1806
Published on ডিসেম্বর 5, 2021১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি জান্তারা ঢাকাসহ সারাদেশে গণহত্যা ও ধর্ষণ শুরু করে। ফলে জান বাঁচাতে দেশ ছেড়ে সীমান্তের দিকে ছুটতে থাকে লাখ লাখ বাঙালি। পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতার মাত্রা উপলব্ধি করে সীমান্ত খুলে দিয়ে অসহায় বাঙালিদের পাশে দাঁড়ায় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। ফলে যুদ্ধের ৯ মাসে দেশের ১৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ, তথা তৎকালীন ৭ কোটি বাঙালির মধ্যে ১ কোটির বেশি সংখ্যক লোক, নিবন্ধিত শরণার্থী হিসেবে থাকার সুযোগ পায় ভারতের ৯ রাজ্যে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, বিহার, মেঘালয়, উত্তর প্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের মানুষ যেভাবে শরণার্থীদের ভরণপোষণ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল, বিশ্বে এমন নজির দ্বিতীয়টি নেই।
৭১-এর ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত, নিবন্ধিত শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৫ জন। এর বাইরেও প্রচুর বাঙালি সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল। পাকিস্তানিদের নিপীড়নের শিকার অসহায় বাঙালিদের পাশে দাঁড়াতে- সেসময় ৮২৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছিল ভারত সরকার। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে, সীমান্তের চারপাশে স্থাপন করেছিল হাসপাতাল।
এছাড়াও শরণার্থীদের জন্য খাদ্য, পোশাক, চিকিৎসা সরঞ্জামসহ নানা সেবা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল ভারতের সর্বশ্রেণির জনগণ। এমনকি শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে ডাকটিকিটের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছিল ভারত সরকার।
আগস্ট মাসে, মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এসব শরণার্থী কেন্দ্র ও রণাঙ্গণ পরিদর্শনে আসেন। পাকিস্তানি জান্তাদের দ্বারা সৃষ্ট এই ঘটনাকে তিনি সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ এক 'হিউম্যান ট্র্যাজেডি' হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
সেপ্টেম্বর মাসে, ভারত ও বাংলাদেশের বন্যাপ্লাবিত অঞ্চলে মহামারি আকার ধারণ করেছিল কলেরা। তখন প্রায় এক লাখ শরণার্থীকে কয়েকটি রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করায় ভারত সরকার।
তবে মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য ত্যাগ ও সাহসের কারণে মাত্র ৯ মাসের মাথায়, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। এরপর প্রথমেই ভারতে থাকা শরণার্থীদের দেশে ফেরানোর উদ্যোগ নেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে মাত্র তিন মাসের মধ্যে দেশে ফিরে আসতে সমর্থ হয়- ভারতের আশ্রয়ে থাকা এককোটির বেশি মানুষ। এরপর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি সংস্কার ও নির্মাণের ব্যবস্থা করে দেন বঙ্গবন্ধু।
এদিকে- বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে- যুদ্ধের পর তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ ছেড়ে নিজ দেশে ফিরে যায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করা ভারতীয় সেনারা। পৃথিবীর ইতিহাসে মিত্রবাহিনীর সেনা কর্তৃক এতদ্রুত বিজয়ী ভূখণ্ড ত্যাগ করার দৃষ্টান্ত দ্বিতীয়টি নেই।
তবে পাকিস্তানিদের হাতে শ্মশানে পরিণত হওয়া- যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ- যাতে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারে, সেজন্য ইন্দিরা গান্ধীর আন্তরিকতায়- ভারতের সহযোগিতা অব্যাহত থাকে। ১৯৭২ সালের শুরুতে, যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং বন্যাবকলিত সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশকে ৪ লাখ টন খাদ্যশস্য দিয়ে যায় তারা। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী ছয়মাসে মোট খাদ্য সহায়তার ৭৪ শতাংশ দিয়েছে ভারত সরকার। এমনকি যুদ্ধের রক্তস্রোতে একসাথে মিশে যাওয়া দুই দেশের সম্পর্ককে আরো নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায় তারা। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে ৩১ কোটি মার্কিন ডলার নগদ অর্থ সহায়তা করে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার, যা সেই সময়ের দাতাদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এছাড়াও বেসামরিক বিমান ও জাহাজ সরবরাহ করার মাধ্যমে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সচল রাখতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছে এই প্রতিবেশী দেশটি।