1036
Published on আগস্ট 6, 2021মো. সাখাওয়াত হোসেন:
সফলতা বিষয়টি খুবই আপেক্ষিক, চোখের সামনে দেখা যায় না বা যার কোন প্রত্যক্ষতা নেই, প্রকৃতপক্ষে প্রত্যয়টি অনুধাবনের, উপলব্ধির। ব্যক্তিবিশেষে সফলতার মাত্রা রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সে হিসেবে সফলতাকে মাপার কোন সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই। যেমন: একজন প্রধানমন্ত্রী হয়েও দেশ সঠিকভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হলে তিনি সফল নন আবার বিপরীতে একজন কৃষক সোনালী ধান উৎপাদন করেই সফলতা অনুভব করে তথা সফল মানুষ। সে হিসেবে চাহিদা এবং কাজের উজ্জ্বল্যের পারস্পারিক মাত্রায় সফলতাকে যাচাই করা যায় অনেক ক্ষেত্রেই।
মোদ্দাকথা হচ্ছে; সততা ও প্রচেষ্টা দ্বারা সময়ের সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে নিজস্ব পরিতৃপ্তি লাভের নামই সফলতা।সফলতার মাপকাঠি ব্যক্তিবিশেষ এবং চাহিদার সামঞ্জস্যের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হয়। একজন সফল মানুষকে আপনি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করতে পারেন। তাই সফলতার কোন যুগপৎ সংজ্ঞায়ন এখনো পর্যন্ত কেউই এককভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি। দৃষ্টিভঙ্গি, ব্যক্তিক চিন্তন ও চাহিদা, সামাজিক পারিপ্বার্শিকতা, সুযোগ-সুবিধা ও অসুবিধা, সরকার ব্যবস্থা ইত্যাদি ফ্যাক্টরগুলো সফলতাকে সংজ্ঞায়নের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে।
সফলতার সংজ্ঞাকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কয়েকজন বিশেষজ্ঞের (বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা প্রতিষ্ঠিত) মতামতকে সামনে রেখে মূল্যায়নের চেষ্টা করা হয়েছে। নিকোলো প্যাডিফিল্ডের মতে, সফলতার জন্য সকলেই ক্ষুধার্ত থাকে কিন্তু সাহসী থাকতে হবে এ ভেবে যে, সফলতাকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা যায়। সুতরাং আপনি যে বিষয়কে সফলতার মাপকাঠি হিসেবে দেখবেন অন্যরা সেটিকে বিবেচনায় নাও নিতে পারেন।
লিনডা কিং এর মতে, সফলতাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু সবথেকে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আপনি কিভাবে আপনাকে মূল্যায়ন করতে পছন্দ করেন তার ভিত্তিতেই সফলতার রূপ নির্ধারিত হয়। রোথ ক্যামেরুন সফলতার সংজ্ঞা দেন এভাবে, কাজের মাধমে সফলতাকে ব্যাখ্যা করা যায় এবং কাজের জায়গায় কিংবা কর্মক্ষেত্রে কর্মদক্ষতার প্রকাশ ঘটানো এবং সেটি খুবই ইতিবাচক হওয়াই সফলতা। জেনিফার হ্রিষ্ট এর ভাষ্যানুযায়ী, কাজের গুণগত মান এবং তদ্দ্বারা অন্যদের উপকার করার ইচ্ছার ফলপ্রসূ ঘটার নামই সফলতা। কাজেই সফলতার কোন সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই, থাকাও বাঞ্ছনীয় নহে।
সুতরাং, সফলতা হচ্ছে আপনি যে কাজই করুন না কেন তা হতে হবে খুবই যৌক্তিক এবং প্রাসঙ্গিক কিংবা যদি আপনার বিভিন্ন সেক্টরের সংযুক্তি ইতিবাচক অথবা আপনি আপনার মনের ভেতরের সুপ্ত বাসনাকে প্রত্যক্ষে রূপান্তরিত করার প্রয়াসে জয়ী হন তাহলেই আপনি সফল। আলোচ্য নিবন্ধে শেখ কামালের জীবনকে যথাযথ ও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের মাধ্যমে তার কর্মপরিধিকে তুলে ধরা হয়েছে এবং বিবেচনার মাধ্যমে যথোক্তি করা হয়েছে।
