1207
Published on জুন 7, 2021মোঃ হাফিজুর রহমানঃ
"আমাদের দেশে হবে ছেলে সেই কবে কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।" কবি কুসুম কুমারী দাসের সেই আদর্শবান ছেলে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি তার কথা অপেক্ষা বেশি অর্থাৎ অসংখ্য কাজের মাধ্যমে জন্ম দিয়েছেন একটি সোনার বাংলা, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের। বাংলাদেশ নামক একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন যিনি প্রথম দেখেছিলেন তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
অনেক সময় সত্য ও সুন্দর বর্তমানকে উপভোগ করতে হলে ইতিহাসের সঠিক তথ্য জানাটা অত্যাবশক।স্বাধীন দেশের প্রয়োজনে যেমন সংগ্রাম ও বিদ্রোহের প্রয়োজন ছিল তেমনি লড়াই পরিচালনার জন্য দক্ষ সেনাপতিরও প্রয়োজন ছিল। ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য যেমন ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের প্রয়োজন ছিল তেমনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের জন্য আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রয়োজন ছিল ঠিক তেমনিই ৬ দফার জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগে বঙ্গবন্ধুর প্রয়োজন ছিল।
আমি আমার আলোচনাকে দু ভাগে ভাগ করেছি; এক- সুদূরপ্রসারী বঙ্গবন্ধু এবং দুই- ৬ দফায় বঙ্গবন্ধুর সংগঠন। সুদূরপ্রসারী বঙ্গবন্ধু: ৬৬ সালের ৬ দফা হুটহাট করে হয়নি।এর জন্য সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা ও অপরাজেয় মনোভাবের প্রয়োজন ছিল।এর এক ইতিহাস রয়েছে যার সাথে পিতা মুজিবের দেশ স্বাধীন করার এক মহৎ পরিকল্পনার মিল রয়েছে।
ইতিহাসে দেখা যায়, ১৯৬২ সালের মার্চ মাসে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ইন্ডিয়ান হাইকমিশনারের পলিটিক্যাল অফিসার শেখর ব্যানার্জির মাধ্যমে ইন্ডিয়ান দূতাবাস হয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নেহেরুর কাছে বঙ্গবন্ধু চিঠি পাঠান যে তিনি যদি লন্ডনে বসে ৬৩ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের কোনো এক সময় প্রবাসী সরকার গঠন করে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে তাহলে ইন্ডিয়ার সাপোর্ট পাবে কিনা।
তখনকার সময়ে ইন্ডিয়া -চীন যুদ্ধাবস্থায় চিঠির উত্তর দিতে সময় নেওয়ায় নেহেরু পিতা মুজিবকে ধৈর্য ধারণ করতে বলেন এবং কোনো ধরনের মাধ্যম ব্যবহার না করে সরাসরি তার সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করেন।
চীনের সাথে যুদ্ধাবস্থায়ও পিতা মুজিবের অনুরোধে সারা দিয়েছিল ভারত। ধৈর্য্য ধারণ করলেও পিতা মুজিব বসে থাকেননি।তার গঠিত ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের তিনি সুসংগঠিত করতে থাকেন। আর এই ছাত্রলীগ তিনি স্বাধীন বাংলা গড়ার নিমিত্তে ৫২ সালে গঠন করেছিলেন কারণ তিনি জানতেন যে তারুণ্য অফুরন্ত প্রাণ শক্তির অধিকারী থাকে।তরুণরাই আগামীর ভবিষ্যৎ।
আমরা অনেকেই আগড়তলা মামলাকে মিথ্যে ষড়যন্ত্র বললেও সেটা আসলেই সত্য।আগড়তলা সত্য মামলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা সময়ের দাবি। ৬ দফা দাবীর অন্যতম শর্ত ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। যার ফলে আগড়তলায় বসে আসলেই সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার প্রয়াস নেওয়া হয়।
৬ দফার ফলে এ পরিকল্পনা, ফলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার থেকে "রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য" মামলা দেওয়া হয় ফলে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় যা পরে ৬৯ এর গন অভ্যুত্থান এ পরিণত হয় এবং ফলে ৭১ এ আমরা পাই স্বাধীন বাংলাদেশ নামক একটা রাষ্ট্র। ৬ দফায় বঙ্গবন্ধুর সংগঠন: সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন বাঙালি মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন তখন তৎকালীন আইয়ুব খানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী,অক্সফোর্ডের নাম করা ছাত্র জুলফিকার আলি ভুট্টো ৬ দফাকে চ্যালেঞ্জ করে পল্টনে তর্কের আহ্বান জানান এবং ভুট্টো তার উপদেষ্টা সহ দলবল নিয়ে আসে।এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু আগেরদিন রাতে ভুট্টোর কাছে তাজউদ্দীন আহমেদ কে আনুষ্ঠানিক ভাবে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের কথা জানানোর জন্য পাঠালে তার প্রেরিত যুক্তি ও ব্যাখ্যা শুনে তর্কের জন্য নির্দিষ্ট দিন সকালে দলবল সহ পালানোর মতো করে ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে!
জুলফিকার আলির মত মেধাবী মন্ত্রী পর্যন্ত ৬ দফা দাবির যৌক্তিকতা বুঝতে পারলেও তখনও এ দাবী নিয়ে আওয়ামী লীগ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল।অর্থাৎ, তখনকার সময়ে তার এ দাবির প্রতি সমর্থনের জন্য তিনি ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ পাননি।এমনকি আওয়ামী ঘেষা পত্রিকা ইত্তেফাক পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর দাবীর বিরোধিতা করে যদিও পরে সমর্থন দেওয়াতে মানিক মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। মাওলানা ভাসানীর মত প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা বুঝতে সক্ষম হননি যার দরুন তিনি এ দাবীকে সিআইএ'র দলিল পর্যন্ত বলেছেন!
৬ দফার গুরুত্ব বুঝতে পেরে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে "পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য" শিরোনামে প্রবন্ধ পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়।২১ ফেব্রুয়ারী ধানমন্ডিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ এর কার্যকরী সভায় ৬ দফা প্রস্তাব পাশ করার জন্য পেশিশক্তির মহড়া পর্যন্ত ছাত্রলীগ দিয়েছিল!কারণ ছাত্রলীগ মাত্রই পিতা মুজিবের চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন মারা যান মূলত তখনই জাতির পিতার হাত ধরেই নতুন করে ১৯৬৩ সালের পর থেকে স্বাধীকার আন্দোলনের নেতৃত্ব শুরু হয়েছিল যা বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বুঝতে পেরে পিতা মুজিবের ৬ দফা আন্দোলন কে সর্বপ্রথম সমর্থন দিয়ে একে বাঙালি জাতির "ম্যাগনাকার্টা" হিসেবে আখ্যায়িত করে।পাশাপাশি ৭ ই জুন ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের প্রতিটি অঞ্চলে হরতাল পালন করা হয়। এর মধ্যে ১৯৬৬ সালে ময়মনসিংহ ও সিলেটে এবং বিশেষ করে চট্রগ্রামে ৬ দফার প্রচারণার জন্য বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। ৭ জুন,৬ দফার দাবিতে আন্দোলনে ১১ টা তাজা প্রাণ শহীদ হয়,৮০০ জনেরও বেশি মানুষকে গ্রেফতার করা হয় যার মধ্যে টগবগে তরুণ ছাত্রলীগ কর্মীরা ছিল। এ অত্যাচার,প্রকাশ্য হত্যা ও গ্রেফতারের ফলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মৃত্যুবরণ করার পর যে স্বাধিকার আন্দোলন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল তা ৭ জুন থেকে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়।
আর এ রূপান্তরিত স্বাধীনতার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর পাশে ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানে, ৭০ এর নির্বাচন পাশাপাশি ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও পাশে থেকে ১৭ হাজার ছাত্রলীগ কর্মী শহীদ হন।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়