855
Published on আগস্ট 15, 2021এম. নজরুল ইসলাম:
১৫ আগস্ট বাঙালীর জাতীয় শোক ও সন্তাপের দিন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের এই দিনে। পরিকল্পনাটি ছিল সুদূরপ্রসারী। শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা নয়, তাঁর আদর্শকেও নির্বাসনে পাঠানোর গভীর ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। ঘাতকের বুলেট সেদিন ধানমন্ডির ঐ বাড়িতে শেখ পরিবারের কাউকে রেহাই দেয়নি। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু বা তাঁর পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি; এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে হত্যাকারীদের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করেছিল, পুরস্কৃত করেছিল। খুনীদের রক্ষা করার জন্য দেশের সংবিধানেও হাত দেয়া হয়েছিল। এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের বিচার রহিত করা হয়েছিল ইনডেমনিটি আইন পাস করার মাধ্যমে।
সেই রাতের কল্পকাহিনী শীর্ষক কবিতায় কবি নির্মলেন্দু গুণ একটি চিত্রকল্প এঁকেছেন-
তোমার ছেলেরা মরে গেছে প্রতিরোধের প্রথম পর্যায়ে,/ তারপর গেছে তোমার পুত্রবধূদের হাতের মেহেদী রঙ,/ তারপর তোমার জম্নসহোদর, ভাই শেখ নাসের,/ তারপর গেছেন তোমার প্রিয়তমা বাল্যবিবাহিতা পত্নী,/ আমাদের নির্যাতিতা মা।
শ্রাবণের শেষরাত ছিল সেটা। সে রাতে কি বৃষ্টি হয়েছিল? সে রাতে কি কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিল আকাশের চাঁদ? জোছনাকে কি গ্রাস করেছিল রাহুর অশুভ ছায়া? কেমন ছিল সে রাতের প্রকৃতি? জানা নেই আমাদের। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যেমন সূর্য ওঠে, তেমনি কি সেদিনের সূর্য একটি সম্ভাবনার কথা বলেছিল? নাকি এক স্বপ্নভঙ্গের বিস্ময়-বেদনা নিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের দিন? আমরা কেউ কি ভাবতে পেরেছিলাম, ১৫ আগস্ট সকালের সূর্য কোন শুভ দিনের সূচনা নয়, একটি বেদনাবিধুর কালো ইতিহাসের জন্ম দিতে যাচ্ছে? বাঙালীর জাতীয় জীবনে অনেক কালো অধ্যায় আছে। কিন্তু ১৫ আগস্ট রাতে রচিত হলো যে কৃষ্ণ অধ্যায়, বাংলার ইতিহাসে তার চেয়ে বেদনার আর কী আছে?
আসলে কেমন ছিল সেই রাত যে রাতে নিহত হলেন পিতা, ঘাতকের নির্মম বুলেটে? নিজের বাড়িতে সপরিবারে নিহত হলেন জাতির জনক। জাতি পিতৃহীন হলো। যে জাতি মাত্র সাড়ে তিন বছর আগে বুকের রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতার সূর্য, সেই জাতিই কলঙ্কিত হলো পিতৃঘাতক হিসেবে। ইতিহাসের এই দায় কি কোনদিন পরিশোধ করা যাবে?
বঙ্গবন্ধু এমন একজন মানুষ যাঁকে তাঁর জীবনের প্রতি পরতে নতুন করে আবিষ্কার করতে হয়। তিনি সেই মানুষ, যাঁর দুই চোখে সবসময় খেলা করেছে বাংলাদেশ। এক সুন্দর, সচ্ছল ও উজ্জ্বল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির চিন্তায় ব্যয় করেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তির পর লন্ডনে দেয়া বিবৃতি ও দিল্লীর পালাম বিমান বন্দরে দেয়া বক্তৃতায় তিনি দেশের মানুষকে সবার উর্ধে তুলে ধরেছেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পা রাখা। এর পর বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতায় তিনি কেবলই দেশ ও দেশের মানুষের কথা বলেছেন। মানুষের কল্যাণে যে জীবন উৎসর্গীকৃত, সেই মহৎপ্রাণ মানুষটি কেবলই মানুষের মঙ্গলের কথা ভেবেছেন। তিনি সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। মানুষের মধ্যে নিজের স্বপ্ন বপন করতে পারতেন।
বঙ্গবন্ধু সাধারণ্যে মিশে সাধারণের মতোই জীবন যাপন করতে চেয়েছেন। নিজেকে কোন ঘেরাটোপে বন্দী করতে চাননি তিনি। মানুষের সঙ্গে মিশতে চেয়েছেন। মানুষের দুঃখ ভাগ করে নিতে চেয়েছেন। দেশের শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়েও তাঁর বাড়িটি ছিল সাধারণ একটি বাড়ি। বাড়ির আটপৌরে পরিবেশের সঙ্গে বাংলার সাধারণ পরিবারের অন্দর মহলের সাযুজ্য। এখানেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অন্যদের তফাৎ। তিনি অসাধারণ হয়েও জীবন যাপনে ছিলেন অতি সাধারণ। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলো পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, তিনি দেশের মানুষকে নিয়েই ভেবেছেন।
১৯৭৫ থেকে ২০২১। ৪৬ বছর অতিক্রান্ত। আরও হাজার বছর যাবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সবসময় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক। তাঁর কথা, তাঁর কাজ অনুসরণের ভেতর দিয়েই তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছিলেন দেশের মানুষের জন্য। নির্যাতন-নিপীড়ন মেনে নিয়েছিলেন মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করেই। তাঁর মতো নিঃস্বার্থ রাজনীতিবিদ বিরল।
এটা স্পষ্ট যে, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনা শুধু ব্যক্তি মুজিবকে হত্যার প্রয়াস ছিল না, ছিল জাতির স্বাধীনতার শক্তিকে হত্যার অপচেষ্টা। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে খুন করে তারা একটি আদর্শকে খুন করতে চেয়েছিল। কিন্তু এ দেশে তা সম্ভব হয়নি, কখনও হবে না। আজকের দিনে বঙ্গবন্ধু অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। মুজিবাদর্শে দীক্ষিত বাঙালী চায় সামনের দিকে এগিয়ে যেতে। যে অন্ধকার দিনের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে, সেই অন্ধকারের পর্দা ভেদ করে ইতিবাচক দিনের যাত্রা শুরু হয়েছে। বাঙালীর অগ্রযাত্রাকে রোধ করা সম্ভব হয়নি, হবে না। বাঙালী শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করেছে। এই বাংলার মাটিতে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার হয়েছে। কার্যকর হয়েছে তাদের শাস্তি।
কিন্তু এখানেই থেমে থাকলে তো চলবে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ তো এখনও গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। তাঁর অসম্পূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব এদেশের প্রতিটি নাগরিকের। দারিদ্র্য দূর করে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে দেশের মানুষের মধ্যে। আগামী প্রজম্নকে গড়ে তুলতে হবে বাঙালী জাতীয়তাবাদের আদর্শে। বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। সেই মুক্তি এখনও অর্জিত হয়নি। কাক্সিক্ষত সেই মুক্তির লক্ষ্যে আমাদের সংঘবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমরা এই মানবপ্রেমী অসাধারণ রাষ্ট্রনায়ককে হারিয়েছি। তিনি বেঁচে থাকলে আজকের বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়ে যেত। বাবার আদর্শের পতাকা বহন করে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশকে নেতৃত্বে দিচ্ছেন। আমাদের ভরসা সেখানেই। জাতি তাঁর যোগ্য নেতৃত্ব আমাদের পৌঁছে দেবে সেই বাংলাদেশে, যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মৃত্যুকে পরোয়া না করে নির্ভয়ে পথ চলার উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। সত্যকে ধারণ করেছিলেন বুকে। আজ ১৫ আগস্ট পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি সেই মহান বাঙালীকে, বিশ্বজুড়ে যিনি বাঙালীর পরিচয়সূত্র।
লেখক : সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়া প্রবাসী, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক
সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকন্ঠ