শোক থেকে শক্তি হোক আমাদের ব্রত

1370

Published on আগস্ট 14, 2021
  • Details Image

ড. আনোয়ার খসরু পারভেজ: 

আগস্ট বাঙালির কাছে শোকের মাস। বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে হারানোর মাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এদিন ভোররাতে ঘাতকের বুলেটে প্রাণ বিসর্জন দেন জাতির পিতা। জাতির পিতার সঙ্গে এসময় আরও হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তাঁদের তিন পুত্র, দুই পুত্রবধু এবং তাঁদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনকে। সেসময়ে ইউরোপে থাকার সুবাদে সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা এবং কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা। ঘাতকের দল হয়তো মনে করেছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যদিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধুর দেখানো স্বপ্ন এবং অসাšপ্রাদায়িক সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে। কিন্তু এটা ছিল সাময়িক। বাঙালি ঘুরে দাড়াতে পারে, সঠিক সিদ্ধান্তে ফিরে আসতে পারে। সেটা বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অকুন্ঠচিত্তে স্বাগত ও বরণ করার মধ্যদিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়। মুজিব মানে একটি প্রতিষ্ঠান, একটি সত্তা, একটি ইতিহাস। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে বঙ্গবন্ধুর নীতি, আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বেড়ে উঠতে পারে, সে লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যšত সময় কালকে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, বাঙালি থাকবে, এ দেশের জনগণ থাকবে, ততদিনই বঙ্গবন্ধু সবার অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন। ‘মিছিলে শ্লোগানে স্বদেশের গান গেয়ে, আমাদের পথ চলা মুজিবের পথ বেয়ে ।’

নিঃশর্তে নিঃস্বার্থে দেশ ও জনগণকে ভালবেসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন আমাদের স্বাধীনতা ও নিজস্ব ভূখন্ড। এটি বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। এ কারণে বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ একই সূত্রে গ্রথিত এবং একটি অন্যটির পরিপূরক। বঙ্গবন্ধুর মর্মস্পর্শী কিছু উক্তির একটিঃ ‘জীবন অত্যšত ক্ষণস্থায়ী। এই কথা মনে রাখতে হবে। আমি বা আপনারা সবাই মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সাথে আর কিছুই নিয়ে যাব না। তবে কেন আপনারা মানুষকে শোষণ করবেন, মানুষের উপর অত্যাচার করবেন? কি চমৎকার দর্শন।’ তাই বঙ্গবন্ধু উত্তর বাঙালি শোককে শক্তিতে পরিণত করতে শিখেছে। জীবিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়ে শহীদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনেক শক্তিশালী। বঙ্গবন্ধু জাতির কাছে অমর এবং চিরঞ্ছীব।

জাতির পিতাকে হারানোর দুঃখের মধ্যে ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রবাস জীবন কাটিয়ে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ, ১৯৭২ জাতীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভাষণে বলেন রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও দরকার। জাতির পিতার দু’টি স্বপ্নের মধ্যে ছিল-বাংলাদেশকে স্বাধীন করা এবং বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলা। প্রথম স্বপ্নটি বঙ্গবন্ধু বাস্তবায়িত করেছিলেন। অপর স্বপ্নটি যখন বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখনই বুলেটের আঘাতে সপরিবারে তাঁকে হত্যা করা হয়। বর্তমানে শেখ হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্বে জাতির পিতার দ্বিতীয় স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে অগ্রসরমান। 

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পুনরায় বিনির্মাণের কাজ। ১৯৯৬ সালে সরকারে এসে মাঝখানে পাঁচ বছর বিরতি দিয়ে ২০০৯ থেকে টানা এগারো বছর সরকার পরিচালনা করে বার বছর পার করতে চলেছেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিষ্ঠা, সততা ও দক্ষতায় উন্নয়নসূচকে বাংলাদেশ আজ বিশে^র অনেক দেশকে টপকে যাচ্ছে। আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানুষের যাপিত জীবনের প্রতিটির সূচকে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা আজ দৃশ্যমান। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন যেমন বলেছেন, ‘সামাজিক-অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। এমনকি সামাজিক কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারত থেকেও এগিয়ে।’ অমর্ত্য সেনের পর্যবেক্ষণমূলক এ মন্তব্য বাংলাদেশ অর্জন করেই থেমে থাকেনি; সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের রপÍানি, রিজার্ভ, রেমিটেন্স এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি। সামাজিক খাতে বাংলাদেশের গড় আয়ু ভারত-পাকিস্তান থেকে বেশি। মাতৃমৃত্যুর হার, শিশুমৃত্যুর হার, জন্মহার ভারত-পাকিস্তান থেকে কম। নারীর ক্ষমতায়নেও শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়; বিশে^র অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে নিম্নমধ্যম’ আয়ের দেশ থেকে ‘মধ্যম’ আয়ের দেশে হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বর্তমান সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় বর্তমানে মহামারি করোনা ভাইরাসকেও মোকাবেলা করতে হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশের জন্য করোনার নানামুখী প্রভাব কাটিয়ে ওঠা কঠিন হলেও বর্তমান সরকার এ পরিস্থিতি ভালোভাবেই মোকাবেলা করছে। করোনায় দেশে এ পর্যন্ত ১৯ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটলেও বিশে^র অত্যধিক জনাধিক্যের দেশ হিসেবে প্রাণহানির সংখ্যা তুলনামূলক কম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বে বাংলাদেশ করোনার ভ্যাকসিন দেশের মানুষের জন্য যেরকম নিখরচায় সহজলভ্য করেছেন, করতে পেরেছেন, তা তৃতীয় বিশ্বে তুলনাহীন। এ বিশ্ব অবাক তাকিয়ে রয়। উল্লেখ করার মতো তথ্য এই যে, এসময় কর্মহীন হয়ে পড়া এবং নিম্মআয়ের মানুষের জন্য সরকারি খাদ্য এবং আর্থিক সহায়তার ফলে সামাজিক সুরক্ষার দিকটি মুখ থুবড়ে পড়েনি।