লেখক হিসেবে আমি মাধ্যমিক (সেকেন্ডারী) উপাত্তের মাধ্যমে বিস্তর পাঠাভ্যাস করে বিষয়টিকে মূল্যায়নের চেষ্টা করেছি বাকিটা পাঠকের মতামতের মাধ্যমে আরো তথ্যনির্ভর, প্রাঞ্জল ও ঐতিহাসিক হিসেবে গুরুত্ব পাবে সব মহলের কাছে। ব্যক্তি হিসেবে শেখ কামালের কাজের পরিধিকে নিবন্ধে তুলে ধরে আনা হয়েছে এবং তার কাজের সবগুলো সেক্টরকে বিবেচনায় নিয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর নানামুখী পর্যায়কে সামনে নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। নিম্নলিখিত সেক্টরের মাধ্যমে শেখ কামালকে মূল্যায়ন করার প্রয়াস পেয়েছি।
১. মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ (দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ মাপকাঠি)
২. সাংগঠনিক দৃঢ়তা (ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দায়িত্ব পালন)
৩. খেলাধূলার প্রসার ও দক্ষ নেতৃত্ব (সামষ্টিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ)
৪. সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পদচারণা (নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক)
৫. মেধাবী ছাত্র (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র)
৬. অমায়িক ব্যবহার (সকলের সাথে মেশার অসাধারণ যোগ্যতা ও সহিষ্ণু আচরণের অধিকারী)
একটা মানুষকে যতটা দিক থেকে মূল্যায়নের সুযোগ থাকে তার সবকটিতে শেখ কামালের উজ্জ্বল অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতই অন্যদিকে নিন্দুকের চোখে ছিল হিংসার প্রলাপ। ছেলেবেলা থেকেই সব প্রোঅ্যাক্টিভ ও ইতিবাচক কাজের সাথে শেখ কামালের ছিল প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ বিশেষ করে যে কাজগুলিতে তার অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল। খেলাধূলা, পড়াশোনা, সঙ্গীতচর্চা, অভিনয়, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা, সংগঠক, রাজনীতি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের সহিত অংশগ্রহণ শেখ কামালকে অন্য সবার থেকে সহজেই আলাদা করতে পেরেছিল, নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। নিজ যোগ্যতা বলে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে সদিচ্ছা, সদ্ভাব এবং প্রবল ইচ্ছাশক্তির বলে বলীয়ান হয়ে একজন ব্যক্তি সর্বগুণে গুণান্বিত হয়ে দেশমাতায় আত্ননিয়োগ করতে পারেন এবং অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন।
জন্ম ও পিতা-মাতার পরিচয়
শেখ কামাল ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট তারিখে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর মাতা হলেন বাংলার দুঃখী মানুষের আশ্রয়স্থল বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। খুব ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন তিনি। পিতা জেলে থাকায় ছোট বয়সে বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। কেননা, তার পিতা বাঙালির মুক্তির জন্য সর্বদাই আন্দোলন সংগ্রামে ব্যস্ত ছিলেন। তাই, সাংসারিক জীবনের ব্যয়িত সময়ের তুলনায় কারাগারকেই স্থায়ী আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এমন ও অনেক সময় হয়েছে যখন দেখা গেছে পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে জেলখানায় বাবার সাথে সাক্ষাত করতে গিয়েছেন কিন্তু কথা বলার জন্য বড় বোনের অনুমতি চেয়েছেন শেখ কামাল অর্থাৎ বাবার সাথে খুব কম দেখা সাক্ষাত হত।
নিরহংকারী ও স্বাভাবিক জীবনাচরণ
পিতৃপরিচয় কখনো তাকে অহংকারি কিংবা অন্যদের থেকে আলাদা করতে পারেনি। সকলের সাথেই অমায়িক ব্যবহারের মাধ্যমেই মিশতেন; কখনো বুঝতে দিতেন না তিনি বাংলার রাজাধিরাজ, স্বাধীন বাংলার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সন্তান। বিশিষ্ট সাংবাদিক পাভেল রহমানের ভাষ্যমতে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার স্মৃতিচারণা বর্ণনা করে তিনি বলেন ”আবাহনী ক্লাবের পক্ষে ফুলের মালা পরিয়ে প্রথমেই শুভেচ্ছা জানালেন কামাল ভাই। তারপর অন্যরা।
বিজ্ঞাপন
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল ভাই ছিলেন আমাদের সঙ্গে। আমি ছবি তুলছি ৩৫ মিমি ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্সে। বঙ্গবন্ধু সবার সঙ্গেই হাত মেলাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে বিখ্যাত সব খেলোয়াড়ের সঙ্গে কৌতুক করছেন। অনুষ্ঠানের শেষে ঘটল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম ঘটনা। কামাল ভাই আমার নাম ধরে ডাকলেন। সামনে বঙ্গবন্ধু। আমাকে নিশ্চয়ই ছবি তোলার জন্য ডাকছেন। কামাল ভাই অনেকটা ঠেলে দিলেন আমাকে বঙ্গবন্ধুর দিকে। বললেন, ‘আব্বা, ওর নাম পাভেল! ও আমাদের আবাহনীর ফটোগ্রাফার। ‘
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়! বঙ্গবন্ধু কামাল ভাইয়ের কথায় বিস্মিত, ‘তোদের আবাহনীতে ফটোগ্রাফারও আছে নাকি?’ কামাল ভাই বললেন, ‘হ্যাঁ আছে। ওর নাম পাভেল।’ বঙ্গবন্ধু ততক্ষণে আমার হাত ধরে কাছে টেনে নিয়েছেন। বিস্মিত বঙ্গবন্ধু বলে উঠলেন, ‘বাহ, কী চমৎকার নাম!’ আমার হাত তখন বঙ্গবন্ধুর হাতে। আমি এতটাই হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম যে কোনো কথাই বলতে পারলাম না।” এমনি ছিলেন শেখ কামাল, সাধারণের মধ্যে ও সাধারণ; সকলকে কাছে টানার এক অপার মোহনীয় শক্তি ছিল শেখ কামালের মধ্যে। ভাই, বন্ধু, গুরুজন, আত্নীয়স্বজন, রাজনৈতিক সহযোদ্ধা, কর্মক্ষেত্রে সহযোগী সকলের সাথেই পরিবেশ পরিস্থিতি বজায় রেখে সম্পর্ক সৃষ্টি করেছিলেন।
ক্রীড়ামোদি এবং ক্রীড়া সংগঠক
স্কুলে পড়াকালিন সময়ে প্রতিটি খেলায় তিনি ছিলেন একজন পেশাদার চরিত্রের অধিকারী। ঢাকার শাহিন স্কুলে পড়াকালিন সময়ে তার ক্রীড়া নৈপুন্যের প্রদর্শনী ছিল চোখে পড়ার মত। তবে ক্রিকেটের প্রতি অন্যরকম ভাল লাগা ছিল শেখ কামালের। কিন্তু পাকিস্তান ক্রিকেটে কখনো সুযোগ পেতেন না একমাত্র বাঙালি এবং বাংলার মানুষের নেতা শেখ মুজিবের ছেলে হওয়ার কারণে। জুয়েল, রকিবুলদের মতো ক্রীড়ানৈপুন্য প্রদর্শন কারী অনেক ক্রীড়াপ্রেমীদের মতই অবহেলিত হতে হয়েছে শেখ কামালকে। সব খেলাতেই তার উজ্জ্বল অংশগ্রহণ উপস্থিত দর্শকদের তাক লাগিয়ে দিতো। ক্রীড়ানৈপুণ্যে তিনি ছিলেন অনন্য প্রতিভার অধিকারী।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের শুরুর পূর্বেই তরুণ সংগঠক হিসেবে সকলের নজর কাড়তে সক্ষম হন শেখ কামাল। ১৯৬৯ সালে তিনি আবাহনী সমাজ কল্যাণ সমিতির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন যা বর্তমানে আবাহনী লিমিটেড। তার পূর্বে তিনি ধানমন্ডি ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন ১৯৬৮ সালে। ক্রীড়াঙ্গনে যে শেখ কামালের অবদান তা কিন্তু একদিনে গড়ে উঠেনি, এর সাথে তথা এর পরিবারের সাথে তিনি নিবিষ্ট চিত্তে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সে সময়ের জীবিত ক্রীড়ামোদিরা শেখ কামালেরে স্মরণে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৫ মার্চের রাত্রিতে পরিবার পরিজন ছেড়ে দেশ-মাতৃকার টানে পাড়ি জমিয়েছিলেন অজানার উদ্দেশে। পরিবারকে নিশ্চিত