744
Published on ডিসেম্বর 2, 2021অজয় দাশগুপ্তঃ
পার্বত্য শান্তিচুক্তির দুই যুগ পূর্ণ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের ৬ মাস যেতে না যেতেই ভারতের সঙ্গে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টনের চুক্তি সম্পাদন করেন। এর এক বছরের মধ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই যুগের অশান্ত পরিস্থিতির অবসান ঘটনোর এক ঐতিহাসিক চুক্তি। এ চুক্তি সম্পাদনের পর জাতীয় সংসদে সে সময়ের বিরোদী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন এভাবে- “এ চুক্তির কারণে পার্বত্য ভূখ-, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী ও ফেনী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড ভারতের অধীনে চলে যাবে।” এ চুক্তি বাতিলের জন্য তিনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রোর্ড মার্চ করেছিলেন।
পার্বত্য চুক্তির সময় ওই ভূখণ্ডে যে সব শিশুর জন্ম হয়েছে তারা এখন তরুণ-তরুণী। সে সময় যারা শান্তি বাহিনীর সদস্য হিসেবে অস্ত্র সমর্পণ করেছিলেন, তারা এখন প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশ ভূখণ্ডেই তাদের বসবাস। শান্তি চুক্তির দ্ইু যুগে ওই এলাকায় কী পরিবর্তন ঘটেছে এমন প্রশ্ন করেছি তিন জেলার কয়েকজনকে। কেউ বলেন, বান্দরবান এলাকায় নির্মিত বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু ৭২ কিলোমিটার সড়কের কথা। কেউ বলেন, মিজোরাম সীমান্ত পর্যন্ত নির্মিত সড়কের কথা। কেউ বলেন, বিদ্যুৎ সংযোগ ও মোবাইল-ইন্টারনেট সেবার কথা। কারও বিবেচনায় মেডিকেল কলেজ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় জন-প্রত্যাশা পূরণ করেছে। পার্বত্য ভূখণ্ডে এমন অনেক দুর্গম এলাকা রয়েছে, যেখানে পাকা সড়ক নির্মাণ কখনও হবে- এমনটি ভাবনায় আসত না। এখন তা বাস্তব। সরকার তো রেলপথ নির্মাণের কথাও ভাবছে।
পার্বত্য ভূখণ্ডের নদীগুলো খরস্রোতা। কিন্তু কিছু নদীতে পলি জমছে। এই পলি অপসারণে বড় প্রকল্পের কথাও ভাবা হচ্ছে। এর ফলে সড়কের পাশাপাশি জলপথের ব্যবহারও বাড়বে।
পার্বত্য ভূখণ্ডের চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় এবং তার কিছু অনুসারী ১৯৭১ সালে গণহত্যাকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তাকে জাতীয় পরিষদ সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানের নিষ্ঠুর ঘাতক বাহিনীর কর্মকাণ্ড সমর্থন করেন। ১৯৭২ সালে তিনি পকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর মন্ত্রিসভার সদস্য হন। এর ফলে অবিশ্বাসের যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তা কাটিয়ে ওঠা সহজ ছিল না। কিন্তু উদার ও সহিষ্ণু মনোভাবের জন্য কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী নন্দিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পার্বত্য ভূখণ্ডের জনগণের প্রতি বরাবর ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর এ প্রক্রিয়া শুধু থেমে যায় না, সামরিক সরকারের কিছু ভুল পদক্ষেপের কারণে সেখানে অশান্ত পরিবেশ তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হয়ে সেখানে শান্তি ফিরিয়ে আনেন। এটা ছিল বলিষ্ঠ উদ্যোগ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, উন্নত বিশ্বে এ ধরনের শান্তি উদ্যোগে জড়িতদের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারের মতো সম্মান মিলত।
