3797
Published on আগস্ট 15, 2021মিল্টন বিশ্বাসঃ
বাংলাদেশের সংবাদপত্রে পঁচাত্তরের আগস্ট মাসটি ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন। তার শাহাদতবরণের পরের দিন ১৬ আগস্ট ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলা, দৈনিক ইত্তেফাক, দি বাংলাদেশ অবজারভার, দি বাংলাদেশ টাইমস প্রভৃতি পত্রিকা ১৫ আগস্ট মোশতাকের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে ফলাও করে খবর ছাপায়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে লিড নিউজ করে সেদিন কেউ সংবাদ পরিবেশন করেনি; নিহতের সংখ্যা কত তাও প্রকাশ করা হয়নি। ১ থেকে ১৫ এবং ১৫ থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সংবাদ প্রকাশের সেই ভিন্ন আচরণের কিছু নমুনা এখানে তুলে ধরা হলো।
‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি বর্জন করে ১৬ আগস্ট দৈনিক বাংলার শিরোনাম ছিল ‘শেখ মুজিব নিহত: সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারি।’ সশস্ত্রবাহিনীসমূহের আনুগত্য প্রকাশ। এর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির বেতার ভাষণ ছাপা হয়। বিভিন্ন স্তরের জনসাধারণের অভিনন্দন বলতে—বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সহসভাপতি, বাংলাদেশ গণকর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ, জাতীয় হকার্স লীগের সভাপতির কথা লেখা হয়। কিছু এমপি এ ঘটনায় আনন্দিত হয়ে সরকারকে অভিনন্দন জানান। ১০ মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের নাম প্রকাশ করা হয়। মন্ত্রীরা হলেন—বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী, ফণী মজুমদার, মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন, আবদুল মান্নান, মনোরঞ্জন ধর, আব্দুল মোমিন, আসাদুজ্জামান খান। প্রতিমন্ত্রী—শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, দেওয়ান ফরিদ গাজী, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মজুর, কে এম ওবায়দুর রহমান, ড. আজিজুর রহমান মল্লিক, ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী।
১৭ আগস্ট সব পত্রিকাতে মোশতাকের জীবনালেখ্য এবং সৌদি আরব ও সুদানের স্বীকৃতির সংবাদ প্রকাশ করা হয়। জীবনীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার সম্পর্কের সবিস্তার বর্ণনা রয়েছে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি সন্তোষজনক বলে আলোচিত হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর মরদেহ পূর্ণ মর্যাদায় দাফন করা হয় টুঙ্গিপাড়ায়। কোনো পত্রিকা এই সংবাদটিকে গুরুত্ব দিয়ে ছাপায়নি। দেশে যেমন জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দন তেমনি নতুন সরকারের প্রতি লন্ডন প্রবাসী বাঙালিদের সমর্থন জানা যায়। নতুন সরকারের প্রতি মওলানা ভাসানী পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ১৮ আগস্ট তর্কবাগীশ অভিনন্দন জানান সরকারকে। ১৪ আগস্ট ও তার আগের প্রামাণ্যচিত্র ও সংবাদচিত্র প্রত্যাহার করে সরকার। মোশতাকের প্রশংসা করে দৈনিক বাংলার সম্পাদকীয়তে বলা হয় ‘বলিষ্ঠ, বিচক্ষণ বৈদেশিক নীতি; দুর্নীতির সঙ্গে আপোস নেই।’
তিন দিন পরে ১৮ ও ১৯ তারিখের সংবাদে বহির্বিশ্বের স্বীকৃতি ও নিরবচ্ছিন্ন জীবনযাত্রার খবরকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ১৯ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ হচ্ছে, ব্রিটেনের সানডে টাইমসে এন্টনি ম্যাসকারেনহেসের রিপোর্ট অনুসারে বঙ্গবন্ধু সরকারের পতনের তিনটি কারণ হলো—সামরিক বাহিনীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর অবিশ্বাস, ইসলামের অবনয়ন এবং জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া। এ তিনটি কারণই ছিল অসত্য। কারণ বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সেই সময় দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ অন্বেষণ করে বাকশালের কর্মকাণ্ডকে বেগবান করে তোলার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন। আর ইসলামের প্রতি তার ঐকান্তিক নিষ্ঠার কথা ২০১২ সালে প্রকাশিত ‘অসমাপ্ত আ্ত্তজীবনী’ থেকে আরো স্পষ্টভাবে জানা যায়।
২১ আগস্ট রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করার খবর প্রকাশিত হয়। সংবিধানের আংশিক সংশোধনের পরেও পার্লামেন্ট অব্যাহত থাকে; রাষ্ট্রীয় মূলনীতি অপরিবর্তিত রাখা হয়। ’৭২ সালের সংবিধানের রাষ্ট্রপতির ৯নং আদেশ বাতিল করা হয়। (২৩ আগস্ট, ইত্তেফাক) এর আগেই নতুন সরকার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের মারফতে প্রতিশ্রুতি পায় ব্যাপক মার্কিন সাহায্য অব্যাহত থাকবে বলে। খাদ্যশস্য নিয়ে ১৯টি জাহাজ বন্দরে ভিড়ে। ২২ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পায় মোশতাক। অথচ ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের সময় বঙ্গবন্ধু সরকারের সঙ্গে মার্কিনিদের বিরূপ আচরণ সকলের মনে থাকার কথা।
২৫-৮-১৯৭৫ তারিখের সংবাদ থেকে জানা যায় সেনাবাহিনী প্রধান পদে জেনারেল জিয়া নিয়োগ পেয়েছেন। এরশাদেরও পদোন্নতি হয়েছে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ওসমানীকে রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা করা হয়। ৩১ আগস্ট দেখা গেল ‘রাজনৈতিক দল ও কার্যকলাপ নিষিদ্ধ’ করেছে সরকার। ব্রিটিশ পত্রিকা ফিনান্সিয়াল টাইমস ১৬ আগস্ট লিখেছে—দারিদ্র্য, হিংসাদ্বেষ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি প্রভৃতি গুরুতর সমস্যার সমাধানে ব্যর্থতার জন্য সাবেক প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু নিজেই বহুল পরিমাণে দায়ী। এর আগে ৩০ আগস্ট দি টেলিগ্রাফের বরাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পতন সম্পর্কে বলা হয়—শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বিগড়ে দিয়েছিলেন তিনি; যারা তাকে একসময় নেতা বানিয়েছিল। ১৫ থেকে ২৫ তারিখের মধ্যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে মধ্যে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় সূচনার খবর এলো ২৬ আগস্টের পত্রিকায়।
১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের ১৫ তারিখের পরে পত্রিকাগুলো বঙ্গবন্ধুর কথা বলার সময় বার বার বিদেশি পত্রিকার বরাত দিলেও একই সময় সেসব দেশের অনেক ইংরেজি ভাষার পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা করে যে সব সংবাদ প্রকাশিত হয় তা উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকে। দেশের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর শাসনকাল নিয়ে সমালোচনা কিংবা তার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ নিয়েও সংবাদ নেই। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে পরিস্থিতি নিয়ে সকলে উদ্বিগ্ন ছিল। মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণকে জনসাধারণ অভিনন্দন জানায় বলা হলেও মার্শাল ল’-এর মধ্যে মুজিবের অজস্র ভক্ত হয়তো মাঠে নামেনি; কিন্তু অন্তরে রক্তক্ষরণ কি থেমে ছিল?
লেখক :অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যেঃ দৈনিক ইত্তেফাক