বিপদে ফেলে রেখে মরণকে আপন করে নিয়ে মহান মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট শেখ কামাল এমএজি ওসমানির এডিসি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে পরিবার এবং নিজের চিন্তার কথা বাদ দিয়ে দেশমাতার টানে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মে মাসের প্রথম দিকে তৎকালিন ছাত্রলীগ নেতা শেখ শহিদুল ইসলামের সাথে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি, মকসুদপুর, যশোর হয়ে ভারতে পৌঁছে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। একজন চৌকস যোদ্ধা হিসেবে রণাঙ্গণে তিনি প্রতিভার জলন্ত দৃষ্টান্ত রাখতে সমর্থ হোন। কয়েকটি সরাসরি যুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দেন এবং অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশনা দিয়ে যুদ্ধের দিকনির্দেশনার মাত্রা ত্বরান্বিত করতে সফল ভূমিকা পালন করেন।
শেখ কামাল সমন্ধে প্রথিতযশা/সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য
প্রয়াত প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ আবুল ফজল তার লেখায় শেখ কামালের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদানের প্রাক্কালে শেখ কামালের সাথে কাটানো সময়ের মধুর স্মৃতিচারণ তুলে নিয়ে এসেছেন লেখনির মাধ্যমে। অল্প কথার মাধ্যমে বক্তব্যের গভীরতায় প্রাতিস্বিক ছিলেন শেখ কামাল। চট্রগ্রাম থেকে এয়ারপোর্ট হয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের পর আবার বিমানবন্দর পর্যন্ত নিজে গাড়ি চালিয়ে শেখ কামাল আবুল ফজলকে পৌঁছে দেন। ইত্যবসরে অর্থাৎ একদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করে আবুল ফজল শেখ কামালের চারিত্রিক দৃঢ়তা, কাজের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব, কোন কাজকেই ছোট করে না দেখার মানসিকতা ইত্যাদি মানবিক গুণের কারণে সহজেই ব্যক্তি কামালকে অন্যদের থেকে আলাদা করতে পেয়েছিলেন।
ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে আবার এয়ারপোর্টে পৌঁছেয়ে দেওয়ার পথিমধ্যে কয়েকবার দেখা সাক্ষাৎ ও কথোপকথনে স্বল্পভাষী শেখ কামালের উচ্চাশা করতে দ্বিধা করেননি প্রথিতযশা এ লেখক ও শিক্ষাবিদ। এয়ারপোর্টে লেখকের ব্যাগ সরবরাহ করেছেন অন্যদের মত লাইনে দাঁড়িয়ে নিয়মানুযায়ী সাধারণ যাত্রীদের মতোই। রাষ্ট্রপতির ছেলে হিসেবে দাম্ভিকতা কিংবা তার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেননি।
বর্তমান সময়ে রাজনীতিবিদদের সরকারে থাকাবস্থায় তাদের নিকটাত্মীয়ের যে অহংবোধ দেখা যায় তা কল্পনাতীত। কয়েকবারের কথোপকথনে একবারের জন্য ও পিতৃপরিচয় দেবার প্রয়োজন বোধ করেননি। নিজের উপর অর্পিত দায়িত্বকে নিবিষ্ট মনে দায়িত্ব পালন করাকেই নিজের ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। আবুল ফজলের প্রশ্নের ধারা অনুযায়ী যথাযথ উত্তর দেন, এর বাইরে একটিও বেশি কথা বলেননি তিনি। এ রকম স্বল্পভাষী ও যৌক্তিক মানুষ ছিলেন শেখ কামাল।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মো. রকিবুল হাসানের সাথে শেখ কামালের ঘনিষ্ঠতা ছিল। বাল্য বন্ধু থেকে পরবর্তীতে ক্রিকেট মাঠে আরো ঘনিষ্ঠতা শুরু হয়। রকিবুল হাসানের এতদূর উঠে আসার পেছনেও শেখ কামালের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা ছিলো। পাকিস্তান ক্রিকেট দলে তৎকালিন পূর্ব বাংলা থেকে জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন রকিবুল হাসান। ১৯৭১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন: পাকিস্তানিদের দেওয়া হয়েছিল ইংলিশ গ্রে নেকলসের ব্যাট এবং রকিবুল হাসানকে গান এন্ড মুর কোম্পানির ব্যাট সরবরাহ করেছিল। বৈষম্য যেমন সব জায়গায় ছিল তেমনি ছিলো খেলার মাঠেও, বঙ্গবন্ধুর সন্তান এবং বাঙালি হওয়ার কারণে শেখ কামাল জাতীয় দলে সুযোগ পায়নি কিন্তু ক্রিকেটে তার দক্ষতা ছিল প্রশংসার দাবিদার।
