885
Published on সেপ্টেম্বর 29, 2021এ কে এম আতিকুর রহমানঃ
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফেরেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। বাংলার মাটি থেকে তখনো রক্তের দাগ মুছে যায়নি। স্বজন হারানো মানুষের আর্তনাদ তখনো বাংলার আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। চারদিকে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, বিপর্যস্ত যোগাযোগব্যবস্থা। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে কোনো অর্থ নেই। বুকের ভেতর রাখা সব বেদনাকে শক্তি করে লাখো শহীদের রক্তে সিক্ত বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে দেশপ্রেমের কঠিন ব্রতে উজ্জীবিত সেই আত্মপ্রত্যয়ী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মহান নেতা দেশ গড়ার কাজে নেমে পড়লেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই শেষ করলেন সংবিধান রচনার কাজটি। একই সঙ্গে প্রণীত হয়ে গেল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৫-এর ১ ও ২ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত পররাষ্ট্রনীতিতে অন্য রাষ্ট্রের প্রতি বাংলাদেশের আচরণ, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান, জাতিসংঘ সনদের প্রতি শ্রদ্ধা, মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির মৌলিক কথা—‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ এবং ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান’-এর ওপর ভিত্তি করেই সারা বিশ্বে আজকের বাংলাদেশের সব কূটনৈতিক প্রয়াস।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করার জন্য একটি রাষ্ট্রকে স্বীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট কৌশলগুলো নিরূপণ করতে হয়। আর এ কাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন দেশটির নেতৃত্বে থাকা দল ও নেতা। আমেরিকার রাজনীতি বিশেষজ্ঞ জেমস এন রোজনো লিখেছেন, ‘আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের প্রকৃতি এবং সেখানে যে লক্ষ্যগুলো অনুসরণ করা উচিত সে সম্পর্কে একজন নেতার বিশ্বাস, তথ্য বিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি ও দুর্বলতা, তাঁর অতীত অভিজ্ঞতা এবং নেতার ভূমিকার জন্য প্রয়োজনীয় সেসবের প্রাসঙ্গিকতার মাত্রা, তাঁর আবেগগত চাহিদা ও ব্যক্তিত্বের অন্যান্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য—এগুলো স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যগুলোর মাত্র কয়েকটি, যা পররাষ্ট্রনীতির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে প্রভাব ফেলতে পারে।’ সন্দেহ নেই, বিশ্বসমাজে একটি রাষ্ট্রের অবস্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রে একজন নেতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
না বললেই নয়, একটা দেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়ন নির্ভর করে দেশটির নেতৃত্বের রাজনৈতিক দর্শন ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে ওই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের মাত্রার ওপর। পররাষ্ট্রনীতির সফলতা শুধু শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতির ওপরই নির্ভর করে না, পররাষ্ট্রনীতির সফল বাস্তবায়নের জন্য অবশ্যই একটি শক্তিশালী নেতৃত্ব থাকতে হবে। আর ওই নেতৃত্বকে হতে হবে বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য ও সম্মাননীয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিতে অকুতোভয় এবং তাঁর নেতৃত্বে থাকবে পররাষ্ট্রনীতির যথাযথ প্রয়োগে দক্ষ একটি কূটনীতিক দল। একটি রাষ্ট্রের জন্য এসবের সমন্বয়ের ওপরই নির্ভর করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ওই রাষ্ট্রের কূটনৈতিক বোঝাপড়া, সমঝোতা এবং সাফল্যের মাত্রা।
আমরা জানি, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও সরকার গঠন করার জন্য জাতীয় পার্টির সমর্থন নিতে হয়। ২৩ জুন আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী করে সরকার গঠন করে এবং ওই সরকার পরবর্তী পাঁচ বছর দেশ চালায়। এর পরের পাঁচ বছর বিএনপি সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পায়। তবে ২০০৯ থেকে অদ্যাবধি ধারাবাহিকভাবে দেশ পরিচলনার দায়িত্ব পালন করে আসছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আজকের উৎকর্ষ যে পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে তার মূলে রয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব, কূটনৈতিক অভিজ্ঞান, বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক, বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যায় বলিষ্ঠ ভূমিকা এবং বৈশ্বিক সার্বিক বিষয়ে তাঁর দূরদর্শিতা। তিনি জাতির পিতার কন্যা হিসেবেই নন, একজন দেশপ্রেমিক এবং সাধারণ মানুষের নির্ভরযোগ্য নেতা হিসেবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবায়নে নতুন মাত্রা ও ব্যাপ্তি যোগ করে তাকে আরো শক্তিশালী, টেকসই, সম্প্রসারিত ও অর্থবহ করে তুলেছেন। যে কারণে আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে একটি সম্মানজনক অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ উন্নয়নের এক রোল মডেল হিসেবে পরিচিত পেয়েছে।
শুধু বহুপক্ষীয় ক্ষেত্রেই নয়, দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বা উপ-আঞ্চলিক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের আজকের অবস্থান ও ভাবমূর্তি যে উচ্চতায় আসীন তার পেছনে কাজ করেছে শেখ হাসিনার দৃঢ়তা, আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতা স্থাপনে পারঙ্গমতা। তিনি অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় করেছেন পারস্পরিক সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভ্রাতৃত্ব বা বন্ধুত্ববোধকে যথাযথ মূল্যায়ন করে। আর এর মূলে ছিল সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়, পররাষ্ট্রনীতির এই মৌলিক নীতির ওপর প্রগাঢ় বিশ্বাস ও আস্থা থাকার কারণে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অর্জনের হিসাব দিতে গেলে অনেক লম্বা একটা তালিকা হয়ে যাবে। বহুপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এমন উল্লেখযোগ্য অর্জন বঙ্গবন্ধুর পর শেখ হাসিনা ছাড়া আর কোনো সরকারই এনে দিতে সক্ষম হয়নি।
ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিজেও বিশ্বনেতাদের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ও সমাদৃত হয়ে বাংলাদেশের সম্মানকেই বৃদ্ধি করেছেন। নিঃসন্দেহে তাঁর এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে যথাযথ অনুধাবন, বিশ্লেষণ ও অনুসরণ করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির কূটকৌশল সঠিকভাবে প্রয়োগ করা। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর প্রজ্ঞা ও কূটনৈতিক বিশ্লেষণ ক্ষমতা এ ক্ষেত্রে এক অনন্য ভূমিকা রেখেছে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি অনেক পুরস্কার, উপাধি আর খেতাব পেয়েছেন। জাতিসংঘের চলতি সাধারণ অধিবেশনেও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অসাধারণ অবদান রাখার জন্য শেখ হাসিনাকে ‘এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কারে’ ভূষিত করা হয়েছে।
আমরা বিশ্বাস করি তাঁর দেশপ্রেম, মানবিকতা, নিরলস প্রয়াস ও মনোবল একদিন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাকে বিশ্বসমাজে প্রতিষ্ঠা করবে। শেখ হাসিনাই সক্ষম হবেন বাংলাদেশকে তেমনই এক গৌরবময় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে। শেখ হাসিনার সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন কামনা করি।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব
সৌজন্যেঃ দৈনিক কালের কণ্ঠ
(মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)