আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

1562

Published on জুন 23, 2021
  • Details Image

ড. প্রণব কুমার পান্ডেঃ

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন একটি রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে দলটির। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার পরে নতুন গঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদ তৎকালীন অনেক নেতাকে এই সংগঠন ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি, শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম-সচিব করে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই দিনটি অন্যরকম তাৎপর্য বহন করে। কারণ, এই দল ও বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী নির্বাচন এবং প্রদেশের অধিকার বৃদ্ধি করার মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগ তার নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দেয়। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করে দলটি প্রতিষ্ঠার সময় ৪২-দফা এজেন্ডা গ্রহণ করে। পাকিস্তানের শাসনামলের প্রাথমিক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের প্রধান দাবির মধ্যে অন্যতম ছিল বাংলাকে দেশের অন্যতম সরকারি ভাষা, একজন একটি ভোট, গণতন্ত্র, সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং দুই পক্ষের মধ্যে বৈষম্য নির্মূলকরণ । ১৯৪৮-৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও এর ছাত্র সংগঠন-ছাত্রলীগ (১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত) অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানি হায়েনাদের মাধ্যমে নির্বিচারে ছাত্র হত্যার আগে আওয়ামী লীগই ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা অ্যাকশন কমিটি’ গঠনের পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিল।

১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচনকালীন যুক্তফ্রন্ট গঠনে আওয়ামী মুসলিম লীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই যুক্তফ্রন্টের অন্য দলগুলো ছিল কৃষক শ্রমিক পার্টি, নিজাম-ই-ইসলাম পার্টি এবং গণতান্ত্রিক দল। যুক্তফ্রন্ট ২১-দফা এজেন্ডা প্রচারের মাধ্যমে নির্বাচনে জনগণকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। এই ২১ দফার দুটি প্রধান দফা ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা ইস্যু’ এবং ‘পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি’। যুক্তফ্রন্ট ৮-১২ মার্চের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে এক দুর্দান্ত বিজয় অর্জন করেছিল। মুসলিম লীগ ২৩৭টি আসনের মধ্যে মাত্র নয়টি আসনে জয়লাভ করে এবং যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে ২২৩টি আসনে। আওয়ামী লীগ এককভাবে ১৪৩টি আসনে জয়লাভ করে।

১৯৫৭ সালের ১৮ মার্চ মওলানা ভাসানী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে বিরোধের জেরে দল থেকে পদত্যাগ করলে আওয়ামী লীগ একটি বড় সাংগঠনিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। শেখ মুজিবুর রহমান এই সংকটময় সময়ে সংগঠনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। মন্ত্রী হিসেবে মাত্র নয় মাস দায়িত্ব পালনের পর দলকে সুসংগঠিত করার জন্য ১৯৫৭ সালের ৩১ মে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। এটি সমসাময়িক রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা ছিল।

শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জেনারেল আইয়ুবের স্বৈরাচারী সরকারের অধীনে (১৯৫৮-১৯৬৯) পূর্ববঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করে। ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পরে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের প্রধান নির্বাচিত হয়ে দলকে পাকিস্তানের অন্যতম শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত করেন। ১৯৬২ সালে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বিপ্লবী ছাত্র আন্দোলন গঠিত হয়। এর ফলে আইয়ুব খান জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং একই বছর পাকিস্তানের দ্বিতীয় সংবিধান গৃহীত হয়। পরবর্তী দুই বছর রাজনৈতিক পরিবেশ উন্নতির কিছু ইতিবাচক দিক পরিলক্ষিত হয়। ১৯৬৪ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহর বিরুদ্ধে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের জয় এবং পরের বছর ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সেই ইতিবাচক পরিবর্তনের ধারা অপ্রত্যাশিতভাবে শ্লথ হয়ে যায়।