২৬ ফেব্রুয়ারির দিনেই রকিবুল হাসান চেয়েছিলেন তার ব্যাটে জয় বাংলার স্টিকার লাগিয়ে খেলবেন। কাকতালীয়ভাবে শেখ কামাল রকিবুল হাসানের সাথে সাক্ষাৎ করতে হোটেল পূর্বাণীতে যান এবং নিজের ইচ্ছের কথা শেখ কামালের কাছে বর্ণনা করেন রকিবুল হাসান। তাঁর আগ্রহের কথা শোনে তৎক্ষণাৎ ডা: মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের মাধ্যমে জয় বাংলার স্টিকার সংগ্রহ করে ব্যাটে লাগিয়ে দেন শেখ কামাল। এমন ক্রীড়ানুরাগী এবং ক্রীড়ামোদিদের প্রতি ভীষণ আগ্রহের কারণে শেখ কামাল দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ব্যাপক সমাদর লাভ করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য শেখ কামালের অন্ত:নি:সৃত ভালবাসা পরিত্যক্ত পরিবারগুলোর জন্য বেঁচে থাকার শক্তি সঞ্চার করেছিলো। মুক্তিযুদ্ধকালিন সময়ের বাস্তবতা বিবেচনায় এবং নিজে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় বিষয়গুলো অন্তদৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সকলের বোঝার সুবিধার জন্য একটি ঘটনার উদাহরণ তুলে ধরছি। এ রকম অসংখ্য পরিবারকে শেখ কামাল সহযোগিতা করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক মধুর ক্যান্টিনের সত্ত্বাধিকারী মধুদা’কে নির্মমভাবে হত্যা করে।
বেঁচে থাকা একমাত্র ছেলে অরুণ কুমার দে শেখ কামালের অবদানের কথা বিশেষভাবে তুলে ধরেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে শেখ কামাল অরুণকে খোঁজে বের করে তাঁর সকল দায়-দায়িত্ব নেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত শেখ কামাল অরুণের পাশে ছায়া হয়ে ছিলেন। এ রকম অসংখ্য পরিবারের পাশে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন শেখ কামাল। তাঁর দূরদর্শিতার প্রেক্ষিতে যুদ্ধাহত অনেক মুক্তিযোদ্ধার পরিবার সাহস শক্তি সঞ্চার করতে পেরেছিলেন।
উপর্যুক্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের মাধ্যমে ইহাই প্রতীয়মান হয় যে, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শেখ কামাল ছিলেন দেশ ও জাতির অমূল্য সম্পদ। তাঁর ব্যক্তিত্ব, বিচক্ষণতা, দেশপ্রেম, সাংগঠনিক দৃঢ়তা, মহানুভবতা, ক্রীড়ানুরাগী, সাংস্কৃতিক উজ্জ্বলতা বর্তমান প্রজন্মের নিকট আদর্শ হিসেবে পরিগণিত হবে। বর্তমান প্রজন্মেরও উচিত শেখ কামালের চারিত্রিক দৃঢ়তাকে নিজের মধ্যে বপন করা। শেখ কামালের গুণাগুণ ও কর্মপরিচায়ক নিয়ে বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
স্বল্প আলোকে শেখ কামালের চরিত্র খানিকটা তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে বৈকি। প্রকৃতঅর্থে, শেখ কামাল ছিলেন বাংলার আকাশের ধ্রুবতারার মতো উজ্জল আলোকবর্তিকা। এত অল্প কথায় তার কর্মপরিধিকে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। স্বল্প পরিসরের জীবদ্দশায় সবটুকুই তিনি কাজে লাগাতে সমর্থ হয়েছিলেন। ইতিহাসের পাতায় যুগ যুগ ধরে গবেষকের গবেষণার উপাত্ত হিসেবে শেখ কামালের জীবনকাল ব্যবহৃত হবে নি:সন্দেহে।
সৌজন্যেঃ চ্যালেন আই অনলাইন