2804
Published on আগস্ট 15, 2021অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিমঃ
বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশায় বারবার বলেছেন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।’ তিনি উল্লেখ করেন, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার আছে।
প্রতি বছর অপরিসীম বেদনা আর শোকাশ্রু নিয়ে ১৫ আগস্ট আসে বাংলাদেশে। পৃথিবীর একমাত্র ভাষা ও জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্রষ্টা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে দুই কন্যা ব্যতীত (শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জার্মানিতে ছিলেন) নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের এই দিনে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত মহানায়ক। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকলেও তার নামেই বাংলাদেশ যুদ্ধ করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যুদ্ধপীড়িত স্বাধীন দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে অন্যতম ছিল সংবিধান রচনা। সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চার মৌলনীতি নির্ধারিত হলো গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র। কিন্তু দুঃখজনক যে, খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরেই পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রথম স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়া সরকার সংবিধানের চার মৌলনীতি পালটে ফেলেন। ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দেয় এবং বাংলাদেশের আত্মপরিচয় বিকৃত করা হয়। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ধর্মাশ্রয়ী দল, বিশেষ করে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী দলকে রাজনীতি করার বৈধতা দেওয়া হয়। এরপর দ্বিতীয় স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্মের বিধান জারি করে। লক্ষণীয় যে, এই সময় থেকেই সাম্প্রদায়িকতার আলোকে পাঠ্যপুস্তকের মৌলিক পরিবর্তন করা হয়। বাদ দেওয়া হয় অসাম্প্রদায়িক খ্যাতনামা লেখকদের প্রবন্ধ, ছোটগল্প ও কবিতা।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সদ্য স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যে ইসলামের চিরন্তন মানব কল্যাণকামী বৈশিষ্ট্য ও আদর্শ প্রতিফলিত হয়। তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন ‘বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। ইসলামের অবমাননা আমি চাই না... এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।’ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলামের মতে, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের তরফ থেকে কোনো রকম বৈষম্যমূলক আচরণ পরিহার করা। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষের মন বুঝতেন অর্থাত্ ধর্মনিরপেক্ষতার এই জটিল প্রত্যয় সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে জনগণের একটি অংশ বিভ্রান্তির চেষ্টা করতে পারে। সেটা তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশায় বারবার বলেছেন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।’ তিনি উল্লেখ করেন, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার আছে। তিনি বাংলার পরাধীন পাকিস্তানের সময়কালে ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে খুন ইত্যাদির কঠোর সমালোচনা করেন।
স্বাধীনতার পরপরই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বঙ্গবন্ধুকে ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা আন্তর্জাতিক মহলে বিশেষ করে আরব দেশগুলোকে দিতে হয়। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলামের মতে, আরব নেতৃবৃন্দ ধারণা করেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ পাকিস্তানকে ধ্বংস করা হয়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধকালীন আরব দেশগুলো বাংলাদেশের প্রতি সংবেদনশীল ছিল না। তারা মনে করত, মুসলিম জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আলোচনা ও আপসের মাধ্যমে সুরাহা করা সম্ভব ছিল। এক ধর্ম ও সংস্কৃতি কেবল বন্ধন শক্ত রাখতে পারে না, এটার বিস্তারিত ব্যাখ্যা বঙ্গবন্ধু আরব নেতাদের কাছে উপস্থাপন করেন। এই উপমহাদেশে প্রায় একরকম রাজনীতি ও ইতিহাসের উত্তরাধিকার হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ধর্ম ব্যতীত জনগণের ভাষা, জাতিগত চরিত্র ও সংস্কৃতি একেবারেই ভিন্ন ছিল। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট করে দেন। বঙ্গবন্ধু আরব নেতাদের প্রশ্ন করেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে আরবরা একই ধর্ম, একই ভাষা ও একই সংস্কৃতি হওয়া সত্ত্বেও কেন তারা এতগুলো ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত? তাদের বিবেচনা সঠিক হলে সবাই মিলে একত্রে একটি ‘আরব দেশ’ গড়া যেত। বঙ্গবন্ধু তার সহচরদের নিয়ে ধৈর্য সহকারে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যৌক্তিক কারণসমূহের ব্যাখ্যা দিতেন।
বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার একটি নীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় তার প্রতিফলন আছে। যেমন সংবিধানে বাংলাদেশ ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হওয়ায় প্রাধান্যের ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী (ধারা ২৭) এবং কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না (২৮.১)। রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করবে (২৮.২)। সংবিধানের উল্লিখিত মৌলিক অধিকারসমূহ আমাদের ধারণা দেয় যে, ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা সমতা প্রত্যয় থেকে উত্সারিত এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের সব স্তরে গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য অপরিহার্য। একইভাবে ধর্মীয়, লিঙ্গভিত্তিক ও জাতিসত্তা ভেদে সংখ্যাগুরু যে মনোভাবই পোষণ করুক না কেন সমতা ও সমান অধিকার দিতে বাধ্য (নীরা চন্দকে, ২০১৯)। তাই লক্ষণীয় যে, বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ উত্সাহ ও সমর্থনে রচিত সংবিধানে নারীর অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধর্ষণের শিকার নারীদের ত্যাগকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তাদের বীরাঙ্গনা উপাধিতে ভূষিত করেন।
বর্তমান বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ আগের চেয়ে কম নয়। বরং নতুন আঙ্গিকে, নতুন মাত্রায় সমাসীন। কারণ স্বাধীনতার প্রতিপক্ষরা কিছুতেই এই রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল দেখতে চাইবে না। তারা এখনো গুজব ছড়ায়, ধর্মনিরপেক্ষতা নাস্তিক্যবাদের সমার্থক। তাই যবনিকা টানছি, অমর্ত্য সেনের কথায়, বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তা হিসেবে ছিলেন অগ্রগণ্য এবং তার দৃষ্টান্ত থেকে সব দেশেরই শেখার আছে। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে বাংলাদেশ অনেক উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে ঠিকই কিন্তু বঙ্গবন্ধু কী রকম ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ চেয়েছিলেন তা পরিষ্কার করা প্রয়োজন। ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তি মুক্তিযুদ্ধ ও মৌলিক ইতিহাসকে যাতে গ্রাস করতে না পারে তার জন্য প্রয়োজন সঠিকভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের নবজাগৃতি।
লেখকঃ ডিন (ভারপ্রাপ্ত), সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক তথ্য কমিশনার
সৌজন্যেঃ দৈনিক ইত্তেফাক