পূর্ব পাকিস্তানের মারাত্মক ভঙ্গুরতা ও অস্থিতিশীলতা রাজনীতিবিদ এবং যুবকদের দেশের রাজনৈতিক সম্ভাবনা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা পুনর্বিবেচনা করতে উৎসাহিত করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছয় দফা ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর পৃষ্ঠপোষকতায় এই ঘোষণা রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। ছয় দফা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি। এই ছয় দফার মধ্যে অন্যতম ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক মুদ্রা, একটি স্বতন্ত্র বাণিজ্য নীতি এবং পূর্ব পাকিস্তান মিলিশিয়া সংগঠন।

একই সঙ্গে, ১৯৬৬ সালে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদ্রোহের তাড়না বুঝতে পেরে সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার ৩৪ জন সহযোগীকে আটক করে। তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্রের মামলায় শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালের মে মাস থেকে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন। সেই সময়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র এবং আইয়ুব খান সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিদ্রোহ হয়।

জেনারেল ইয়াহিয়া খান দ্বারা ১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’ (আইনি কাঠামো আদেশ) কার্যকর করার পরে শেখ মুজিব একটি বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে যুক্ত রাষ্ট্র গঠনের একটি রূপরেখা প্রস্তাব করেন এবং পাকিস্তানের জনগণকে সংবিধান গঠনে তাঁকে এবং আওয়ামী লীগকে সমর্থন করার আবেদন জানান।

ইতোমধ্যে, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে সাইক্লোন আঘাত হানে এবং বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে সহায়তা বঞ্চিত হয়। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোতে ভ্রমণ করে শেখ মুজিব ঝড় থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষদের সহায়তা করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য পাকিস্তান সরকারের ব্যাপক সমালোচনা করেন। এই সময় তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। তিনি তাঁর বক্তব্য শেষ করে বলেছিলেন যে একটি গণভোটের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা অর্জন করা হবে। তাঁর এই বক্তব্যের মাধ্যমে যে বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছিল তা হলো শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের শেষের দিক থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা শুরু করেছিল।

১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন এবং ১৯৭০ সালের নভেম্বরে সাইক্লোনের কারণে সৃষ্ট বিপর্যয় ডিসেম্বরের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এক দুর্দান্ত জয় পায়। জাতীয় পরিষদে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৩৮টি আসনের মধ্যে ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রাপ্ত ৮১টি আসনের তুলনায় শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০ আসনে জয়লাভ করে।

এই দুর্দান্ত জয়ের পরে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পাকিস্তান সরকারের অনীহা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। আওয়ামী লীগ, শিক্ষার্থী ও শ্রমিকরা বিদ্রোহ চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের ভবিষ্যতের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি ঘটনাবহুল দিনে পরিণত হয়। সেদিন শেখ মুজিব ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে তাঁর ভাষণে কূটনৈতিক ভাষায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের নিরীহ জনগণের ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে গণহত্যা চালায় তখন শেখ মুজিবের কাছে সরকারিভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ছাড়া কোনও বিকল্প ছিল না।

ফলস্বরূপ, বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।

বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে পাকিস্তানের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। স্বাধীনতার ঘোষণার পরপরই শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে নির্জন কারাগারে বন্দি করা হয়। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নেতারা এবং বাংলাদেশের জনগণ ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করে। অবশেষে, দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। যার ফলশ্রুতি বিশ্ব মানচিত্রে একটি সদ্য স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম হয়।

পরিশেষে বলা বলা যায় যে প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, এবং বাংলাদেশ আমাদের দেশের ইতিহাসে নিরবচ্ছিন্ন অংশ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও এ দেশের সাধারণ জনগণ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছে। তবে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সেনাবাহিনীর কিছু বিপৎগামী সদস্য বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করলে দেশের অগ্রগতির পথ শ্লথ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলে দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হতে থাকে। তবে ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় হলে সেই অগ্রযাত্রা পুনরায় থেমে যায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে বিশাল বিজয় অর্জন করে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন দেশের উন্নয়নে। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পর পর তিনবার ক্ষমতায় এসেছে। তাঁর নিরলস পরিশ্রমের কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ার লক্ষ্য অর্জনের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে বাংলাদেশ।

লেখক: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যেঃ বাংলা ট্রিবিউন

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত