বঙ্গবন্ধুর ও আওয়ামী লীগের গণমুখী নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি

2839

Published on জুন 21, 2021
  • Details Image

১৯২০ সাল, খুব মজার একটা হিসেব আছে এখানে। এই বছরই কিন্তু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন মহাত্মা গান্ধী। খেয়াল করে দেখবেন, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও কিন্তু জন্মগ্রহণ করেছেন এই বছরেই। পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আওয়ামী রীগের অসহযোগ কর্মসূচির সফল প্রয়োগ করেছিলেন তিনি ১৯৭১ সালে। কাকতালীয় হলেও সত্য, মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সর্বাত্মক অসহযোগিতার কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন ৫১ বছর বয়সে। আর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ আওয়ামী লীগ প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন ঘোষণা দেন 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম', তখনও কিন্তু তার বয়স ছিল ৫১ বছর।

বঙ্গবন্ধু শুধু আওয়ামী লীগের রাজপথে আন্দোলনের নেতাই নন। দলের পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণভাবে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি বাস্তবায়নের রূপকারও তিনি। তবে মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনা-কৌশলে মৌলিক পার্থক্য আছে। স্বাধীনতা আন্দোলন শান্তিপূর্ণ রাখার ব্যাপারে গান্ধীজি ছিলেন অনঢ়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু প্রয়োজনে রণমূর্তি ধারণ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। তিনি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মতো সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে ছিলেন, কিন্তু কৌশলের প্রয়োজনে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছেন। বঙ্গবন্ধু ও তার দল আওয়ামী লীগ গণমানুষের সম্পৃক্ততায় বিশ্বাস করতেন, বিশ্বাস করতেন জনমতের ওপর, রাজনীতি করতেন একে কেন্দ্র করেই।  

জনসম্পৃক্ততা: 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের অন্যতম কৌশল ছিল সর্বোচ্চ জনসম্পৃক্ততা। তিনি মাত্র ২৯ বছর বয়সে আওয়ামী মুসলিম লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারি বা যুগ্ম সম্পাদক। তখন তিনি কারাগারে। মুক্তি পেতে না পেতেই নতুন মিশন- পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়েছে, পশ্চিম পাকিস্তানের সমমনা গণতান্ত্রিক শক্তিকেও তাতে শামিল করে পাকিস্তানভিত্তিক একক রাজনৈতিক দল গঠন করতে হবে। এ মিশন নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নির্দেশে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তান। তিনি এ দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসার পর তার স্থান হয় কারাগারে- একটানা প্রায় আড়াই বছর।

এ-সময়ের মধ্যেই ২১ ফেব্রুয়ারির অমর গাঁথা রচিত হয়ে গেছে। কারাগারে কিংবা মাঝেমধ্যে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে থাকার সুযোগে তিনি নিজেকে কেবল আন্দোলনেই সম্পৃক্ত রাখেননি, যথাযথ দিক-নির্দেশনাও দিয়েছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হলে তিনি জেলে থেকেই তাতে একাত্মতা ঘোষণার জন্য অনশন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এ আন্দোলন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং তাতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নিচ্ছে- এমনটিই তিনি চেয়েছিলেন।

‘জনসমর্থন ছাড়া বিপ্লব হয় না'- আমার দেখা নয়াচীন গ্রন্থে তিনি লিখেছেন। ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্টে আওয়ামী লীগেরই ছিল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনরা তাদের হাতে ক্ষমতা দিতে চায়নি। দিনের পর দিন রাজপথের সংগ্রামের কারণে তারা অবস্থান পরিবর্তনে বাধ্য। আর এই আন্দোলন সংগঠনের প্রধান কৃতিত্ব ছিল দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের। সে-সময়ের সান্ধ্য দৈনিক ‘চাষী’ খবর দিয়েছিল এভাবে আওয়ামী লীগ রাজপথের আন্দোলন জোরদার করতে থাকে। ৪ সেপ্টেম্বর ১৪৪ ধারা অমান্য করে প্রাদেশিক রাজধানীতে ক্ষুধার্ত মানুষের মিছিল বের হয়। গুলিতে কয়েকজন হতাহত হয়। গুলিতে নিহত একজনের লাশ নিয়ে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বিশাল মিছিল রাজপথ প্রদক্ষিণ করে।

প্রকৃতপক্ষে এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জনসমর্থনপুষ্ট ও সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য নেতা হিসেবে বের হয়ে আসেন। রাজপথের আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্র হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে প্রাদেশিক গভর্নর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ৬ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খানকে নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগের পাঁচজন, কংগ্রেস থেকে দুজন, গণতন্ত্রী দল থেকে একজনসহ মোট ১১ জন নিয়ে তিনি মন্ত্রিসভা গঠন করেন। শেখ মুজিবুর নিযুক্ত হন শিল্প, বাণিজ্য, পল্লি উন্নয়ন ও শ্রম দফতরের মন্ত্রী হিসেবে।

আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই একটি বিষয় লক্ষ্য করা গেছে- জেলা-মহকুমা-থানা পর্যায়ে তিনি বারবার ছুটে গেছেন। কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন, জনসমাবেশে বক্তব্য রেখেছেন। দল ক্ষমতায় থাকার কারণে যে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা তিনি কাজে লাগিয়েছেন দলের গণভিত্তি প্রসারের জন্য। এর সুফল মিলেছে ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির পর। পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালিকে গোলাম করে রাখার অপচেষ্টা করেছিল। কিন্তু ১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৬ ও ১৯৬৯ সালের প্রবল ছাত্র-গণআন্দোলন সেটা নস্যাৎ করে দেয়।

এ-সময়ের অভিজ্ঞতায় বঙ্গবন্ধু আরও একটি বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছিলেন- পাকিস্তানের ‘অখণ্ডতা ও সংহতির আবেগ’ নিয়ে পড়ে থাকলে বাঙালির স্বাধিকারের স্বপ্ন পূরণ হবে না। এটাও বুঝে গিয়েছিলেন- কেবল রাজপথের মিছিল-সমাবেশ এবং হরতাল-ঘেরাও-অবরোধ নয়, সশস্ত্র সংগ্রামও সম্ভবত অনিবার্য। স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল করে তোলার জন্য কেবল রাজপথের জঙ্গি কর্মী যথেষ্ট নয়, বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিসেবী-পেশাজীবী- সকলের সক্রিয়তা চাই। প্রতিবেশী ভারতসহ আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন-সহযোগিতাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলেন তিনি।

নির্বাচন: 

সংগঠন গুছিয়ে তোলার প্রতিও ছিল সমান মনোযোগ। ষাটের দশকের প্রথম দিকের আন্দোলনে ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছিল বাপক। কিন্তু ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের ঐতিহাসিক হরতালে আদমজী-ডেমরা-তেজগাঁও-টঙ্গী অঞ্চলের শ্রমিকরা ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে। এটা ছিল ষাটের দশকের শুরু থেকেই শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর সচেতন উদ্যোগের ফল। ঊনসত্তরের ২৪ জানুয়ারির গণ-অভ্যুত্থানও সংঘটিত হতে পেরেছিল শ্রমিকরা বিশাল বিশাল মিছিল নিয়ে ঢাকার রাজপথে চলে আসার কারণে। ছাত্র ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিসার ও কর্মচারীদের সঙ্গে অভিন্ন কণ্ঠে তারা দাবি তোলে- আগরতলা মামলা তুলে নাও। শেখ মুজিবের মুক্তি চাই। পিন্ডি না ঢাকা ঢাকা ঢাকা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা তোমার আমার ঠিকানা স্লোগানের সঙ্গেও তারা একাত্ম অনুভব করে।

বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন কৌশলের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল নির্বাচন। ১৯৫৪ সালে এটা আমরা দেখেছি। ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল ফাতেমা জিন্নাহকে সামনে রেখে। এ নির্বাচন উপলক্ষে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র সভা-সমাবেশ করেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনকে তিনি ৬-দফা ইস্যুতে গণভোট হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। জনসমর্থন সংগঠিত করার জন্য তিনি ছুটে গেছেন শহর-বন্দর-গ্রাম, বাংলার আনাচে-কানাচে। সামনে কঠিন লড়াই- এ বার্তা সে-সময়েই তিনি দিতে পেরেছেন এবং জনগণও তা উপলব্ধি করেছেন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঠিক তিন মাসের দিন ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- এমন দ্ব্যর্থহীন ঘোষণার প্রতি যে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন মেলে, তার প্রেক্ষাপট তো তৈরি হয়েই ছিল। তিনি সমবেত লাখ লাখ মানুষের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন আমার প্রতি আপনাদের আস্থা আছে? মুহূর্তে সমর্থনসূচক বার্তা মিলেছে।

 এই আস্থা গড়ে উঠেছে পাকিস্তানের ২৩ বছরে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য তার নিরলস স্বপ্ন ও সাধনার জন্য এবং এ লক্ষ্য অর্জনে সময়োপযোগী কর্মসূচি ও কর্মকৌশল অনুসরণে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ থাকার কারণে। তিনি যে ‘বাংলাদেশ’ চাইছেন, সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। নিষ্ঠুর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এমন ঘোষণা ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’, সেটা তার চেয়ে আর ভালো কেই-বা জানতেন। কিন্তু ততদিনে তো নিশ্চিত হয়ে গেছেন- বাঙালি স্বাধিকার চায়। কেউ তাকে দাবায়ে রাখতে পারবে না।

সশস্ত্র আন্দোলন এবং অসহযোগ: 

১৯৭১ সালের ১ মার্চ যখন স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রাম শুরু হলো, বিন্দুমাত্র দ্বিধায় পড়েননি জাতির পিতা। ৩ মার্চের নির্ধারিত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকাল স্থগিত ঘোষণার মুহূর্ত থেকেই পূর্ব পাকিস্তান পরিণত হয় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে। বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত, সেটা তিনি জানিয়ে দেন। বাংলাদেশ-এর সর্বত্র স্বাধীনতার সমর্থনে শুরু হয় মিছিল-সমাবেশ। প্রতিটি কর্মসূচি ছিল শান্তিপূর্ণ। জনগণকে জাতির পিতা প্রস্তুত করেছিলেন বলেই একসঙ্গে গোটা দেশ প্রায় একসঙ্গে রাজপথে নেমে এসেছিল। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত ছাত্র-জনতার বিশাল সমাবেশে তোলা হয় স্বাধীনতার পতাকা, ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার এ পতাকাকে অভিবাদন জানিয়েই শপথ গ্রহণ করে। ১ মার্চ দুপুর থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশই একমাত্র কার্যকরী নির্দেশ। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত বিশাল সমাবেশে তিনি বলেন, আমাদের আন্দোলন সত্যাগ্রহ, অসহযোগ। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চলবে।

১ মার্চ থেকেই সামরিক আইন বিধি ও নির্দেশ বাংলাদেশের মানুষ উপেক্ষা করে। ৭ মার্চ রেসকোর্সের সমাবেশ থেকে কার্যত স্বাধীনতা ঘোষণার আগেই আদালতের বিচারক, সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর বেশিরভাগ বাঙালি সদস্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সংবাদপত্র-বেতার-টেলিভিশন কর্মী থেকে সর্বস্তরের জনতার যাবতীয় নির্দেশনা গ্রহণ করতে থাকে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িকে কেন্দ্র করে পরিচালিত ‘বিকল্প সরকারের কাছ থেকে’। বঙ্গবন্ধুর সরকারের আইনগত বৈধতা ছিল। কারণ জনগণ ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুকে কেবল ‘বাংলাদেশ’ নয়, গোটা পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রদান করেছিল।

৭ মার্চ রেসকোর্সের ঐতিহাসিক সমাবেশের পর শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়। সামরিক সরকার নিয়ন্ত্রিত বেতার-টেলিভিশন-সংবাদপত্র সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশ কেবল উপেক্ষা করেনি, একইসঙ্গে প্রচার করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ। বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর সরকার একদিকে ছিল আইনসম্মত এবং গোটা বাংলাদেশ ভূণ্ডের ওপর একইসঙ্গে তার কার্যকর কর্তৃত্ব নিয়েও কোনো সংশয় ছিল না।

অসহযোগ আন্দোলন চলাকালেই তিনি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের প্রশাসনিক-অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার কাজ শুরু করেন। রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রশাসন- বিভিন্ন বিষয় দেখাশোনার জন্য দায়িত্ব দেন পৃথক পৃথক বিশেষজ্ঞ দলকে।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কার্যকর প্রশাসনিক কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার পাশাপাশি আরও একটি বিষয়ে মনোযোগী হন- ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’, এ নির্দেশকে বাস্তবে রূপদান। অসহযোগ আন্দোলন শান্তিপূর্ণ রাখার বিষয়ে তিনি ছিলেন দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। একইসঙ্গে স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র ধারণ করতে হলে সেটাই করা হবে, এ বিষয়েও কোনো সংশয় তার মনে ছিল না। ছাত্রছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে প্রকাশ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু করে। অস্ত্র হাতে রাজপথে মিছিল বের হয়। সংবাদপত্রে এ বিষয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের সর্বত্রও সশস্ত্রযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। নারীরাও দলে দলে এতে এতে অংশ নেয়। সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্য, পুলিশ-ইপিআর-আনসার বাহিনীর বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণার পাশাপাশি উৎসাহীদের অস্ত্রচালনা শিক্ষা দিতে শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে গোটা দেশ জেগে ওঠে এক নতুন উন্মাদনায়- প্রয়োজনে রক্ত দেব, স্বাধীনতা আনবই।

অসহযোগ আন্দোলনের এক পর্যায়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দেন এবং ঢাকায় আসার আগ্রহের কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে স্বাগত জানাবেন কিনা, দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে তিনি যে উত্তর দেন তাতে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টির যেমন পরিচয় মেলে, একইসঙ্গে কূটনীতির ভাষাও যে তিনি কতটা রপ্ত করে ফেলেছেন সেটা উপলব্ধি করতেও কারও সমস্যা হয় না। তিনি বলেছিলেন, ‘বাঙালিরা অতিথিপরায়ণ। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অতিথি হিসেবে ঢাকা আসলে তাকে আমরা অতিথি হিসেবে অবশ্যই স্বাগত জানাব।’

আমরা জানি, এক দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান অন্য দেশ সফরে গেলে অতিথি হিসেবে গণ্য হন। ইয়াহিয়া খানকে বাঙালিরা অতিথি হিসেবে স্বাগত জানাবে- এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম সত্তায় আবির্ভূত হয়েছে।

তার এই ঘোষণা যে নিছক কথার কথা ছিল না, অসহযোগ আন্দোলন আরও সংগঠিতভাবে অগ্রসর করে নেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে যে ৩৫-দফা নির্দেশনা জারি করা হয়, সেটা প্রকাশের তারিখ থেকেও স্পষ্ট। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার জন্য ইয়াহিয়া খান ঢাকা আসেন ১৫ মার্চ এবং সেদিন থেকেই এটা কার্যকর করা হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বন্দর, আমদানি বাণিজ্য, রেলওয়ে, সড়ক পরিবহন, ডাক ও টেলিফোন বিভাগ, বেতার-টেলিভিশন-সংবাদপত্র, হাসপাতাল, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি, কৃষি, সেচ, নির্মাণকাজ, সাহায্য-পুনর্বাসন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেতন, ট্রেজারি কার্যক্রম, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক, খাজনা ও কর আদায় না করা- সব কিছুই ছিল এর আওতায়। বলা যায়, ৩৫-দফা ছিল সার্বভৌম সরকারের নির্দেশনা। বাংলাদেশের সর্বত্র এটা মান্য করা হয়।

একইসঙ্গে এটাও লক্ষ্য করি আমরা- অসহযোগ আন্দোলন চলছে। কিন্তু যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক। ৬ মার্চের পর আর হরতাল ডাকা হয়নি। মানুষের যেন দুর্ভোগ সৃষ্টি না হয়, সেটা ছিল মনোযোগের কেন্দ্রে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেন থেমে না যায়, সে-বিষয়েও লক্ষ্য ছিল।

 

 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত