শেখ রাসেল: দীপ্ত জয়োল্লাস, অদম্য আত্মবিশ্বাস

1760

Published on অক্টোবর 15, 2021
  • Details Image

১৯৬৪ সাল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগকে পুনর্জীবিত করে তোলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বৈরাচার আইয়ুববিরোধী আন্দোলন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত পটভূমি তৈরির জন্য দেশজুড়ে তখন জনসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন তিনি। অন্যদিকে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের তত্ত্বাবধানে, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কেও চলছিল, পরিবারের মাথা গোঁজার জন্য একটি বাড়ি নির্মাণের কাজ। এমন এক কর্মমুখর সময়ে সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলো এক নবোজাত। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর, কার্তিকের প্রথম দিবস, চারপাশে হেমন্তের সুবাস ছড়িয়ে জন্ম নিলো শেখ রাসেল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেচ্ছা বেগমের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান।

বঙ্গমাতার গর্ভে যে-সময়টায় বেড়ে উঠছিল শেখ রাসেল, সেই সময়জুড়ে সারা দেশে আওয়ামী লীগকে নতুন করে সংগঠিত করেন বঙ্গবন্ধু। কী কাকতালীয়, অথচ কতো অনুপম এক যুগল যাত্রা। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণের সময়, বিশ্বনেতাদের সঙ্গে যেভাবে শুভেচ্ছা বিনিময় করতো ছোট্ট রাসেল; যে মেধা, আত্মবিশ্বাস ও ব্যক্তিত্ব বিচ্ছুরিত হতো তার চোখে-মুখে, তার পোশাক এবং আদব-কায়দায়, তা এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। 

সামাজ্যবাদবিরোধী ও অহিংসতার জন্য জগৎবিখ্যাত দার্শনিক, বার্ট্রান্ড উইলিয়াম রাসেলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যের নাম রাখা হয়েছিল- শেখ রাসেল। ছেলে বড় হয়ে এক মানবিক আদর্শের প্রতীকে পরিণত হোক, তাই হয়তো চেয়েছিলেন পিতা শেখ মুজিব ও মাতা ফজিলাতুন্নেচ্ছা। বড় দুই বোন- শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং দুই ভাই- শেখ কামাল ও শেখ জামালের আদরে আদরে শুরু হয় রাসেলের জীবনের পথ চলা।

আস্তে আস্তে বেড়ে উঠতে শুরু করলো ছোট্ট রাসেল। কিন্তু এই কুসুমিত কোমল হৃদয়ে পায়রার ঝাঁক ডানা মেলার আগেই শুরু হয় তুমুল ঝড়-ঝাপটা। ১৯৬৬ সালে বাঙালির বাঁচার দাবি 'ছয় দফা' ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। আলোড়ন শুরু হয় দেশের প্রতিটি অঞ্চলে। ভয় পেয়ে যায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে জেলে রাখে তারা।

ততদিনে একটু একটু করে হাঁটতে শিখেছে রাসেল। আধো আধো বুলিও ফুটেছে মুখে। এ-ঘর ও-ঘর করে বাবাকে খুঁজে ফেরে সে। কখনো কখনো মাকেও পায় না খুঁজে। বঙ্গবন্ধুর মামলা-মোকদ্দমা সামলানো এবং আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ ঠিক রেখে আন্দোলন সংগ্রাম চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন বেগম ফজিলাতুন্নেচ্ছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও তখন কলেজের রাজনীতিতে সক্রিয়।

কিছুক্ষণ বাবার গলা জড়িয়ে ধরার জন্য, ছোট্ট রাসেলকে তাই অন্যদের সঙ্গে জেলের গেটে যেতে হতো। আর ফিরতে চাইতো না সে, নামতে চাইতো না কোল থেকে। কিন্তু ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর সেই দেখার সুযোগও বন্ধ হয়ে যায়। অবশেষে নিজের আম্মাকেই 'আব্বা' বলে ডেকে হৃদয়ের ক্ষত নিরাময়ের চেষ্টা করতো রাসেল।

বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য- যখন উত্তাল সময় পার করছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যরা; ঠিক সেই সময় বাড়িতে থাকা পোষা পায়রার দলের সঙ্গে ভাব জমে ওঠে রাসেলের। একারণে কখনো কবুতরের মাংস খেতে চাইতো না সে। এক শিশু মনের মধ্যে প্রস্ফূটিত হতে শুরু করেছিল কী নিদারুণ প্রেম, অশেষ ঔদার্য! 

কিন্তু রাসেল নামের এই শান্তিপ্রিয় মানবিক ফুলটিকে আর ফুটতে দেওয়া হলো না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, এক শ্রাবণের রাতে, একদল বর্বর ঘাতক পৈশাচিকভাবে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে, ছোট্ট রাসেল তখন মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিল। নিষ্ঠুর ঘাতকেরা তাকে মায়ের কাছে নেওয়ার কথা বলে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নিষ্ঠুরতার দৃষ্টান্ত আর দ্বিতীয়টি নেই। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি, ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ক্লাসরুমে- আজো কান্নার রোল ওঠে নীরবে। দমবন্ধ হয়ে আসা গুমোট ব্যথা চিন চিন করে ওঠে বুকের খোপে।

ষড়ঋতুর প্রাত্যহিক আকাশজুড়ে, আমাদের হৃদয়ের দিকচক্রবালে, যেসব পায়রার ঝাঁক উড়ে চলে; প্রতিটি ঊষা কিংবা গোধূলির দিকে তাকিয়ে, নীড়ে ফেরা পাখির মতো ছোট্ট রাসেলও ফিরে ফিরে আসে- বাঙালির মনে ও মননে!!

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত