1208
Published on জুন 7, 2021অজয় দাশগুপ্তঃ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য ছয় দফা কর্মসুচি আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করেছিলেন ৫৫ বছর আগে, ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে। কয়েকদিন আগে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির এক আলোচনায় একাধিক বিশেষজ্ঞ বলছিলেন- ছয় দফা প্রদানের মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। এ কর্মসূচির কারণেই শেখ মুজিবুর রহমান ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়েছেন, ‘জাতির পিতা’ হিসেবে মর্যাদা পেয়েছেন। এত বছর পর ছয় দফা কিংবা ৭ জুন দিবস পালন অর্থহীন। ঐতিহাসিকরা অনেক ঘটনার মধ্যে এ ঘটনার উল্লেখ করতে পারেন, যেমন করা হয় ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান দিবস কিংবা ১১ মার্চ (১৯৪৮) বা এইচ এম এরশাদের ক্ষমতা ছাড়ার দিন ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর।
৭ জুন বা ছয় দফা দিবস পালনকে কি এভাবে দেখা যায়? ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরোধী কয়েকটি দল লাহোরে একটি কনভেনশন আহ্বান করে। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী প্রভৃতি দল এর উদ্যোক্তা। শেখ মুজিবুর রহমান তখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ। বঙ্গবন্ধু মাত্র কয়েকদিন আগেই কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন জরুরি আইন ও দেশরক্ষা আইন বাতিলের দাবি উত্থাপন করার কারণে। ২৮ জানুয়ারি তাকে এক বছরের দণ্ড দিয়ে জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি হাইকোর্টে আবেদন করে জামিনলাভ করেন। কনভেনশন আহ্বানকারীরা জানতেন, শেখ মুজিবুর রহমান বয়সে অপেক্ষাকৃত ইয়ং, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের আমজনতার কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নেতা। ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ দিন পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, তাতে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে একটি থ্রি নট থ্রি রাইফেলের গুলিও নিক্ষেপ করেনি। কোনো বিমান হামলা হয়নি, কামানের গোলাও নিক্ষেপ করা হয়নি। যুদ্ধ হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান ভূখণ্ড ও সংলগ্ন ভারতীয় ভূখণ্ডে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান দাবি করছিলেন যুদ্ধে তাদেরই বিপুল জয় হয়েছে। কিন্তু ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, যুদ্ধে ভারত পাকিস্তানের ৭২০ বর্গমাইল ভূখণ্ড দখল করেছিল, পাকিস্তান দখল করেছিল ভারতের ৩০০ বর্গমাইল ভূখণ্ড। দুটি দেশের সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রচুর, পাকিস্তানের ক্ষতি তুলনামূলক বেশি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল- আইয়ুব খান ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর ভূখণ্ড দখলের জন্য এই যুদ্ধের সূচনা করেছিল। কিন্তু যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কাশ্মীর দখলে আসেনি। বরং দুটি দেশ ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের মধ্যস্থতায় যে শান্তি চুক্তি সম্পাদন করে তার প্রথম ধারাতেই শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনার মাধ্যমে সব বিরোধের নিষ্পত্তির কথা বলা হয়। তাহলে কাশ্মীরের কী হবে, পাকিস্তানের ধর্মান্ধ দলগুলোর নেতারা এ প্রশ্ন তুলে আইয়ুব খানকে বিব্রত করতে থাকেন।
পাক-ভারত যুদ্ধের কিছুদিন পর ২৬ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঢাকায় এসেছিলেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য। গভর্নর হাউসের (বর্তমান বঙ্গভবন) বৈঠকে নুরুল আমীন, হামিদুল হক চৌধুরী, সালাম খান, মৌলভী ফরিদ আহমদ প্রমুখ নেতাদের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানও সেখানে ছিলেন। একদল অনুগ্রহপ্রার্থী রাজনীতিক এসেছেন, এমন ভাব দেখিয়ে বৈঠকের শুরুতেই আইয়ুুব খান বলেন- ‘বলুন, আপনারা কেন এসেছেন? কী আপনাদের বক্তব্য?’ বিরোধী নেতারা সব চুপ। কিন্তু উঠে দাঁড়ালেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, আমরা তো নিজে থেকে আসিনি। আপনি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তাই এসেছি। আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট হতে পারেন, কিন্তু আমাদেরকে ডেকে এনে অপমান করার অধিকার আপনার নেই।’ [বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, পৃষ্ঠা ৩৩৭]
বঙ্গবন্ধু সরাসরি আইয়ুব খানকে প্রশ্ন করেন, যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানকে কেন অরক্ষিত রাখা হলো? ভারত চাইলে তাদের সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বিনা বাধায় যেতে পারত। কারণ এখানে প্রতিরক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। পূর্ব বাংলাকে কীভাবে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে সে প্রশ্নও তোলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বিস্মিত ও হতবাক হয়ে পড়েন। তাঁর অনুগতরা মনে করেন- শেখ মুজিব ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু পূর্ব বাংলার জনগণ এ বৈঠকের খবর পাঠ করে খুশি হয়। তারা বুঝতে পারে- আইয়ুব খানকে চ্যালেঞ্জ করার উপযুক্ত নেতা এতদিনে পাওয়া গেছে।
