংযুক্ত হবে সেই বিশেষ দিনটিতে স্বাস্থ্যখাতে সংগঠিত হবে এক নতুন বিপ্লব।
আমার জানামতে, এখন পর্যন্ত আটটি মাত্র দেশ করোনা ভ্যাকসিন উদ্ভাবন শেষে রোল আউট করতে সক্ষম হয়েছে। কাজেই ‘ফর বাংলাদেশ, অব বাংলাদেশ, বাই বাংলাদেশ’। বঙ্গ্যভাক্স যেদিন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের শরীরে প্রয়োগ করা হবে সেই দিন ‘এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে’ দেখবে যে বাঙালি আর বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত এমনকি এমনটিও করে দেখানোর যোগ্যতা রাখে।
লেখার শেষপ্রান্তে, মুগ্ধ হয়ে ভাবছি তখন সাধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই মহীয়সী নারীকে রোল মডেলের আসনে বসায়নি। আমরা সৌভাগ্যবান যে, আমরা পেয়েছি আমাদের মাথার উপর ‘মাদার অফ হিউম্যানিটি’ যিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন ‘এ ডটারস টেল’কে বাস্তবে রূপায়িত করায়। তিনি যে শুধু স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান আর স্বপ্ন পূরণ করেন তাই নয় তিনি দেখেন বহুদূর। তার দৃষ্টি এখন রূপকল্প ২০২১, মিশন ইনোভেশন ২০৪১ ছাড়িয়ে ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’তে প্রসারিত। তার জাদুর ছোঁয়াতেই শূন্য থেকে যাত্রা করে আমাদের স্বাস্থ্যখাত আজ বঙ্গভ্যাক্সের যুগে প্রবেশ করছে।
তবে চ্যালেঞ্জ যে একেবারেই নেই তাও বলা যায় না। আমি পেশায় যেহেতু চিকিৎসক, এই খাতের অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতাগুলোও সঙ্গত কারণেই আমার কাছে পুরোপুরি অজানা নয়। আমার দৃষ্টিতে এই পেশার বড় সংকট নেতৃত্বের জায়গায়। পেশায় দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্বের শূন্যতায় কীভাবে ধুকছে আমাদের স্বাস্থ্যখাত, তা আমি হাড়ে-হাড়ে টের পাই। আর চলমান করোনা মহামারি অনেক সময় তা টের পেয়েছে পুরো বাংলাদেশই।
একথা অনস্বীকার্য যে, করোনা মহামারিতে আমাদের স্বাস্থ্যখাতের অর্জন অনেক। এত অল্প পরিসরের ঘনবসতির বাংলাদেশে কোটি মানুষকে করোনা থেকে সামলে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। বিশেষ করে যখন আমাদের নিজস্ব কোনো ভ্যাকসিন সক্ষমতা নেই। কিন্তু একটু যদি গভীরভাবে চিন্তা করা যায়, খেয়াল করে দেখবেন এ খাতে আমাদের যা কিছু অর্জন তার সবকিছুই শুধু ঐ একজন শেখ হাসিনার জন্যই। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যখাত একেবারেই পারফর্ম করেনি এমন মন্তব্য অবশ্যই অসত্য এবং স্বাস্থ্যখাতের প্রতি অবমাননা করাতো বটেই। তারপরও এ কথা মানতেই হবে যে, এত সমর্থন আর সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে এমন বিশ্বনন্দিত নেতৃত্ব থাকায় আমাদের স্বাস্থ্যখাত আরেকটু ভালো পারফর্ম করবে এটুকু প্রত্যাশা জাতির ছিল এবং জাতির সেই প্রত্যাশা আমাদের স্বাস্থ্যখাত সেভাবে পূরণে সক্ষম হয়নি।
আমার বিবেচনায় এর জন্য আমরা দুর্নীতি থেকে শুরু করে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য, আমলাতন্ত্র ইত্যাদি অনেক কিছুকেই দায়ী করে প্রশান্তি পেতে পারি ঠিকই, কিন্তু এর মূল কারণ এই পেশায় ভিশনারি নেতৃত্বের সংকট। যে ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরী কিংবা ডা. ফজলে রাব্বিরা একদিন নিজ পেশার ঊর্ধ্বে উঠে গোটা দেশের দিশারি হয়ে উঠেছিলেন, তাদের উত্তরসূরিরা আজ বড়ই ‘টানেল ভিশনড’। ফলে আমরা অনেক সময়ই আমাদের চারপাশের চেনা আশপাশ চিনতে ভুল করি।
আমাদের মেধাবী পরবর্তী প্রজন্ম আরও ওয়াইড ভিশনড হোক, আগামীর ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরী আর ডা. ফজলে রাব্বিদের প্রজ্ঞায় আলোকিত হোক আমাদের স্বাস্থ্যখাত এতটুকুই প্রত্যাশা। কারণ বাদবাকিটুকু যেহেতু হয়েই আছে, এই শূন্যতাটুকু পূরণ হলেই এখাতের আলোয়ও উদ্ভাসিত হবে বাংলাদেশ।
লেখকঃ চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যেঃ ঢাকা পোস্ট
(মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)