1162
Published on জুলাই 1, 2021সুভাষ সিংহ রায়ঃ
১৯০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর মোহামেডান এডুকেশন কনফারেন্সের ২০তম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায়। সংগঠনের প্রতিষ্ঠার পর সেটি ছিল একটি ঐতিহাসিক সম্মেলন। সেখানে উপমহাদেশের বিপুল সংখ্যক খ্যাতিমান মুসলিম নেতা অংশ নেন। ওই সম্মেলনই জন্ম দেয় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ- যার নেতৃত্বে ৪০ বছর পর প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান, পূর্ববঙ্গের সেই ভূখণ্ডে, যেখানে গঠিত হয়েছিল ১৯০৫ সালের নতুন প্রদেশ। সম্মেলনে ভাষণ দানকালে কনফারেন্সের অনারারি জয়েন্ট সেক্রেটারি ব্যারিস্টার খান সাহেবজাদা আফতাব আহমেদ ‘ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়’ এর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে তা প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। এ অঞ্চলের কোনও কোনও হিন্দু নেতাও মুসলমানদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন। পত্রপত্রিকা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, স্বল্পকাল স্থায়ী পূর্ববঙ্গ ও আসামের প্রাদেশিক সরকার তার রাজধানী ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করে ১৯০৯-১০ অর্থবছরে। প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাব্যতা যাচাই করে পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আরও দু-চারজন যোগ করে ১৯১২ সালের ২৭ মে ব্যারিস্টার রবার্ট নাথানকে প্রধান করে গঠন করা হয় ১৪ সদস্য বিশিষ্ট ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি কমিটি’। এ কমিটিতে ছিলেন ছয়জন ব্রিটিশ, চারজন মুসলমান ও চারজন হিন্দু। ১৯১০ সালের ৫ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ ও আসাম আইন পরিষদের সদস্য অনঙ্গমোহন সাহা ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি করেন।
বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক প্রয়াত সৈয়দ আবুল মকসুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে মোট তিনটি বই লিখেছেন। এ বই তিনটি হচ্ছে- ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা’, ‘স্যার ফিলিপ হার্টগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য’ ও ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হল’। এখানে অনেক বিষয় উঠে এসেছে। আমরা জানি, ১৯২১ সালের ১ জুলাই তিনটি আবাসিক ছাত্রাবাস ‘মুসলিম হল’, ‘ঢাকা হল’ ও ‘জগন্নাথ হল’ নিয়ে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়।যে তিনটি ছাত্রবাস নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদর্শ আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রূপে বিকাশ লাভের পথে যাত্রা শুরু করে সেগুলির প্রতিষ্ঠার পেছনে ইতিহাস রয়েছে। ছাত্রাবাস তিনটির নামের তাৎপর্যের মধ্যেই কেবল তারতম্য রয়েছে তাই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান হিসেবে এগুলোর সৃষ্টির ক্ষেত্রেও পার্থক্য আছে। জন্মের দিক থেকে ‘ঢাকা হল’ যে রাজধানী শহর ঢাকা তথা একটি স্থানীয় সরকারী কলেজের সাথে সংশ্লিষ্ট এটা বোঝাই যায়। তেমনি ‘জগন্নাথ হল’ একজন মহানুভব ব্যক্তির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি বেসরকারী কলেজের সাথে জন্মসূত্রে সম্পর্কিত তারও সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বিদ্যমান। আর ‘মুসলিম হল’ পূর্ববঙ্গের অনগ্রসর মুসলিম জনগোষ্ঠীকে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রসর করে নেবার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। অতএব দেখা যাচ্ছে, ঢাকা হল ও জগন্নাথ হলের মতো মুসলিম হলের বিশেষ কোন প্রতিষ্ঠানগত পটভূমি নেই। সে কারণে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন কলেজ থেকে আসা (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে মূলত ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজ থেকে) মুসলিম ছাত্রদের মুসলিম হলে ভর্তি করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে-সঙ্গেই স্থাপিত জগন্নাথ হলের তিনজন প্রভোস্ট ড. নরেশচন্দ্র গুপ্ত, প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার ও ড. হরিদাস ভট্টাচার্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। ১৯২৬-এর ১০ ফেব্রুয়ারি, ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রভোস্ট থাকাকালীন জগন্নাথ হলে তার আগমনও ছাত্রদের অনুরোধে তাদের স্মরণিকা ‘বাসন্তিকা’র জন্যে লেখা ‘এই কথাটি মনে রেখো’ গানটি এক অবিস্মরণীয় স্মৃতির অংশ। মূল পাণ্ডুলিপি ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার কর্তৃক সংরক্ষিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলে রবীন্দ্রনাথকে অভ্যর্থনা দেওয়া হয়। রমেশচন্দ্র মজুমদারের বর্ণনায়-
মুসলিম হলের ছাত্রসভায় রবীন্দ্রনাথের অভ্যর্থনা। তিনি ও আমি ফরাসের উপর বসেছি। উপরের বৈদ্যুতিক পাখাটি যেই খোলা হল অমনি তাঁর মাথায় বড় বড় গাঁদা ফুল পড়তে লাগল। আমাকে বললেন; ‘কালিদাস বর্ণনা করেছেন যে ফুলের মালা মাথায় পড়ায় ইন্দুমতীর মৃত্যু হল। এটা কি করে হতে পারে আমার মনে এই একটা সমস্যা ছিল।- আজ তা সমাধান হল- দেখছি ফুলের আঘাতেও মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে’। (‘কবিস্মৃতি-রবীন্দ্রনাথ: বেতার জগৎ’ ২২ এপ্রিল ১৯৭৩)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথের ঢাকা যাওয়া ও সেখানে বক্তৃতাদান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেদিনের ছাত্র, পরবর্তীতে বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রবন্ধকার ও ঔপন্যাসিক আবুল ফজলের অভিব্যক্তি:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে গোটা দুই বক্তৃতা দিতে রবীন্দ্রনাথ এলেন ঢাকায়। বহুকাল আগে তখনকার এক প্রাদেশিক সম্মেলন উপলক্ষে তিনি আর একবার নাকি ঢাকা এসেছিলেন। তখন কবির যৌবন-মধ্যাহ্নে। এবার যখন এলেন তাঁর বয়স ষাটের উপর। পক্ককেশ, পক্কশ্মশ্রু। কিন্তু দেহবর্ণ কাঁচা সোনাকেও হার মানায়। দীর্ঘ দেহের সঙ্গে দীর্ঘ শ্বেত কেশরাশি ও সুদীর্ঘ রূপালী শ্মশ্রুর সে এক অপূর্ব সমাবেশ! যে দেহকে ঘিরে এক অপূর্ব মনীষা নানাভাবে শাখায়িত ও পল্লবিত হয়েছে অর্ধশতাব্দীরও ঊর্ধ্বকাল-সেই অপূর্ব দেহ-সৌন্দর্য এই প্রথম চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য হল আমাদের। এ সৌভাগ্য জীবনে ভুলবার নয়। স্মরণ হল সঞ্জীবচন্দ্রের স্মরণীয় উক্তিÑ‘মানুষ বৃদ্ধ না হইলে সুন্দর হয় না।’ রবীন্দ্রনাথকে দেখার পর মনে হয়েছে সঞ্জীবচন্দ্র কিছুমাত্র অত্যুক্তি করেননি। (রেখাচিত্র)
‘বাসন্তিকা’র আর একটি সংখ্যা উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর প্রকাশিত সে সংখ্যার সূচনা হয়েছিল ‘রবীন্দ্র প্রয়াণে’ নামে একটি লেখা দিয়ে; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অধ্যাপক ড. আশুতোষ ভট্টাচার্যের লেখা প্রবন্ধ ‘রবীন্দ্রনাথের শেষ নাটক’ এবং ‘সাহিত্যসন্দর্শন’ খ্যাত শ্রীশচন্দ্র দাশের প্রবন্ধ ‘রবীন্দ্রকাব্যে জীবনদেবতা’ যুক্ত হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল রবীন্দ্র-প্রয়াণে শোকসভা, যেখানে দাবি উঠেছিল বাংলাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি ভাষারূপে গ্রহণের। ১৯৩৬-এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক রবীন্দ্রনাথকে ডি লিট উপাধি দান।
কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্কের সূত্রপাত দুজন ব্যক্তি অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিলেন- ড. নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত ও বিশ্ববিদ্যালয়েরই আর এক অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহার হোসেন। ড. নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত-র সঙ্গে নজরুলের ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। জগন্নাথ হলে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। নরেশচন্দ্র নিজেও ছিলেন সাহিত্যশিল্পী, ঔপন্যাসিক (‘অগ্নিসংস্কার’, ‘দ্বিতীয় পক্ষ’, ‘শুভা’ প্রভৃতি তাঁর উপন্যাস), তার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল একটি লেখকগোষ্ঠী। তবে কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে গভীর আত্মিক সম্পর্ক নজরুলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন করেছিল।
কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজের সম্পাদক। ১৯২৮-এর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নজরুল এর দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে এলেন, প্রথমে ওঠেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলের হাউস টিউটর অধ্যাপক সৈয়দ আবুল হোসেনের বাড়িতে। সেখানে বসে রচনা করেন ‘চল্ চল্ চল্’ গানটি, যা আজ বাংলাদেশের রণ-সংগীতরূপে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। গানটি তিনটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল: ‘শিখা’ (মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র), কলকাতার ‘সওগাত’ এবং বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্ত সম্পাদিত ‘প্রগতি’তে। কার্জন হলে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম সমাজের বার্ষিক অধিবেশনে (সভাপতিত্ব করেন হাকিম হাবিবুর রহমান) উদ্বোধনী সংগীত (আসিলে কে গো অতিথি) গেয়েছিলেন নজরুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতশাস্ত্রের সম্মিলিত এমএ পরীক্ষার প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকারিণী ফজিলতুন্নেসার প্রতি নজরুল প্রেমাসক্ত হন, কাজী মোতাহার হোসেনের মাধ্যমেই তাদের পরিচয় হয়েছিল। ফজিলতুন্নেসার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়, নজরুলের সেই প্রেমও ছিল তার নিজের দিক থেকে একপক্ষীয়। তবে এ প্রেমসম্পর্ক নিয়ে তার বেশ কিছু কবিতা-গান রচিত হয়েছে। নজরুলের ব্যক্তি কবিজীবনের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের- পর্বটি যুক্ত ১৯৭২-এর ২৪ মে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে নজরুলকে ঢাকায় আনা হয়। ১৯৭৪-এর ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে কবিকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি দেওয়ার কথা বলা হয়। ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি বঙ্গভবনে আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে সেই ডিগ্রি পত্রটি কবির হাতে তুলে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতি মাহমুদুল্লাহ। ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ নজরুলের মৃত্যুর পর তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়।
রবীন্দ্র-প্রভাবমুক্ত কবিদের মধ্যে মোহিতলাল মজুমদার বিষয় ও রীতি উভয়দিক থেকে বাংলা ভাষার এক নতুন কবি। ১৯০৮-এ বিএ পাশ করে দীর্ঘদিন ছিলেন স্কুল-শিক্ষক। তারপর ১৯২৮-৪৪ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপক পদে নিযুক্ত ছিলেন।
রবীন্দ্র-পরবর্তী ‘আধুনিক কবিতা’র কর্ণধার বস্তুত বুদ্ধদেব বসু। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র। তার শৈশব কুমিল্লায়, কৈশোর নোয়াখালী, যৌবনের প্রথম ভাগ কাটে ঢাকায়। ঢাকার কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন (১৯২৫), ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যামিক (১৯২৭), তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি স্নাতক (১৯৩০) সম্মানে রেকর্ড পরিমাণ নম্বর এবং স্নাতকোত্তর (১৯৩১)।
তার ‘আমার যৌবন’ (১৯৭৬) আত্মজৈবনিক গ্রন্থটির অনেক অংশজুড়ে তার কবিজীবনের এ অধ্যায়ের নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। যেমন, তার বর্ণনায় প্রথম যুগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়:
ভিতরে বাইরে জমকালো এক ব্যাপার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নিখিল বাংলার একমাত্র উদ্যান-নগরে পনেরো কুড়িটি অট্টালিকা নিয়ে ছড়িয়ে আছে তার কলেজ বাড়ি, ল্যাবরেটরি, ছাত্রাবাস-ফাঁকে ফাঁকে সবুজ মাঠ বিস্তীর্ণ। ইংলন্ডদেশীয় পল্লী কুটিরের মত ঢালু ছাদের এক-একটি দোতলা বাড়ি- নয়নহরণ, বাগানসম্পন্ন: সেখানে, কর্মস্থলের অতি সন্নিকটে বাস করেন আমাদের প্রধান অধ্যাপকেরা: অন্যদের জন্যও নীলক্ষেতে ব্যবস্থা অতি সুন্দর। স্থাপত্যে কোনো একঘেঁয়েমি নেই, সরণি ও উদ্যান রচনায় নয়া দিল্লির জ্যামিতিক দুঃস্বপ্ন স্থান পায়নি। বিজ্ঞানভবনগুলি আরক্তিম ও তুর্কি শৈলীতে অলঙ্কৃত। অন্যান্য বিভাগ স্থান পেয়েছে একটি বহুপক্ষযুক্ত দীর্ঘকার সাদা দোতলার একতলায়-সরকারী সেক্রেটারিয়েট হবার জন্য তৈরি হয়েছিল বাড়িটি। সর্বত্র প্রচুর স্থান, ঘেঁষাঘেঁষি ঠেলাঠেলির কোনো কথাই ওঠে না।
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁর নানা স্মৃতির মধ্য থেকে উঠে আসা একটি অংশ:
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের দ্বিতীয় রঁদেভু, আদিত্যের দোকানটি বড়ো দরিদ্র। কম্পাউন্ডের এক প্রান্তে টিনের চালওলা দর্মার ঘর, ভিতরে মলিনবর্ণ টেবিলের পাশে লম্বা ন্যাড়া টুল পাতা: এখানেই আমরা ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ করে থাকি, যেহেতু সারা তল্লাটে দ্বিতীয় কোনো চা-ঘর নেই। আদিত্যের ভোজ্য তালিকা অতি সীমিত, কোনো কোনোদিন তার স্বহস্তে প্রস্তত মিষ্টান্ন ছাড়া আর কিছুই সে দিতে পারে না চায়ের সঙ্গে; কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না আমাদের, গদ্য-পদ্য সমস্ত খাদ্যেই আমাদের পক্ষে উপাদেয় ও সুপাচ্য, সেগুলির রাসায়নিক গুণাগুণ নিয়ে চিন্তিত হবার মতো দুর্দিন তখনও বহুদূর। আমরা জুটি সেখানে বন্ধুর দল- টুলু অমল, পরিমল।
অবিভক্ত বাংলার কবি জসীমউদ্দীন সমকালীন কাব্যের নাগরিক জীবনযন্ত্রণা ও পাশ্চাত্যানুসারী পথের বাইরে এসে সমগ্র বাংলা কাব্যে নতুন ধারার সূত্রপাত করেন। তার ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ ও ‘সোজনবাদিয়ার ঘাট’ অসাম্প্রদায়িক বাঙালি লোকজীবনের পূর্ণাঙ্গ কাব্য। তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, ছাত্র হিসেবে নয়, অধ্যাপক হিসেবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ। ১৯৩৮-এ ঢাকায় আসেন, যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে লেকচারারের পদে। ১৯৪৪ পর্যন্ত সেখানে তার অধ্যাপনা জীবন, তারপর সরকারি চাকরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা স্নাতকোত্তর স্তরে জসীমউদ্দীনের কাব্য স্পেশাল পেপারের গুরত্বপূর্ণ পাঠ্যসূচি। আজীবন তিনি ছিলেন প্রগতিশীল, নির্লোভ, রবীন্দ্র-নজরুল-কাব্যাদর্শের প্রতি অবিচল। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু নিয়ে জসীমউদ্দীনের কাব্যগ্রন্থ ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে’ পাঠ না করলে তার কবিপরিচয় অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গে তুলনামূলকভাবে তখনকার দিনে উচ্চ জাতি-বর্ণভুক্ত অমুসলমান ছাত্রের সংখ্যা বেশি থাকায় তাদের শিক্ষা ও বাসস্থানের জন্য দুইটি হলের ব্যবস্থা করা হয়। সে দুইটি ছাত্রাবাস হচ্ছে ঢাকা হল ও জগন্নাথ হল। মূলত ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের Post Intermediate শ্রেণির ছাত্রদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাস শুরু হয়। ঢাকা কলেজ থেকে আগত ছাত্ররা যেখানে থাকার সুযোগ পায় তা ‘ঢাকা হল’ নামে অভিহিত হয়। অর্থাৎ ঢাকা কলেজ আংশিকভাবে কার্যত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে absorbed হয়ে যাওয়ায় ‘ঢাকা হল’ নামে একটি ছাত্রাবাসের সৃষ্টি হয়।