করোনাকালে সরকারের ওপর নানামুখী চাপ থাকা সত্ত্বেও প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসের পর আবার তা ঘুরে দাঁড়িয়েছে করোনার ঢেউয়ে সারা বিশ্বে প্রতি ৩ জনে ১ জন কাজ হারানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে। সরকার প্রবাসী আয়ের প্রবাহ অব্যাহত রাখা এবং নতুন শ্রমশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা জোরদার করার পাশাপাশি বিদেশগামী শ্রমিকদের দ্রুত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসা হয়।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বিশ^ব্যাপী মহামারি করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চললেও বিশ^ অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশ ভালো করে পর্যবেক্ষকদের নজরে পড়েছে। উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে পর্যবেক্ষকগণ বাংলাদেশের প্রশংসা করছেন। অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল সিকিউরিটি কলেজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ডেভিড ব্রিউস্টার গত ১০ জুন ‘অ ৎরংরহম ইধহমষধফবংয ংঃধৎঃং ঃড় বীবৎঃ রঃং ৎবমরড়হধষ ঢ়ড়বিৎ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এতে ডেভিড ব্রিউস্টার বাংলাদেশের শ্রীলংকাকে ২০০ মিলিয়ন ডলার আর্থিক ঋণ দেয়ার কথা উল্লেখ করার পাশাপাশি আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দারিদ্র্যপীড়িত দেশ সুদানকে এ বছরের জুনে বাংলাদেশী মুদ্রায় ৬৫ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা এবং আফ্রিকার অপর দেশ সোমালিয়ার দারিদ্র্যমুক্তির লক্ষ্যে বাংলাদেশ থেকে ৮ দশমিক ২১ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা দেয়ার তথ্য তুলে ধরা হয়। ভাবতে অবাক লাগে যে, দুই দশক আগেও বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের প্রায় ৯০ শতাংশ বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভর করে প্রণয়ন করা হতো, আজ সেখানে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। আঞ্চলিক আর্থিক প্রভাবশালী দেশ হওয়ার পথে এ মাইলফলক আমাদের গর্ব ও অহংকারের।

একথা বিস্মৃত হয়নি যে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জনের সময় বাংলাদেশকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে উলে¬খ করেছিলেন। আজ বাংলাদেশ ১৭ কোটি মানুষের আত্মবিশ্বাসী হাত-মুখ হেনরি কিসিঞ্জারের অভিমতকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার। যেখানে প্রতিবেশী ভারত হলো ১৯৪৭ ডলার এবং পাকিস্তানের ১৫৪৩ ডলার।
বাংলাদেশের বদলে যাওয়া অর্থনীতির এ যাত্রা শুরু হয় মূলত ২০১১ সাল থেকে। সেসময় বিশ্বখ্যাত মার্কিন দৈনিক পত্রিকা দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রশংসা করা হয়। ২০১২ সালে গ্রেট ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত অর্থনীতি বিষয়ে বিশ্বের শীর্ষস্থানে অবস্থানকারী সাপ্তাহিক পত্রিকা দি ইকোনমিস্টও বাংলাদেশের অর্থনীতি উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক তুলে ধরে বাংলাদেশের অব্যাহতভাবে অনুন্নয়ন ও দারিদ্র্য কাটিয়ে চিত্র উপস্থাপন করে। ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর ব্রিটেনের আরেকটি খ্যাতনামা দৈনিক পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান করে যে, বাংলাদেশ অর্থনীতির সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে ২০৫০ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ইউরোপের প্রধান প্রধান কয়েকটি অর্থনীতিতে শক্তিশালী দেশকে ছাড়িয়ে যাবে।

দক্ষিণ এশিয়ার নব অর্থনৈতিক পরাশক্তি বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করেছেন। তবে ষড়যন্ত্র এখনও শেষ হয় নি। বাংলাদেশ বিরোধী অপশক্তি জোটের ষড়যন্ত্রে রক্তাক্ত পুরো আগস্ট। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, ১৫ আর ২১ আগস্ট একই সূত্রে গাঁথা। অন্ধকারের অশুভ শক্তির পক্ষেই এমন ‘প্রতদিান’ সম্ভব। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে শারীরিক ও মানসিকভাবে সরকারের অংশীজন হওয়া। নিরলসভাবে কাজ করা এবং সরকারের ভালো কাজে সমর্থন দেয়ার মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশকে আমুল বদলে দেয়ার ক্ষেত্রে অংশীজন হতে পারি। ‘বাঙালি তোমাকে চায়, তুমি চাও বাঙালির ভালো; বাঙালি মানুষ হয় বুকে যদি মুজিবের আলো।’ শোক থেকে শক্তি হোক আমাদের ব্রত।

 
লেখকঃ গবেষক ও অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা।
ও প্রেষণে কোষাধ্যক্ষ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত