969
Published on জুন 28, 2021ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলঃ
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবিতে আন্দোলনের সূচনাটা ছিল একটা কঠিন সময়ে, যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন ছিল রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সেই আন্দোলনটি পরিপূর্ণতা পায় আরেক মহীয়সী নারীর হাত ধরে। আন্তর্জাতিক নানামুখী চাপ আর অবিশ্বাস্য অভ্যন্তরীণ নাশকতাকে নাকচ করে দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের সময়েই কার্যকর হয়েছে একের পর এক যুদ্ধাপরাধীর বিচার আর বিচারের দণ্ড।
দুই.
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি নারীর অবদান অসামান্য। অনেক দাম দিয়ে কেনা আমাদের স্বাধীনতার মূল্য আমরা চুকিয়েছি ৩০ লাখ শহীদের পাশাপাশি তিন লাখ বীরাঙ্গনার সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের মূল্যে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তাই বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন নিজ সন্তান হিসেবে, আর কৃতজ্ঞ জাতি তাদের দিয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধার সম্মান। পাশাপাশি পিরোজপুরে ভগীরথী আর জাহানারা ইমামদের মতো অসংখ্য বীর নারী মুক্তিযোদ্ধার সক্রিয় অংশগ্রহণও ছিল একাত্তরে।
তিন.
বর্তমান সরকারের উদ্যোগে সারা দেশে নির্মিত হচ্ছে ৫৬০টি আদর্শ মসজিদ। সম্প্রতি প্রথম দফায় এর মধ্যে ৫০টি মসজিদ ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। নামাজ পড়া ছাড়াও ইসলাম ও ইসলামী সংস্কৃতিচর্চা, অতিথিদের আবাসনসহ অসংখ্য ফিচার যুক্ত করা হয়েছে এসব মসজিদে। তবে সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এসব মসজিদে প্রথমবারের মতো সংযোজন করা হয়েছে মহিলাদের নামাজ পড়ার আলাদা ব্যবস্থা। ইতিহাসে এই প্রথম বাংলাদেশের উপজেলাগুলোতে জামাতে নামাজ আদায় করার সুযোগ পাচ্ছেন বাংলাদেশের নারীরা।
চার.
মুজিববর্ষে সরকারের অঙ্গীকার ছিল বাংলাদেশের একজন নাগরিকও আশ্রয়হীন থাকবেন না। সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এরই মধ্যে বিনা মূল্যে পাকা বসতভিটার দলিল হস্তান্তর করা হয়েছে লক্ষাধিক আশ্রয়হীন মানুষের মধ্যে। আর এই দলিলগুলোতে নিশ্চিত করা হয়েছে স্ত্রী ও স্বামীর যৌথ মালিকানা। নারীর ক্ষমতায়নের এক অনন্য দৃষ্টান্ত আবারও স্থাপন করল বাংলাদেশ।
পাঁচ.
নারীর ক্ষমতায়নের এমনি হাজারো নিদর্শন আজ আমাদের বাংলাদেশে। আমাদের পাসপোর্টে এখন শুধু বাবা নয়, ছাপানো থাকে মায়ের নামও। কয়েক দিন আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন কোর্সে ভর্তির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলো। আমি একটি কেন্দ্রে কন্ট্রোলরুমের দায়িত্বে ছিলাম। হলগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। আর গুনে গুনে যা দেখলাম তা হলো ভর্তীচ্ছু নারী আর পুরুষ ডাক্তারের রেশিওটা মোটামুটি ৬০ আর ৪০। আমার যেসব কলিগ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল টিচিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি—এখন দেশের মেডিক্যাল কলেজগুলোতেও নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীর রেশিও মোটামুটি এমনটাই।
ছয়.