জগন্নাথ হলের প্রথম প্রাধ্যক্ষ নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্তের এরূপ উদারনৈতিক ভূমিকার কারণ হল, তিনি তার সমকালীন বাংলাদেশের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির চেয়ে প্রগতিশীল চিন্তাধারার অধিকারী ছিলেন। তিনি সময়ের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন। তার ‘আত্মকথা’য় বর্ণিত কয়েকটি প্রমাণ নিচে দেওয়া যেতে পারে। বঙ্গবিভাগের অনেক আগেই তিনি Indian World এ একটি প্রবন্ধে বাংলার নদনদীগুলোকে সংস্কার করে দেশের জনস্বাস্থ্য ও কৃষির স্থায়ী উন্নতি বিধান করার কথা বলেন। এ জন্য তিনি কাউন্সিলে একাধিকবার River Physics Laboratory স্থাপনের দাবি উত্থাপন করেন। তখন অনেকেই তার এ কথার গুরুত্ব উপলব্ধি করেননি। নদীমাতৃক বাংলাদেশের আজও এ সমস্যা অতীব প্রকট। নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্তই সর্বপ্রথম ১৯১১ সালে জমিদারী প্রথা বিলোপের দাবি তোলেন। জমিদাররা এ জন্য জমিদার-প্রভাবিত ময়মনসিংহ নিবাসী নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্তের বিরোধী ছিলেন। এদের বিরোধিতার কারণে তিনি দুইবার কাউন্সিলে প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন। ১৯৩০ সালে বাংলার অমূল্য সম্পদ পাটের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ ও পাটচাষীদের স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে যে তদন্ত কমিটি গঠিত হয় তিনি তার সদস্য হন। তারই অক্লান্ত চেষ্টায় ১৯৪০ সালের পাট চাষ নিয়ন্ত্রণ আইন জারি হয়।
ডক্টর নরেশ সেনগুপ্তের অর্থানুকূল্যেই বাসন্তিকা পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশ হয়েছিল; এর পরের বছর থেকেই তার আর্থিক দায়িত্ব হলের ছাত্র পরিষদ গ্রহণ করে। জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট নরেশ সেনগুপ্ত যদি স্বতঃপ্রবৃত্ত না হয়ে সেদিন তার হল থেকে ছাত্রদের মুখপত্র ‘বাসন্তিকা’ প্রকাশ না করতেন, তবে শুধু জগন্নাথ হলের কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোনও হলেরই কোন বার্ষিক পত্রিকার প্রকাশ এত ত্বরান্বিত হতে পারতনা। ‘বাসন্তিকা’র ভেতর দিয়ে সাহিত্য সাধনার সূত্রপাত করে পরবর্তী কালে বাংলার বহু লেখক সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠালাভ করেছেন। খ্যাতনামা নাট্যকার মম্মথ রায়, লব্ধ প্রতিষ্ঠিত কবি, ঔপন্যাসিক ও সমালোচক বুদ্ধদেব বসু, কবি অজিত দত্ত- এরা জগন্নাথ হলের ছাত্র এবং ‘বাসন্তিকা’র লেখক ছিলেন।
জগন্নাথ হলের ছাত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হলে তাদের বিভিন্নমূখী প্রতিভার স্ফূরণ ও বিকাশের জন্য প্রভোস্ট ড. নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত বিবিধ চেষ্টা করেছেন। ছাত্রদের নানা উৎসবে তিনি অতি উৎসাহে যোগ দিতেন; নাটকে তাদের অভিনয় শিক্ষা দিতেন। জগন্নাথ হলে অভিনয়ের জন্য তিনি একটি নাটক (আনন্দ মন্দির) লিখে ছাত্রদের দ্বারা মঞ্চস্থ করান। তারই আগ্রহে জগন্নাথ হল বার্ষিকী ‘বাসন্তিকা’ ব্যতীত ‘প্রাচী’ নামে আরেকটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ‘প্রাচীর প্রথম সংখ্যার জন্য রবীন্দ্রনাথ লেখেন ‘জাগোরে প্রাচীন প্রাচী’ কবিতাটি। অধ্যাপক নরেশ সেনগুপ্তের সাথে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত পত্র যোগাযোগও ছিল। তিনি তার ‘আনন্দ মন্দির’ নাটকে তার সাহিত্য চর্চার প্রধান উৎস হিসাবে রবীন্দ্রনাথকে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন। জগন্নাথ হলে তার প্রাধ্যক্ষ থাকাকালীন হলের ছাত্র প্রখ্যাত নাট্যকার মন্মথ রায় লিখিত একাঙ্ক নাটক ‘মুক্তির ডাক’ তার সহায়তার ১৯২৩ ইংরেজির বড়দিন উপলক্ষে কলকাতার স্টার থিয়েটারে অহীন্দ্র চৌধুরীর পরিচালনা মহাসমারোহে অভিনীত হয়। বস্তুত, সমাজ সচেতন প্রভোস্ট ড. নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্তের অদম্য উৎসাহ ছাত্রদের মধ্যে এমনভাবে সংক্রমিত হয় যেজন্য জগন্নাথ হলে নিছক ঐতিহাসিক নাটকের চেয়ে সামাজিক নাটকই বেশী অভিনীত হত। এ কারণে ১৯২৮-২৯ সাল নাগাদ ঢাকার শ্রেষ্ঠ অভিনেতারা জগন্নাথ হলের ছাত্র ছিলেন।
কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহত্তম ভূমিকা হচ্ছে, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সামাজিক সংহতি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা। সেক্ষেত্রে জগন্নাথ হলই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে, ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি হলের মধ্যে জগন্নাথ হল সবার আগে নির্মিত হয়। এমন কী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সুপারিশ ঘোষণার পরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগেই জগন্নাথ হলের নির্মাণকাজ শুরু হয়। এখানে বলে রাখা ভালো, ঢাকা কলেজের মতো জগন্নাথ কলেজকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের। সে জন্য একটা আইন পাস করার কথাও বলা হয়। জগন্নাথ কলেজ ও জুবিলী স্কুলের জমির মালিক ছিলেন তিনজন ট্রাস্টি। ১৮৫৮ সালে ‘ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল’ নামে প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। এরপর ১৮৭২ সালে নাম বদলে বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী তার বাবার নামে ‘জগন্নাথ স্কুল’ নামকরণ করেন। ১৮৮৪ সালে এটি একটি দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজে ও ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণির কলেজের রূপ পায়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা কিশোরীলাল রায় চৌধুরী ১৮৪৮ সালের ১৯ নভেম্বর মানিকগঞ্জ জেলার সাঁটুরিয়া থানার বালিয়াটি জমিদার পরিবারের প্রখ্যাত পশ্চিম বাড়িতে জন্ম নেন। তার পিতার নাম জগন্নাথ রায় চৌধুরী। জনহিতকর কাজে তিনি ছিলেন অগ্রনায়ক। তিনি ১৮৮৪ সালের ৪ জুলাই তার পিতার নামে ‘জগন্নাথ কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমান ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে পরিচিত। বালিয়াটির প্রসিদ্ধ জমিদার শ্রীযুক্ত কিশোরীলাল রায় চৌধুরী ঢাকায় বাংলাবাজারে ১৮৮৭ সালে তার নিজ নামে কিশোরীলাল ‘জুবিলী হাই স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নাট্যচর্চার উন্নতির জন্য ‘মালঞ্চ’ নামে ঢাকায় একটি রঙ্গমঞ্চ গড়ে তোলেন। সেই রঙ্গমঞ্চটি বর্তমানে ‘লায়ন্স সিনেমা’ নামে পরিচিত। বালিয়াটিতে তিনি একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন, যা অদ্যাবধি সরকারি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে। ১৯২৫ সালের ৩ জুলাই কিশোরীলাল রায় চৌধুরী পরলোক গমন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিলের ধারাগুলো এমনভাবে করার কথা বলা হয়, যাতে জগন্নাথ কলেজের মূল মালিকদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়। লেখা ছিল :
So that if the trustees so desire a portion of the Jagannath Hall in the Dacca University to be called the Jagannath Hall. (RCUC 1919, vol. IV, p. 203).
জগন্নাথ হল নিয়ে গবেষণামূলক বই লেখার ক্ষেত্রে জগন্নাথ হলের প্রাক্তন ছাত্রদেরও খুব একটা আগ্রহ দেখা যায়নি। জগন্নাথ হলের নামকরণ নিয়ে ব্যাখ্যা ইতিহাসে কোথাও স্পষ্ট করা হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার সময়ে কিশোরীলাল চৌধুরীর কী ভূমিকা ছিল, তা জানাটাও খুব জরুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার সময়ে ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজে ডিগ্রি ও মাস্টার্স ডিগ্রি কোর্স ছিল। তখন ঢাকা কলেজ এবং জগন্নাথ কলেজের এ দুটি কোর্স বাতিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সে কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা হলের নামকরণ করা হয় ‘জগন্নাথ হল’, আরেকটি হলের নামকরণ করা হয় ‘ঢাকা হল’। জগন্নাথ হলের ১০০ বছরের ইতিহাস কতটাই না সমৃদ্ধ। উদার অসাম্প্রদায়িক জাতি-রাষ্ট্র নির্মাণে এ হলের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
কেমন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ? বিশেষ করে জানা দরকার শিক্ষার পরিবেশ কেমন ছিল? কারা শিক্ষক ছিলেন, তাদের জীবনযাপন কেমন ছিল? তরুণ সত্যেন্দ্রনাথ বোস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন পদার্থবিজ্ঞান পড়াতে এবং হয়েছিলেন প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক। সত্যেন্দ্রনাথ বোস শত বছর আগে ঢাকায় বসে, সেকালের গবেষণার খবর রাখতেন। সে সময়ের বিজ্ঞান জগৎ এর মহানায়কেরা হলেন ম্যাক্স প্লাংক, ম্যাক্স বর্ন, হাইজেনবার্গ, নীলস বোর, আইনস্টাইন, শ্রোডিঙ্গার প্রমুখ।
ইউরোপে তিনি কাজ করার ও সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছিলেন অনেকের সঙ্গে। সেসব মানুষেরা হলেন লুই ডি ব্রগলি, মারি কুরি, আলবার্ট আইনস্টাইন, ফ্রিৎজ হাবার, অটো হান, লিসা মাইটনার। তারা পৃথিবীর ইতিহাসের চিরস্থায়ী নক্ষত্র। দুই বছর অবস্থান শেষে ১৯২৬ সালে সত্যেন্দ্রনাথ বোস ফিরে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকায় ফিরে আবেদন করেছিলেন প্রফেসরশিপের জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তখন স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ। পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন প্রফেসর হওয়া যেত না। সত্যেন বোসের মতো মেধাবীর প্রফেসরশিপ অনিশ্চিত হয়ে রইল। বোস তখন আইনস্টাইনের শরণাপন্ন হলেন। বোসের পক্ষ হয়ে হার্টগের কাছে রিকোমেন্ডেশন লেটার পাঠালেন খোদ আইনস্টাইন। প্রথম উপাচার্য হার্টগ ছিলেন পণ্ডিত লোক। আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানী যার পক্ষ নিয়েছেন, হার্টগ তার বিপক্ষে যেতে পারেন না। পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়াই সত্যেন বোস অধ্যাপক হয়েছিলেন ।
আবার কবি বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিকথা থেকে উল্লেখ করছি,
পথে পথে আরও অনেক চেনা মুখ: কখনও দেখি বিজ্ঞানবিখ্যাত সত্যেন্দ্রনাথ বসু চলেছেন মন্দচরণে-হাতে গোল্ড ফ্লেকের টিন, জামা বোতামহারা, চুল উশকোখুশকো। ছাঁটা চুল, চোখে সোনার চশমা, গিলে করা চুড়িদার পাঞ্জাবিতে সুপ্রসাধিত- সেই যানবিরল পথেও অতি সতর্ক সাইকেল চালিয়ে আমাকে ছাড়িয়ে যায় ডক্টর দে- সংস্কৃত বাংলার অধিনায়ক সুশীলকুমার বা হয়তো দেখা যায় জগন্নাথ হলের দিক থেকে বেঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে ঢুকলেন ইতিহাস বিশরদ রমেশচন্দ্র মজুমদার, যুবকদের চেয়েও দ্রুত এবং বলিষ্ঠ তার পদক্ষেপ। অথবা আমি যখন কলেজের গাড়ি বারান্দায়, ঠিক তক্ষুণি সাইকেল থেকে নামেন আমাদের ইংরেজি বিভাগের সত্যেন্দ্রনাথ রায়, সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যার তুল্য লাজুক অধ্যাপক আর নেই- আমাকে দেখে ঈষৎ লাল হন, তিনি মৃদুস্বরে আমাকে বলে, ‘এই যে বুদ্ধু, ভালো আছো?’ আমি করিডর দিয়ে যেতে যেতে শুনি ঘণ্টার শব্দ; নানা ধরনের উৎসাহ বা বিরসতা নিয়ে চারটি অবধি বেলা কেটে যায়- তারপর আবার সেই একই পথে আমার বাড়ি ফেরা, পড়ন্ত রোদে, প্রায় প্রত্যহই সবান্ধবে।
স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। যেহেতু প্রথম উপাচার্য মনে-প্রাণে এক অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ছিলেন, তাই প্রতিষ্ঠালগ্নে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ছাপ পড়েছিল। তিনি জাতিতে ব্রিটিশ ও ধর্মে ইহুদি ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে তার দু-একটা এই পরিসরে উপস্থাপন করা যায় । কয়েক জন খ্যাতিমান শিক্ষক নিয়োগ ছিল গত ১০০ বছরের ইতিহাসে খুবই উল্লেখযোগ্য ঘটনা । যেমন, আইন বিভাগে সর্বোচ্চ বেতনে বাংলার গভর্নর ও চ্যান্সেলর রোনাল্ডসে নিয়োগ দিয়েছিলেন ড. নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্তকে। তার প্রাথমিক বেতন ছিল এক হাজার টাকা। সে সময়কার বিবেচনায় তাকে এত বেশি বেতন দেওয়ার কারণ ছিল, লাভজনক আইন পেশা ছেড়ে সার্বক্ষণিক শিক্ষকতায় কোনও বড় আইনজীবী আসতে চাননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ ও জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ একই সঙ্গে হয়। জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ হলেও নরেশ চন্দ্র ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল। যে কারণে পরবর্তী সময়ে বাঙালি জাতির প্রতিটি সংগ্রামে জগন্নাথ হলের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। ৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে এ হলের প্রাধ্যক্ষ, আবাসিক শিক্ষক, ছাত্র, কর্মচারীরা অকাতরে জীবন উৎসর্গ করেছেন। স্বাধীনতার পর দেশ গঠনে এই হল পরিবারের সদস্যদের ভূমিকার কোনো তুলনা হয় না, যা কিনা অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। এ হলের ছাত্ররা রক্ত বিক্রি করে হলের গণসমাধি তৈরি করেছিলেন, এখনকার সময়ে যা কল্পনাও করা যায় না। জগন্নাথ হল ছিল ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকেও এই হল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ও জগন্নাথ হলের প্রথম প্রাধ্যক্ষ এই লোকায়ত চেতনার ভিত্তি রচনা করে গেছেন। আগেই উল্লেখ করেছি, নরেশ সেনগুপ্ত ছিলেন প্রগতিশীল ও সংস্কারমুক্ত। তিনি তার বন্ধু কাজী নজরুল ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের সঙ্গে জগন্নাথ হলের সম্পর্ক খুবই গভীর ছিল। জগন্নাথ হলের দ্বিতীয় প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক রমেশ চন্দ্র মজুমদারের সময়ে কবি নজরুলকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল।
সরকারি ঢাকা কলেজের (১৮৪১) পর ঢাকায় জগন্নাথ কলেজই ছিল দ্বিতীয় প্রধান উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। ঢাকা কলেজের মতো জগন্নাথ কলেজকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের। সেজন্য একটি আইন পাস করারও সুপারিশ করা হয়। জগন্নাথ কলেজ ও জুবিলী স্কুলের জমির মালিক ছিলেন তিনজন ট্রাস্টি। প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিলের ধারাগুলো এমনভাবে করার কথা বলা হয়, যাতে জগন্নাথ কলেজের মূল মালিকদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়। (So that if the trustees so desire a portion of the Jagannath College may be applied at an early date to the foundation of a hall in the Dacca University to be called the Jagannath Hall. [RCUC 1919, vol. IVp. 203])
ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়-
… the Dacca and Jagannath Halls should be equated as early as possible in respect of the attachment to them of University Professors and Readers|
রিপোর্টে প্রস্তাবিত জগন্নাথ হলে ৩০০ ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা, লাইব্রেরি, পাঠকক্ষ, টিউটরিয়াল ক্লাসের কক্ষ রাখার সুপারিশ করা হয়।
জগন্নাথ হল নির্মাণের জন্য যে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, তাতে ছিল একটি কেন্দ্রীয় ভবন, যা হবে দৈর্ঘ্যে ১৪৪ দশমিক ৫ ফুট এবং প্রস্থে ৭৭ ফুট। প্রতিটিতে ১০০ ছাত্র থাকার উপযোগী তিনটি ভবন থাকবে। তাতে থাকবে তিনটি রান্নাঘর ও তিনটি ভোজনকক্ষ। প্রভোস্ট ও তিনজন হাউজ টিউটরের বাসস্থান। প্রকল্পে বলা হয়েছিল, কেন্দ্রীয় ভবনে থাকবে একটি মিলনায়তন, যার আকার হবে ৭১ দশমিক ৫ ফুট দীর্ঘ এবং ৫০ ফুট প্রস্থে, যেখানে ৪০০ থেকে ৫০০ আসন থাকবে। থাকবে একটি কমনরুম, যার আয়তন ৪৮ ফুট দীর্ঘ এবং ৩০ ফুট প্রস্থে। লাইব্রেরি ঘরটি হবে ৩০ ফুট দীর্ঘ এবং ২০ ফুট প্রস্থের। টিউটরিয়াল ক্লাসের জন্য ঘর থাকবে ১৪টি, যার প্রতিটির আকার ১৬ ফুট দীর্ঘ এবং সাড়ে ১০ ফুট চওড়া। একটি ক্লাসরুম ৩০ ফুট দৈর্ঘ্যের, ২০ দশমিক ৫ ফুট প্রস্থের। শিক্ষকদের জন্য আরেকটি কামরা, যার আয়তন ৩০ ফুট দীর্ঘ এবং ২০ ফুট চওড়া। প্রভোস্ট ও তার কেরানীদের জন্য দুটি কামরা।
ছাত্রদের ডরমিটরি হলে ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের আকারের দোতলা ভবন, যে ভবনগুলোর আয়তন দৈর্ঘ্যে ২০৯ ফুট এবং প্রস্থে ৭২ ফুট। প্রত্যেক ছাত্রের জন্য হলে ১০ ফুট বাই ৮ ফুট স্থান বরাদ্দ করা হয়। প্রতি ৫০ ছাত্রের জন্য একটি কমনরুম। হলে খেলাধুলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা হয়। ক্রিকেট, ফুটবল ও হকি খেলার মাঠ, পাঁচটি টেনিস কোর্টসহ অন্যান্য ব্যবস্থাও ছিল। এটি যেন একটি আন্তজার্তিক মানের হল হয়, সে ব্যাপারে কোনও কার্পণ্য ছিল না। জগন্নাথ হল নির্মাণে অর্থায়ন করে জমিদার পিতা-পুত্রের নামে প্রতিষ্ঠিত ‘জগন্নাথ রায় চৌধুরী ও কিশোরীলাল রায় চৌধুরী ট্রাস্ট’।
ভবন নির্মাণের আগে জগন্নাথ হলের ছাত্ররা অস্থায়ীভাবে থাকতেন ৬নং বাংলোতে। উল্লেখ্য, ১৯০৫সালে নীলক্ষেত এলাকায় কয়েকটি বাংলো নির্মাণ করা হয়েছিল পদস্থ কর্মকর্তাদের বাসস্থান হিসেবে। ১০ নম্বর বাংলোটিতে ১৯২৩ থেকে ২৯ পর্যন্ত অবস্থান করতেন ছাত্রীরা। বর্তমানে মেডিকেল কলেজের দোতলা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল মুসলিম হলে ছাত্রদের জন্য। স্থানসংকুলান না হওয়ায় মুসলিম হলের ছাত্রদের অনেকে বর্ধমান হাউসে, বর্তমান বাংলা অ্যাকাডেমির পুরেনো ভবনে, থাকতেন। মুসলমান ও হিন্দু ছাত্ররা অনেকে বিভিন্ন বাড়িতে লজিং থাকতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন হলের মধ্যে জগন্নাথ হলই সবার আগে নির্মিত হয়। এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সুপারিশ ঘোষণার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগেই জগন্নাথ হলের নির্মাণকাজ শুরু হয়। কাজ শুরু করা হয় ৩০০ ছাত্রের আবাসনের উপযোগী একটি কেন্দ্রীয় ভবন এবং তিনটি অন্য ভবন নির্মাণের। তা ছাড়া ছিল প্রভোস্টের বাসভবন ও তিন হাউস টিউটরের বাসস্থান। একটি মিলনায়তন, সেখানে চার-পাঁচ শ মানুষের বসার ব্যবস্থা ছিল। সেটি ১৯৮৪-র অক্টোবরে ধসে পড়ে এবং তাতে নিহত হন বহু ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছর ১০১ জন ছাত্র হলে ওঠেন। ২১২ জন ছিলেন অনাবাসিক। তাদের অধিকাংশই থাকতেন শহরের বিভিন্ন মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারে এবং অনেকে মেস করে।
যাহোক আবারও ফিরে আসি নরেশ চন্দ্র প্রসঙ্গে। স্পষ্ট করেই বলা যায় তিনি বর্ণবাদ ও বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে বলতেন ও লিখতেন। জগন্নাথ হলের ছাত্ররা প্রথম থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। লাউডস্পিকার বা মাইক্রোফোন প্রথম ব্যবহার করা হয় এই হলে। জগন্নাথ হলের সংগীতানুষ্ঠান শহরের সাধারণ মানুষও রাস্তায় দাঁড়িয়ে অথবা হল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে উপভোগ করত। জগন্নাথ হলেই প্রথম মেয়েদের নৃত্যানুষ্ঠান হয় বিশ দশকের শেষ দিকে। মীরা দাশগুপ্ত নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন। সে-সময়কার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘জগন্নাথ হলে আবার মেয়ে নাচিল’। জগন্নাথ হল বিচিত্র কর্মকাণ্ডে প্রাণচঞ্চল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এ হলের ছাত্র সংসদের কর্মকাণ্ড ছিল শিক্ষামূলক উদ্দীপনায় ভরা। আমরা জানি, হল সংসদের সমাজসেবা সম্পাদক নামে একটি পদ এখনও আছে। জগন্নাথ হলের সমাজসেবা সম্পাদকের নেতৃত্বে ঢাকা শহরে বেশ কয়েকটি বয়স্ক শিক্ষা ও নৈশ বিদ্যালয় পরিচালিত হতো। তারা শুধু নিরক্ষরতা দূর নয়; বন্যা, মহামারীর মধ্যে ত্রাণ তৎপরতাও চালাত। দরিদ্রদের মধ্যে পুরনো শীতবস্ত্র বিতরণসহ অনেক সমাজসেবামূলক কাজও করত। একেবারে গোড়া থেকেই প্রতিবেশী মুসলিম হলের সঙ্গে জগন্নাথ হলের ছাত্রদের এক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। প্রথম প্রাধ্যক্ষ নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্তের এতে কম অবদান ছিল না। সে-সময় খলিফা মামুনের নামে মুসলিম হলে ‘আল মামুন ক্লাব’ গড়ে উঠেছিল। ক্লাবটি ছিল একটি প্রগতিশীল সংগঠন, মুসলিম সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তি তুলে ধরত। খুবই বলিষ্ঠভাবে নারী স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলা হতো, যা সে-সময়ের বিচারে খুবই সাহসিকতার বিষয়। এই ক্লাবের পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন নরেশ সেনগুপ্ত, ঢাকা কলেজের অধ্যাপক আবদুল ওদুদ, ইতিহাসের বিখ্যাত অধ্যাপক কালিকারঞ্জন কানুনগো, বাংলার অধ্যাপক চারু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ পণ্ডিতজন। যে কারণে মুসলিম হলে প্রগতিবাদী সাংস্কৃতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।
১৯২৫ সালের ১০ অগাস্ট বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মুসলিম হলের ছাত্র ইউনিয়ন সংবর্ধনা দিয়েছিল। সেখানে যে স্মারকলিপি পাঠ করা হয়েছিল তা সত্যিই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। স্মারকলিপির কয়েকটি বাক্য উৎকলন করলেই পাঠকদের কাছে তা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
হে পুণ্যচিত্ত, অনন্ত-রূপ-পিয়াসী সাধক। আমাদের আদর্শ কর্ম্মপ্রাণ, স্নেহ-প্রবণ, ভক্ত-বীর হযরত মুহম্মদের জীবনের মূল-মন্ত্রটি তোমার একটি ছন্দে বেশ সুন্দর অভিব্যক্ত হইয়াছে-
‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়। অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময় লভিব মুক্তির স্বাদ।’
তোমার এই ছন্দটি সেই পুরুষ-সিংহের প্রতি আমাদের ভক্তি অধিকতর প্রগাঢ় করিয়া তুলে এবং নব নবভাবে সেই মরুর যোগীকে দেখিবার ইচ্ছা জাগায়। অনন্ত বেদনার মাঝে, মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে যুঝিতে যুঝিতে সেই বিরাট-পুরুষ আত্মার মুক্তিলাভ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। তামসিক ভারতে তুমিই নূতন করিয়া এই ‘কর্ম্মের মধ্যে মুক্তি’র বার্ত্তা ঘোষণা করিয়া নব নব কর্ম্মধারায় ভারতবাসীকে জাগ্রত করিয়াছ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল নিয়ে আমাদের অহংকারের শেষ নেই আবার তাদের দুই জন নিয়ে যে সমস্ত গল্প প্রচলিত হয়েছে তা উৎসমুখ বের করা কঠিন । ছোটবেলায় স্কুলে বন্ধুদের কেউ কেউ গল্প করতো রবীন্দ্রনাথ নাকি কাজী নজরুলকে চক্রান্ত করে বোবা বানিয়ে দিয়েছিল।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বীর প্রতীক মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন (সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) একটি তথ্য দিতে গিয়ে বলেন, “১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলিকাতা গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়।”
তিনি অভিযোগ করেন, রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ রবীন্দ্রনাথ কোলকাতায় ছিলেন না। তিনি ছিলেন শিলাইদহে। ১৯ মার্চ ১৯১২ (৬ চৈত্র, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ) ভোরে কলকাতা থেকে সিটি অব প্যারিস জাহাজে রবীন্দ্রনাথের ইংলণ্ড যাত্রার জন্য কেবিন ভাড়া করা হয়েছিল। তার মালপত্রও জাহাজে উঠেছিল। সেদিন সকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে তার ইংলন্ড যাত্রা স্থগিত হয়ে যায়। তথ্য বলছে- সে সময়ে রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় নয়- শিলাইদহে ছিলেন। নওয়াব আলী জানান, বঙ্গীয় লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির চারজন সদস্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধিতা করেন- They made strong efforts to oppose the University.
এক পর্যায়ে ভোটাভুটি হলে পক্ষে-বিপক্ষে সমান সমান ভোট পড়ে। সভাপতির কাস্টিং ভোটের দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হয়। মুসলিমদের কেউ কেউ যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে এ কথাটি বিশেষ জানাজানি হোক, তা চাননি নওয়াব আলী। সলিমুল্লাহকে এ ব্যাপারে প্রভাব খাটাতে বলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবক ও উদ্যোক্তা হিসেবে নবাব সলিমুল্লাহকেই যে ‘প্রতিষ্ঠাতা’ বলা হয়, সে স্বীকৃতি সরকার এবং দুই বাংলার হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিস্টান প্রখ্যাত শিক্ষাবিদেরাই দিয়ে গেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কোর্ট সভা (সিনেট) অনুষ্ঠিত হয় ১৭ অগাস্ট ১৯২১ চ্যান্সেলর ও বাংলার গভর্নর লরেন্স জন ল্যামলে ডানকানর্স , আর্ল অব রোনাল্ডেসের সভাপতিত্বে। অধিকাংশ খ্যাতিমান হিন্দু শিক্ষাবিদসহ ১১৩ জন সদস্য সে সভায় উপস্থিত ছিলেন। শুরুতে নবাব সলিমুল্লাহর জন্য vote of appreciation of the service বিষয়ক একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন ফজলুল হক এবং নবাব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা। নতুন প্রদেশ বাতিলের দুই বছরের মধ্যে ১৯১৩-তে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পান। কলকাতার মূলধারার হিন্দু কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যেই তার পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। এক দল আনন্দিত, আরেক দল অসন্তুষ্ট। কেউ উল্লসিত, কেউবা বিরক্ত। সলিমুল্লাহর এক পুত্র মারা যাওয়ায় তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। ডায়াবেটিসের কারণে শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছিল আগেই। তখন তিনি শয্যাশায়ী। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সংবাদ শুনে তিনি খুবই খুশি হন। নবাব কবিকে অভিনন্দন জানিয়ে শুধু যে তারবার্তা পাঠান তা-ই নয়, কবির অনুপস্থিতিতেই এক অভিনন্দন-সভারও আয়োজন করেন এবং সেই অনুষ্ঠানের আংশিক ব্যয়ও তিনি বহন করেন। সেই সময়টাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাত্ররা অন্য দুই হলের ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছিল । তার একটি উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে। ঢাকার একটি কুটির শিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে ছিল। জগন্নাথ হলের তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ ও ছাত্রদের পৃষ্ঠাপোষকতায় আবার পুনর্জন্ম হয়, তা হচ্ছে ‘কুশিদা’; বর্তমানে যার নাম জামদানি। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা তাদের উপাদানের চাহিদা ও বাজার সম্বন্ধে প্রায় অজ্ঞ ছিল। অথচ এই চাহিদা ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। জগন্নাথ হলের ছাত্ররা কারিগরদের সঙ্গে ব্যবসায়ী মহলের যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিলেন।
২
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মেধাবী ছাত্র কবি বুদ্ধদেব বসু তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন-
বঙ্গভঙ্গ ভেস্তে যাওয়ার প্রায় দেড় দশক পরে, সেই পুরানো বিদ্যাপীঠকে কেন্দ্র করে স্থাপিত হলো নূতন একটি বিশ্ববিদ্যালয়- নবনির্মিত অব্যবহৃত হলসমূহ। প্রাণপ্রাপ্ত হলো। রেললাইন থেকে শহরের উত্তরতম প্রান্ত পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি; উত্তর অংশটি সরকারি কেস্টবিস্টুদের বাসভূমি, মধ্যখানে আছে বিলেতি বাসন ঘোড়দৌড়ের মাঠ, গলফ খেলার মাঠ, আছে ঢাকার নাগরিকদের পক্ষে অপ্রবেশ্য ঢাকা ক্লাব, যেখানে মদ্যবিলাসী বলনৃত্যপ্রিয় শ্বেতাঙ্গ রাজপুরুষ ও নারায়ণগঞ্জের পাটকল-চালক ফিরিঙ্গিরা নৈশ্য আসরে মিলিত হন; আর আছে কাননবেষ্টিত উন্নতচূড়া একটি কালীমন্দির, যেখানে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি অর্ঘ্য দিতে আসেন ‘শাহবাগের মা’কে সেই বিদ্যাবিভান্তিব ব্রাহ্মণী যিনি পরবর্তীকালে ‘মা আনন্দময়ী’ নামে সর্বভারতে বিখ্যাত হন। কিন্তু দক্ষিণ অংশটি পুরোপুরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকারভুক্ত; সেখানে ছাত্র ও অধ্যাপক ছাড়া ভিড় দেখা যায় শুধু শীতে বর্ষার শনিবারগুলোর অপরাহ্নে, যেখানে জুয়াড়ি এবং বেশ্যায় বোঝাই খড়খড়ি-তোলা ঘোড়ার গাড়ি ছুটে অনবরত রেসকোর্সের দিকে- শান্ত রমনাকে মর্দিত করে, কলেজ ফেরতা আমাদের চোখে-মুখে কর্কশ ধুলো ছিটিয়ে দিয়ে…।
আজ থেকে ৮০ বছর আগে, অর্থাৎ ১৯৩০ সালের দিকে কেমন ছিল তা কবি বুদ্ধদেব বসুর বর্ণনা থেকে জানতে পারি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকে চমৎকার একটা সাংস্কৃতিক পরিবেশ তা আজকের প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা দরকার। একই সময়ে নাট্যকার মন্মথ রায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র। তিনি ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৩টি নাটক লিখেছিলেন, যা বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে নাট্য সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। জগন্নাথ হলের বার্ষিকী ‘বাসন্তিকা’ ছিল বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। বুদ্ধদেব বসুর সেই স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছিলেন এভাবে-
… সংক্ষেপে বলা যায়, ‘সাহিত্যবিভাগের সম্পাদক’ হিসেবে আমি মন দিয়ে একটিমাত্র কাজ করেছিলাম, আমার চেষ্টায় জগন্নাথ হল-এর বার্ষিক পত্রিকা ‘বাসন্তিকা’র কিছুটা হয়তো শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল সে-বছর…।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, নেতাজি সুভাষ বসুর মতো নমস্য ব্যক্তিরা জগন্নাথ হলে এসেছিলেন। আলোচিত স্মৃতিকথা থেকে কয়েকটি লাইন উপস্থাপন করছি,
আমার আয়োজিত অন্য একটি ঘটনাও মনে পড়ছে, যার সঙ্গে আমার হৃদয়ের সংযোগ ছিল। সেই ঘটনার নাম নজরুল ইসলাম। সেই আমি প্রথম দেখলাম নজরুলকে, অন্য অনেক অসংখ্যের মতোই দেখামাত্র প্রেমে পড়ে গেলাম। চওড়া কাঁধে বলিষ্ঠ তাঁর দেহ, মাঝখানে দিয়ে সোজা সিঁথি করা কোঁকড়া চুল গ্রীবা ছপিয়ে প্লাবিত, মুখখানা বড় ও গোলছাদের, নেত্র আয়ত ও কোণরিক্তম। গায়ে গেরুয়া রঙের খদ্দর পাঞ্জাবি, কাঁধে সূর্যমুখী হলুদ চাদর। কণ্ঠে তাঁর হাসি, কণ্ঠে তাঁর গান, প্রাণে তাঁর অফুরান আনন্দ- সব মিলিয়ে মনোলুণ্ঠকারী একটি মানুষ। তার জন্য আমি জগন্নাথ হল-এ যে সভাটি আহ্বান করেছিলাম তাতে ভিড় জমেছিল প্রচুর, দূর শহর থেকে ইডেন কলেজের অধ্যাপিকারাও এসেছিলেন, তার গান ও কবিতা-আবৃত্তি শুনে সকলেই মুগ্ধ মৃত অথবা বৃদ্ধ অথবা প্রতিষ্ঠানীভূত না হওয়া পর্যন্ত কবিদের বিষয়ে যাঁরা স্বাস্থ্যকারভাবে সন্দিগ্ধ, সেই সব প্রজ্ঞাবানদেরও মানতে হয়েছিল যে লোকটার মধ্যে কিছু আছে।
মুসলিম হলের ছাত্রদের সংগীতগুরু ছিলেন কুমিল্লা দারোগা বাড়ির মোহাম্মদ হোসেন খসরু। বহু বছর তিনি ছিলেন হলের ছাত্রদের অতি আপনজন। শুধু মুসলিম হলের নয়, জগন্নাথ হলের ছাত্রদেরও তিনি উচ্চাঙ্গসংগীতে তালিম দিতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশের দশকের ছাত্র এবং বাংলা বিভাগের শিক্ষক আশুতোষ ভট্টাচার্য, যিনি একজন বিশিষ্ট লোকসাহিত্য বিশেষজ্ঞ, স্বাধীনতার পরে ঢাকায় এসে কিছুদিন ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলা একাডেমিতে বক্তৃতা দিয়েছেন। তিনি ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের পরিচালক আমানুজ্জামান খানের বাসভবনের এক চা-চক্রে এসে বলেছিলেন, হিন্দু-মুসলমান সব তরুণের মধ্যেই মোহাম্মদ হোসেন খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। জগন্নাথ হলে প্রায়ই আসতেন। নজরুলের মতো প্রচুর পান খেতেন। প্রাণখোলা হাসি ছিল তাঁর। সংগীতের রাগ-রাগিণী নিয়ে আলোচনাও করতেন। অধ্যাপক আশুতোষ বলেন, তাঁর স্থায়ী আস্তানা ছিল মুসলিম হলে।