কেউ বলবে না যে পার্বত্য ভূখণ্ডে ভূমি, স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সব সমস্যা ছিল, তার সবগুলোর নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। কিন্তু একটি প্রশ্নে সকলে একমত- ১৬ লাখ অধিবাসীর ওই ভূখণ্ডের চিত্র বদলে গেছে। ওই ভূখণ্ডে বহুকাল ধরে যাদের বসবাস, তাদের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ। জীবনযাত্রায় আছে বৈচিত্র্য। পাহাড়ে কৃষিকাজসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কীভাবে পরিচালনা করতে হয়, সেটা তারা ভাল করেই জানেন। পরিবেশ সংরক্ষণেও তারা যত্নবান। কিন্তু একইসঙ্গে নতুন প্রজন্ম দেখছে যে ওই ভূখণ্ডের যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নয়ন। পাহাড়ে সবজি এবং কলা-আনারসসহ যে সব ফল খুব সহজে ও কম ব্যয়ে উৎপাদন করা যায়- সে সবের বড় অংশ সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের সুবিধার অভাবে নষ্ট হবে- এটাই মনে করা হতো। এখন চিত্র একেবারেই ভিন্ন।
পাহাড়ের একদল শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য নানা প্রতিকূলতা জয় করে পড়তে আসত। তবে সাধারণভাবে শিক্ষার সুযোগ ছিল সীমিত। মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ ছিল না। আমি আশির দশকে ওই এলাকার কয়েকটি ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার জন্য কিছু বই প্রকাশের কথা ভেবেছিলাম। এ জন্য বিভিন্ন মহলে আলোচনা করতে গিয়ে রীতিমতো হুমকির মুখোমুখি হই। কেউ কেউ বলেন, আপনার ভাবনা রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিন্তু এ সমস্যা সমাধান করে দিয়েছেন। ওই এলাকায় দুর্গম হিসেবে পরিচিত বসতিতেও প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে এবং শিক্ষার্থীরা পড়ছে নিজের মাতৃভাষায়।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রশংসা আমরা শুনতে পাই। পার্বত্য ভূখণ্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে, এটা অনেকের ভাবনায় আসেনি। এতোটা দুর্গম এলাকা যে প্রশাসনে কাউকে শাস্তি দিতে হলে বলা হতো, ‘পার্বত্য এলাকায় পাঠিয়ে দাও’। কিন্তু এখন তারাই বলবেন, ওই ভূখণ্ডে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে তার সফল বাস্তবায়নের জন্য সেখানে সেরা অফিসার ও কর্মীদের সবচেয়ে কর্মঠ ও দক্ষদের পাঠানো প্রয়োজন। রামগড়ে গড়ে উঠছে আধুনিক স্থল বন্দর, যা ত্রিপুরাসহ ভারতের সেভেন সিস্টারস হিসেবে পরিচিত রাজ্যগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করবে। বাংলাদেশ অনেক দেশের বিনিয়োগকারীর জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্য। বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীরাও অন্য দেশে পুঁজি খাটাতে আগ্রহী। এ ক্ষেত্রে আসাম, মিজোরাম, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
পর্যটনের জন্য পার্বত্য ভূখণ্ড বরাবরই আকর্ষণ। কত কিছু সেখানে দেখার আছে! যোগাযোগ ও আবাসন সুবিধা পর্যাপ্ত না থাকায় সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছিল না। এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটছে। পর্যটনের অবকাঠামো গড়ে উঠছে। তবে এ সব সুবিধ সৃষ্টি করতে গিয়ে ওই এলাকার ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। এটা বাংলাদেশের সব এলাকার জন্যই প্রযোজ্য। অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে গিয়ে পরিবেশের ক্ষতি করা চলবে না- এটা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।
শান্তি চুক্তি ওই ভূখণ্ডকে কতই না বদলে দিয়েছে। কিছু সমস্যা এখনও রয়েছে। মতলববাজ একটি মহলও অপতৎপরতায় লিপ্ত। পার্বত্য ভূখণ্ড কিংবা সমতল, সর্বত্র তাদের একই রূপ। যেমনটি ছিল ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। কিন্তু তারা একাত্তরে সফল হয়নি, এখনও হবে না।
লেখকঃ মুক্তিযোদ্ধা এবং একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক
(মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)