শুধু চিকিৎসাবিজ্ঞানের জায়গায়ই নয়, বাংলাদেশের নারীরা আজ সর্বত্র। জাতীয় সংসদের স্পিকার থেকে শুরু করে এয়ারফোর্সের পাইলট কিংবা এসএসএফের অফিসার থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব অথবা ঢাকার রাজপথে স্মার্ট ট্রাফিক সার্জেন্ট—কোথায় নেই তাঁরা? তাঁরা যেমন আছেন দেশে, তেমনি আছেন বিদেশে দেশের দূতাবাসে কিংবা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে। সর্বত্রই আজ বাঙালি নারীর জয়জয়কার।
সাত.
বাঙালি নারীর এই শক্তির কথা জানা আছে বাংলা আর বাঙালির শত্রুদেরও। গার্মেন্টের মেশিনগুলো চলে যেসব নারীর ঘামে, যাদের ঘামে ঘোরে আমাদের অর্থনীতির চাকা, সেই নারীরাই ছিলেন তেঁতুল হুজুরদের টার্গেট তখন যেমন, আজও তেমনি। তাতে অবশ্য আমি মোটেও অবাক হই না, কারণ বাংলাকে ঘায়েল করতে হলে আর বাংলাদেশকে অকার্যকর বানাতে হলে আঘাতটা হানতে হবে বাঙালি নারীর ওপরই। জাহানারা ইমামের মতো মহীয়সী নারী তাই পুলিশের লাঠির আঘাতে জর্জরিত হয়েছেন ঢাকার রাজপথে আর তাঁকে হতে হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় আসামিও। আজ সেই মহীয়সী নারীর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করতে গিয়ে ধান ভানতে আমার শিবের এই গীত গাওয়ার উদ্দেশ্য অবশ্যই কিছুটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এমন দিনে লেখার কথা শুধু তাঁকে নিয়েই, অথচ তা না করে লিখছি বাঙালি নারীকে নিয়ে। কারণ জাহানারা ইমাম একজন শহীদ জননীই নন, তিনি আত্মশক্তিতে বলীয়ান, ফ্রি স্পিরিটেড বাঙালি নারীর প্রতীক।
আট.
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভায় সম্প্রতি একটি অদ্ভুতুড়ে ও চরম নিন্দনীয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এই কমিটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছে, যাতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর তাঁদের প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর সময় কোনো নারীকে সেখানে সম্পৃক্ত না করা হয়। পদাধিকারবলে কোনো নারীর যদি সেখানে থাকার কথাও থাকে, তাঁকে যেন কোনো পুরুষকে দিয়ে রিপ্লেস করা হয়। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে মহান জাতীয় সংসদে বসে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন—এটা ছিল আমার চিন্তারও বাইরে।
নয়.
টিভিতে প্রায়ই একটি স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়—একজন কিশোরীকে সবাই উৎসাহিত করছে, উঠে দাঁড়াতে। কিশোরীটি ইতস্তত করতে থাকে আর তার পর বলে উঠে, ‘উঠলে দাগ লেগে যাবে’। দাগ লাগতে আসলে আর কিছু বাকি নেই, দাগ এরই মধ্যে লেগে গেছে। তেঁতুল হুজুরের কথা সেদিন আমলে নিইনি, আজ নিচ্ছি মাননীয় সংসদ সদস্যদের সিদ্ধান্তটি। দাগ আসলেই লেগে গেছে। জাহানারা ইমাম জীবন দিয়ে বাঙালিকে ‘দাগমুক্ত’ করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্নের অনেকটাই বাস্তবায়ন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, দাগ আসলে লেগে গেছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এই দাগমুক্ত নন যেমন সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো, মুক্ত নন তেমনি অনেক সংসদ সদস্যও। এখন আমাদের উঠে দাঁড়াতেই হবে, নচেত বেশি দেরি হয়ে যেতে পারে। স্বপ্নালু চোখে একটি দাগমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি বলেই শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুবার্ষিকীতে একটু অন্যভাবে আমার এই শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা।
লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্যসচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