বিশ ও তিরিশের দশকে ঢাকায় কয়েকজন বিশিষ্ট হিন্দু সংগীতজ্ঞ ও সংগীতশিল্পী ছিলেন। তারা জগন্নাথ ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্রদের গান শেখাতেন। কেউ সেতার, বেহালা, গিটার, তানপুরা প্রভৃতি যন্ত্রসংগীত শিক্ষা দিতেন। কলকাতার সঙ্গে মোটেই তুলনা হয় না; কিন্তু বিশ ও তিরিশের দশকে ঢাকায় সংগীতচর্চা যথেষ্টই হতো। সংগীতশিল্পীদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ঢাকার নবাব পরিবার এবং বলদার জমিদার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে কৃতিমান মানুষের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তার ছাত্রত্বকালীন অংশটি ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কেননা বঙ্গবন্ধু ১৯৪৯ সালে যখন আইন বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র তখন তার ছাত্রজীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনাটি ঘটে। পাঠকদের মনে থাকবার কথা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে ছাপা হয়েছে বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠার আগে ‘গণতান্ত্রিক যুব লীগ’ গঠন করেছিলেন। সেই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল দেশে ‘কমুনাল হারমনি’ তৈরি করা। সমাজের প্রগতিশীল অংশের নানান শ্রেণি পেশার মানুষদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু সেই সংগঠনের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মনে থাকবার কথা ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের জন্মের সময়ে প্রথম সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের একজন নাজমুল করিম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ছাত্রত্বের সময়ের অংশটিও ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কেননা বঙ্গবন্ধু ১৯৪৯ সালে যখন আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তখন তার ছাত্রজীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনাটি ঘটে। কর্মচারীদের ন্যায় সঙ্গত দাবী আদায়ের লক্ষ্যে পরিচালিত আন্দোলনে তরুণ শেখ মুজিব অকুণ্ঠ সমর্থন দেন। তারপরই কর্মচারীদের আন্দোলন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুসহ ২৭ জন ছাত্রছাত্রীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুকে জরিমানা ও মুচলেকার শর্তে তার ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু মুচলেকা দিয়ে এই শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা শেখ মুজিবের কাছে মর্যাদাপূর্ণ মনে হয়নি। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উদ্যোগে ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ উদযাপিত হয়। সাতদিনে হাজার হাজার লোক গভীর আগ্রহ নিয়ে বাংলাভাষার বিকাশ, সাহিত্যের ইতিহাস ও লিপির বিবর্তনী সম্পর্কিত প্রদর্শনী দেখেন এবং উপভোগ করেন প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিতা, সেকাল থেকে একালের গান এবং বিভিন্ন যুগের সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা। সকলের অনুরোধ, এমন অনুষ্ঠান বছরে-বছরে শহরে-শহরে হোক। এরপর থেকে হাজার বছরের বাংলা কবিতা ও গানের অনুষ্ঠান পূর্ববাংলায় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। বিশিষ্ট নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার তার এক লেখায় অসাম্প্রদায়িক বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে বর্ণনা করেছেন, তা একটু দেখে নিতে পারি:
বঙ্গবন্ধুকে কাছাকাছি থেকে প্রথম দেখি ১৯৬৪ সালে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পাকিস্তান সরকারের মদদে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছে। আমরা তখন থাকতাম তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের স্টাফ কোয়ার্টার্সে। আমাদের ফ্ল্যাটের পাশ দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ, অদূরেই তেজগাঁও স্টেশন। রাতে চট্টগ্রামগামী মেল ট্রেন থামানো হল। দাঙ্গাবাজরা খুঁজে বের করল কয়েকজন নিরপরাধ হিন্দু যাত্রীকে। মৃত্যুমুহূর্তে তাদের আর্তচিৎকার আমাদের প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত করেছিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা শুনেছি। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি। আমরাও উদ্বেগ আর শঙ্কার মধ্যে দিয়ে রাত কাটালাম। পরদিন সকালে হঠাৎ দেখি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি জিপগাড়িতে করে আমাদের খোঁজে এসেছেন। আমাদের আত্মীয় প্রয়াত অধ্যাপক অজিত গুহ বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছিলেন আমাদের নিরাপত্তাহীনতার কথা। তাই তিনি আমাদের নিতে এসেছেন। এসেই বললেন, ‘এক মিনিট সময়। তৈরি হয়ে আমার সঙ্গে সবাই চলুন।’ আমি, আমার বড়ভাই, তাঁর স্ত্রী, আমার ছোটবোন ও আমাদের পিতামহীকে নিয়ে তাঁর জিপে উঠালেন। ড্রাইভারকে বললেন, কোথাও না থামিয়ে সোজা তাঁর বাড়ির দিকে যেতে। তাঁর ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়ে দেখি আরো অনেক পরিচিত পরিবারকে তিনি নিয়ে এসেছেন নিরাপদ আশ্রয় তাঁর বাড়িতে। অনেকেই তো অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বড় বড় বক্তৃতা-বিবৃতি দেন, কিন্তু আপন জীবনাচরণে তার প্রতিফলন কতটুকু? আমার ব্যক্তিগত এ অভিজ্ঞতা থেকেই তো দেখেছি- নিজের বিপদ জেনেও কী সাহসের সঙ্গে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন দাঙ্গাবাজদের সামনে বিপন্ন মানুষকে বাঁচাতে। সেবার দাঙ্গার সময় তিনি দিনরাত পরিশ্রম করেছেন দাঙ্গাবাজদের প্রতিহত করতে। এ কেবল ঘরে বসে নির্দেশ দিয়ে নয়, সরাসরি মাঠে নেমে কাজ করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালের ১৪ অগাস্ট এক সিন্ডিকেট সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ছাত্রত্ব কেড়ে নেওয়ার তৎকালীন সিদ্ধান্তটি বাতিল করেছে। আমরা ভাল করে জানি শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানসহ বিএ ডিগ্রি গ্রহণ করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। তিনি সে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। বর্তমান প্রধানমনত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সর্বজ্যেষ্ঠ সন্তান (জন্ম: ২৮.০৯.১৯৪৭ সাল)। তিনি ২৬ অগাস্ট ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন রোকেয়া হলের সংযুক্ত ছাত্রী। রোকেয়া হল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে লেখা এক পত্রে (রোহ/পিএফ/৬১/২০১৬ তাং ৩.৮.২০১৬) জানা যায়, শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৭-৬৮ সেশনে বিএ (সম্মান) শ্রেণিতে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। তার রেজিস্ট্রেশন নং হ-৭১৬। ক্লাস রোল: ৮৫২। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতিমান ছাত্র ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলন নয় সাংস্কৃতিক আন্দোলনে বিশাল ভূমিকা রেখেছিলেন। চুয়াত্তর সালে একবার ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল, সমস্ত বীজতলা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। শেখ কামালের নেতৃত্বে ছাত্রনেতারা সেদিন রেসকোর্সে ট্রাক্টর এনে বীজতলা তৈরি করেছিল, আবার চারা উঠিয়ে হেলিকপ্টারে করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত না হলে বহু ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে আমরা পেতাম কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কলকাতায় এ মনীষীর জীবন শুরু হয় অবহেলা আর লাঞ্ছনা দিয়ে। সংস্কৃত নিয়ে বিএ অনার্স পাসের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতে এমএ পড়তে গিয়ে ব্যর্থ হন ‘বেদের’ অধ্যাপক সত্যবৃত সামশ্রমীর চরম বিরোধিতার ফলে। এ বিষয়ে ভাষাবিদ ড. সুকুমার সেন লিখেছেন, ‘এমএ ক্লাসে শহীদুল্লাহ ভর্তি হলেন বটে। কিন্তু ক্লাস করতে পারলেন না। যে পণ্ডিত বেদ পড়াতেন তিনি শহীদুল্লাহর মতো অহিন্দু ছাত্রকে বেদ পড়াতে রাজী নন। বেদের অধ্যাপক সত্যব্রত মহাশয় যে অন্যায় করেছেন তা বিশ্বের যে কোনো সভ্যসমাজে একটি অত্যন্ত নিন্দনীয় ঘটনা।’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের শহীদুল্লাহকে বৃত্তি দিয়ে জার্মানি পাঠাবার লোকদেখানো প্রচেষ্টাও বিফলে যায়। স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে শহীদুল্লাহকে জার্মানি যাওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। ব্রিটিশরাজের বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীব শক্তিধর উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সদিচ্ছা থাকলে শহীদুল্লাহর সংস্কৃত নিয়ে এমএ পড়া বা বৃত্তি নিয়ে জার্মানি যাওয়া অসম্ভব ছিল বলে অনেকেই মনে করেন না।
১৯২১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অবশেষে প্রতিষ্ঠার পর প্রতিভাধর যুবক শহীদুল্লাহ নতুন বিদ্যাপীঠে একই বছর যোগ দেন সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ছিলেন তখন সে বিভাগের প্রধান। নবপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিকালে শহীদুল্লাহ ফ্রান্সে দেশে যাওয়ার সুযোগ পান ও সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার মোহাম্মদ আলী জিন্নার ঘোষণার পর যুক্তিবাদী লেখনীর মাধ্যমে ড. শহীদুল্লাহ বিরোধিতা করে ছাত্রসমাজ ও প্রগতিশীল মহলের মনোবল বাড়িয়ে দেন। ড. সুকুমার সেন তার এক লেখায় ড. শহীদুল্লাহ সম্পর্কে অনেক ভালো কথা বলে মন্তব্য করেন যে, ‘তিনি (শহীদুল্লাহ) যদি ঢাকায় না যেতেন বা অল্পসল্প রাজনীতির আবর্তে না পড়তেন, যদি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেন, তাহলে তাঁর কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু পেতুম, কোনো সন্দেহ নেই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক মহান শিক্ষক গোবিন্দ চন্দ্র দেব ছিলেন একজন মানবতাবাদী দার্শনিক। সাধারণ মানুষের জন্য তাঁর দরদ, আর্তমানবতার প্রতি তার ঐকান্তিক সহমর্মিতা, বিপদে অপরকে সহায়তার করার উদার মনোভাব- তার কাছে কেবল কথার কথাই ছিল না। তিনি ছিলেন এসব মহৎ মানবিক গুণের মূর্ত প্রতীক। তিনি সব সময়ই একান্ত হবার চেষ্টা করেছেন তার প্রতিষ্ঠান ও ছাত্র-ছাত্রী-সহকর্মীদের সাথে। সবাইকে তিনি দেখতেন সমান চোখে, একই পরিবারের সদস্য হিসেবে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে গরীব ছাত্রছাত্রীদের দান করেছেন অকাতরে, ক্ষুধার্ত মানুষকে সম্মানের সাথে খাবার দিয়েছেন বাড়িতে নিয়ে, যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন অন্ন-বস্ত্র-অর্থ দিয়ে। কিন্তু কখনও জানতে চাননি তার ধর্ম বা বর্ণের পরিচয়। ষাটের দশকে তার বাসা থেকে কলাভবনে আসতে রিকশা ভাড়া ছিল পঁচিশ পয়সা। কিন্তু তিনি এক টাকার কম ভাড়া দিতেন না। প্রায়ই পাঁচ টাকা বা দশ টাকার নোটও হাতে গুঁজে দিতেন। বিদায়কালে রিকশাওয়ালার সাথে করমর্দন করে ধন্যবাদ জানাতেন। মাঝে মাঝে কোলাকুলিও করতেন। কখনও ভাবতেন না রিকশাওয়ালা হিন্দু না মুসলিম।
আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির বিরল দৃষ্টান্ত চিরকুমার ডক্টর দেব দত্তক নিয়েছেন একটি মুসলিম মেয়ে এবং একটি হিন্দু ছেলেকে। মেয়েটির নাম রোকেয়া সুলতানা এবং ছেলেটির নাম জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত। একই ঘরে রোকেয়া সুলতানাকে মুসলিম কায়দায় বড় করেছেন, ব্যবস্থা করেছেন কোরআন হাদিস শিক্ষার। জ্যোতিপ্রকাশকে বড় করেছেন সম্পূর্ণ হিন্দু কায়দায়, পড়িয়েছেন হিন্দুশাস্ত্র। এমএ পাশ করার পর রোকেয়াকে যোগ্য মুসলিম ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছেন আর জ্যোতিপ্রকাশ ইংরেজি সাহিত্য ডিগ্রি লাভের পর একটি উচ্চ শিক্ষিতা পুত্রবধূ ঘরে আনেন। বিয়ের পরেও সবাই তার সাথে থাকত। জ্যোতিপ্রকাশ আমেরিকায় চাকরি নিয়ে চলে গেলেও রোকেয়া স্বীয় কন্যার মতোই সেবা করেছে দেবকে, কাছেই রয়ে গেছে তার মৃত্যু পর্যন্ত। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রত্যুষে যখন পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা ড. দেবকে হত্যা করতে আসে তখন তার সামনে দাঁড়ান রোকেয়ার স্বামী এবং বলেন, ‘আমাকে না মেরে বাবাকে মারতে পারবেনা’। নরপিশাচ ওই সৈন্যরা তা-ই করল। প্রথমে টেনে নিয়ে গুলি করল রোকেয়ার স্বামীকে। পরে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল শিশুর মতো সরল ড. দেবকে।
দেব বিভিন্ন ধর্মের মূলগ্রন্থগুলো দরদ দিয়ে পড়েছেন এবং উপলব্ধি করেছেন বলেই তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে সশ্রদ্ধ বক্তব্য রাখতেন। তাকে দেখা যেত বড়দিনে চার্চে গিয়ে এবং বৌদ্ধ পূর্ণিমায় বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করতে। ঈদের দিনে ‘ঈদ মোবারক’ বলে কোলাকুলি করতে, মিলাদ মাহফিলে ও জানাজার নামাজে শরিক হতে। আবার পূজাপার্বণে একত্রিত হয়ে পূজা উৎসব পালন করতে। তিনি হিন্দু না বৌদ্ধ, মুসলিম না খ্রিস্টান এ প্রশ্ন জিজ্ঞাস করা হলে তিনি বলতেন, I am neither a Hindu, nor a Muslim, nor a Buddihist, nor a Christain. I am a man and my religion is to serve the humanity.
মৃত্যুর পর তাকে কবরে দাফন করা হবে না শ্মশানে দাহ করা হবে- এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলতেন, ‘আমি মরে গেলে আমার আত্মাহীন দেহটা হবে তোমাদের সমস্যা। এ সমস্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য একে পুড়িয়ে ফেলতে পার। আমার কবরও দিতে পার। তাতেও সমস্যা হলে নদীতে ভাসিয়ে দিতে পার। তোমাদের সমস্যা কিভাবে সমাধান করবে সেটা তোমাদের ব্যাপার।’ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! তার মরদেহ শ্মশানে দাহ করতে হয়নি। কবরেও দাফন করতে হয়নি। পাক হানাদার বাহিনী তাকে হত্যার পর বিরাট গর্ত খুড়ে অনেকের মরদেহের সাথে একসাথে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছিল। তার মৃত্যুর নয় মাস পর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে জগন্নাথ হল ক্যাম্পাসে গণকবর খুঁড়ে অনেক কঙ্কাল পাওয়া গেছে। কিন্তু কোনটি ড. দেবের তা শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মরদেহের সাথে এবং তার জন্মভূমি বাংলাদেশের মাটির সাথে মিশে একাকার হয়ে আছেন।
৩
স্বাধীনতার উষালগ্নে একাত্তরে মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে, আর দ্বিতীয়টি বিজয় অর্জিত হওয়ার পূর্ব-মূহূর্তে ডিসেম্বরের মধ্যভাগে। একাত্তরের ২৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে জগন্নাথ হলের ছাত্র ও কর্মচারী কতজন প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন তার সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা কঠিন। এদের সংখ্যা আনুমানিক ৬০ হবে। জগন্নাথ হলের চারজন শিক্ষক, যথা- প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, কর্মব্যরত প্রভোস্ট জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, প্রাক্তন আবাসিক অধ্যাপক ও একসময়ের ভারপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষ সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য এবং উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ গমনেচ্ছু সহকারী গৃহশিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য আত্মদান করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে জগন্নাথ হলকে মহিমান্বিত করে গেছেন। প্রথম দুজন ও শেষোক্তজন মার্চের শেষ সপ্তাহে সংগ্রামের সূচনা পর্বে শহিদ হন, আর তৃতীয়জন বিজয়লগ্নে আত্মোৎসর্গ করেন।
নির্মলেন্দু গুণ ২৮ মার্চ জগন্নাথ হলে এসেছিলেন এবং তৎকালীন ঢাকার একাংশের একটি খণ্ডচিত্র তার এক কবিতায় বর্ণনা করেছেন। তার মতে কবি আবুল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সুপারিশ অনুসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট পাস হয়। আর তারই ফলে ১৯২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর স্বায়ত্তশাসিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের জন্য কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের হলে যথাক্রমে ‘Large assembly’ হিসেবে কোর্ট এবং ‘small but strong body’ হিসেবে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল গঠিত হয়।
কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্রিটিশ আমলে সামান্য যেটুকু স্বায়ত্তশাসন ভোগ করত, সেটুকুও ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তান আমলে রক্ষা করা সম্ভব হলো না। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির ফলে কার্যত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেওয়া হয়। ১৯৬১ সালে এক কালাকানুন জারি করে বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। উক্ত কালাকানুনের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকরা সাথে সাথেই প্রতিবাদ করেন। এখানে এ-কথাটি বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গের সমাজে চার দশকে এক বিশাল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম দিয়েছে। সে-কারণে ১৯৬৮-৬৯ সালে ছাত্রদের ১১-দফার ভিত্তিতে দেশব্যাপী যে বিরাট গণ-আন্দোলন সংঘটিত হয়, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে কালাকানুন বাতিলের দাবি বিশেষ জোরেশোরে উচ্চারিত হয়। অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি আর এককভাবে শিক্ষক ও ছাত্রদের দাবি হিসেবে রইল না, সেটি সমগ্র দেশবাসীর দাবিতে পরিণত হলো।
যে অসাম্প্রদায়িক লোকায়ত চেতনা নিয়ে নরেশ সেনগুপ্ত জগন্নাথ হলকে গড়ে তুলেছিলেন, তা বৃথা যায়নি। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগসহ নানা বিষয়ে জগন্নাথ হলকে নানাভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে। যদিও পাকিস্তান সৃষ্টির অনেক আগেই তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জগন্নাথ হল ও অন্যান্য হলের প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরা নব্য পাকিস্তানিদের চক্রান্তের শিকার হয়েছিলেন। এখনও পাকিস্তানি এলোমেলো হাওয়া ঘুরপাক খেতে দেখা যায়। আজ জগন্নাথ হলের সাবেক ছাত্রদের কারোর কারোর সাথে কলকাতায় আগরতলায় দেখা হয়। তারা নানা কারণে বাংলাদেশে থাকতে পারেন নি। এখানে উল্লেখ করা যায়, জগন্নাথ হলের সাবেক ছাত্ররা যারা ভারতে যেতে বাধ্য হয়েছেন তাদের অধিকাংশই গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরের ২১ বছর এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পরে ও ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পরের সময়কালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ বছরের প্রাক্কালে এই ভাবনা কতটুকু প্রয়োজন সময়ের বাস্তবতায় তা খুব জরুরী বলেই বিবেচনা করা উচিত।
লেখকঃ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক
সৌজন্যেঃ bdnews24.com