805
Published on নভেম্বর 1, 2021এম নজরুল ইসলাম:
নতুন অর্থবছরের প্রথম তিন মাস পেরিয়ে বাংলাদেশের জন্য এলো সুসংবাদ। করোনাকালে বিশ্বের প্রতিটি দেশ যখন নিজেদের ভঙ্গুর অর্থনীতির নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, তখন বাংলাদেশের জন্য এসেছে আশাবাদী হওয়ার মতো খবর। সেই খবরটি হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এই পূর্বাভাস দিয়েছে যে, মাথাপিছু মোট দেশজ উত্পাদন বা জিডিপিতে বাংলাদেশ চলতি বছর আবারও ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আইএমএফের হিসাবে ২০২১ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২১৩৮ দশমিক ৭৯৪ মার্কিন ডলার, একই সময়ে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২১১৬ দশমিক ৪৪৪ ডলার। ফলে পরপর দুই বছর ভারতকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এটি আমাদের জন্য অবশ্যই একটি বড় সুসংবাদ।
অর্থনীতির হিসাব যারা রাখেন, তারা জানেন, মহামারির শুরুর ধাক্কায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উত্পাদনের প্রবৃদ্ধি নেমে গিয়েছিল ৩ দশমিক ৫১ শতাংশে, যা তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। সরকার গত অর্থবছরের বাজেটে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরলেও মহামারি পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করায় তা সংশোধন করে ৬ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছিল। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ষাণ্মাসিক প্রতিবেদনে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ শতাংশ, যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরোর হিসাবে তা ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকার ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে। তবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবির হিসাবে এই প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের বর্তমান গতি অব্যাহত থাকলে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে।
অন্য দিকে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, ২০২২ থেকে ২০২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এতে দেশের জিডিপির পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাদের হিসাবে ২০২৬ অর্থবছর নাগাদ মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমানে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৮ ডলার। এই অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বৈশ্বিক মহামারি সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির অগ্রযাত্রা বজায় রেখেছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলো যখন পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন বাংলাদেশ কী করে এই স্থিতি অবস্থা ধরে রেখেছে? দেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনা ভাইরাসের মধ্যে বড় মাপের প্রণোদনা প্যাকেজ, নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও অর্থনীতি খুলে দেওয়ার মতো সরকারের সাহসী পদক্ষেপ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত করছে। তাদের মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুবিন্যস্ত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ার কারণে করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে। এর মধ্যে বড় চমক ছিল লক্ষাধিক কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা। আর সে কারণেই অন্যান্য দেশ যেখানে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিতে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ একটা পজিটিভ প্রবৃদ্ধিতে আছে—এটাও মনে করে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা। সেটার মাত্রা নিয়ে কিছু কথা থাকলেও বিষয়টি আশাবাদী হওয়ার মতো বলে মনে করেন তারা। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, করোনার আঘাতের পরও বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার করছে।
আমরা যদি একটু পেছন ফিরে তাকাই তাহলে দেখব, গত প্রায় দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুততর হচ্ছে। আর সে কারণেই মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশের এই অগ্রগতি। অথচ ২০০৭ সালেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ভারতের অর্ধেক। শুধু জিডিপিতে নয়, আর্থসামাজিক আরো অনেক সূচকেই আজ বাংলাদেশ ভারতকে পেছনে ফেলছে। যেমন—ভারতের মেয়েদের তুলনায় বাংলাদেশের মেয়েদের শিক্ষার হার বেশি। নারীপ্রতি জন্মহার কম। নবজাতক ও পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুমৃত্যুর হারও বাংলাদেশে অনেক কম। আর অর্থনীতির অনেক ক্ষেত্রে আরো আগেই পাকিস্তানকে ছাড়িয়েছে বাংলাদেশ। মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়েছে তিন বছর আগে এবং মোট জিডিপিতে পাকিস্তানকে ছাড়িয়েছে ২০১৯ সালে।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট শুক্রবার চলতি বছরের যে ‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক’ প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশের স্কোর গতবারের ২০ দশমিক ৪ থেকে কমে ১৯ দশমিক ১ পয়েন্ট হয়েছে। অর্থাত্ অপুষ্টির হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে ধারাবাহিক উন্নতি অব্যাহত থাকায় ক্ষুধামুক্তির লড়াইয়ে একধাপ অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশের। ক্ষুধার মাত্রা বিবেচনায় বাংলাদেশ ‘মারাত্মক’ থেকে ‘সহনীয়’ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। ক্ষুধা সূচকে অবস্থানগত দিকে থেকেও উন্নতি হয়েছে। গত বছর ১০৭টি দেশের মধ্যে ৭৫তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। এবার ১১৬টি দেশের মধ্যে ৭৬তম হয়েছে।
বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে চলেছে এবং বাংলাদেশের এই অগ্রগতি আজ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। এর আগে ২০১৯ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) প্রকাশিত ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক’ বা এডিওতে বলা হয়েছিল, এশিয়ার ৪৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে এবং বাংলাদেশের অগ্রগতির এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
টানা এক যুগের নিরলস পরিশ্রমে অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় পথচলায় গতি সঞ্চারের কাজটি করে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত ও ক্ষয়িষ্ণু বাংলাদেশকে উন্নয়নের সড়কে তুলে এনে রিলিফ শব্দটি বর্তমান প্রজন্মের কাছে অপরিচিত করে দিয়েছেন তিনি। খাদ্য ঘাটতির দেশটি আজ খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ। একসময় বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল, তা ভুলতে বসেছে দেশের মানুষ। বাংলাদেশ এখন মহাশূন্যে নিজস্ব উপগ্রহ পাঠায়, নিজের অর্থায়নে পদ্মা সেতু বানায়। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের অনেক দিনের স্বপ্ন পায়রা সেতু খুলে দেওয়া হয়েছে।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশ। তিন যুগ আগে বাংলাদেশের নাম শুনলে বিদেশিরা জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকত, এটা আবার কোন দেশ! এখন বাংলাদেশের নাম শুনলে তাকায় অবাক-বিস্ময়ে, তবে সে দৃষ্টি সম্মানেরও। বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্মানের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের অগ্রযাত্রায় বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে। নিশ্চিত জানি, সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। তিনিই নেতৃত্ব দেবেন উজ্জ্বল আগামী দিনে।
লেখক : সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকার কর্মী, লেখক ও সাংবাদিক
(মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)