ওই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের পরিচিত নেতাদের মধ্যে ছিলেন ন্যাপ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ভারতবিরোধী জেহাদ তুলে ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব খান স্লোগান নিয়ে বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করেন। আরেক নেতা নুরুল আমিন ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় ছাত্রদের গুলি করে হত্যার কারণে চরম ধিকৃত। ১৯৫৬-১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী এবং ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আতাউর রহমান খানের কাছে শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে বিরোধী দলগুলোর কনভেনশনের আগে ৬-দফার খসড়া নিয়ে গিয়েছিলেন। স্বায়ত্তশাসনের এই দাবি ১৯৪৭ সালের পর থেকে টানা এক দশক আওয়ামী লীগ নেতারা নানাভাবে তুলছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার ১৯ নম্বর দফা ছিল এভাবে- ‘ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক ও মুদ্রাব্যবস্থা ছাড়া অন্য সব বিষয়ে পূর্ব বাংলার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা। নেভি হেডকোয়ার্টরস পূর্ববঙ্গে স্থানান্তর করতে হবে। পূর্ববঙ্গকে অস্ত্রের ব্যাপারে স্বনির্ভর করার জন্য পূর্ববঙ্গে অস্ত্র কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
বঙ্গবন্ধুর ওপর যেসব গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তাতে ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩ তারিখ বলা হয় শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন জনসভায় বলছেন- বাংলাকে তিন মাসের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের স্কুল সিলেবাসে বাধ্যতামূলক করা না হলে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু বয়কট করা হবে। কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে পূর্ব বাংলাকে ৫০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব দেওয়া হয়েছে, যদিও পাকিস্তানের মোট লোকসংখ্যার ৫৬ শতাংশ পূর্ব বাংলার বাঙালি। আমরা প্যারিটির বিরোধিতা করি। তবে যদি কেন্দ্রীয় রাজধানী ও সামরিক সদর দফতর করাচি থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়, নৌবাহিনীর সদর দফতর চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা হয় তাহলে আইন পরিষদে প্যারিটি মানতে পারি। [গোয়েন্দা রিপোর্ট, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬২-৬৪]
পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আরও বেশি করে সোচ্চার হন। ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। প্রস্তাব উত্থাপন করেন আওয়ামী লীগের মহিউদ্দিন আহমদ। শেখ মুজিবুর রহমান প্রস্তাবের ওপর আলোচনাকালে বলেন, এটা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের দাবি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আমরা এই দাবির ভিত্তিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি। জাতীয় পরিষদে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময় আমরা এই প্রস্তাব তুলেছি। অর্থ, বৈদেশিক নীতির সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে। আজ আমরা দেখতে পাই পাকিস্তানে দুইটা অর্থনীতি চলছে- একটা পশ্চিম পাকিস্তানে, আরেকটা পূর্ব পাকিস্তানে। শ্রম শিল্পের উন্নয়ন পশ্চিম পাকিস্তানে হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানে হয় নাই।
১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে লাহোরের সর্বদলীয় জাতীয় সম্মেলনে স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলতে চান- এ প্রস্তাব নিয়ে বঙ্গবন্ধু গিয়েছিলেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমানের কাছে। তাঁর জবাব ছিল- ‘মুজিবর মিয়া, আপনি এ দাবি তুললে নিজেও ফাঁসিতে ঝুলবেন, আমি তুললে আমাকেও ফাঁসির দড়ি পরতে হবে।’ [সূত্র : সাবেক ছাত্রনেতা শেখ শহীদুল ইসলামের সঙ্গে লেখকের সাক্ষাৎকার]
সাবেক ছাত্রনেতা ও গবেষক শেখর দত্ত ষাটের দশকের গণজাগরণ গ্রন্থে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের ভাষ্য উল্লেখ করে লিখেছেন এভাবে- ‘লাহোরে অধিবেশন চলাকালে শেখ মুজিবুর রহমান হঠাৎ বোমা নিক্ষেপ করলেন, ৬-দফা প্রস্তাব বা দাবির আকারে একটা রচনা নকল করে সদস্যদের মধ্যে বিলি করা হলো। কোনো বক্তৃতা বা প্রস্তাব নেই, কোনো উপলক্ষ নেই, শুধু কাগজ বিতরণ। জাতীয় কনফারেন্সে এই দাবি নিক্ষেপ করার কী অর্থ হতে পারে?...ঢাকায় ফিরে এসে মহাসমারোহে ৬-দফা প্রচার করলেন সংবাদপত্রে। [ষাটের দশকের গণজাগরণ, পৃষ্ঠা ২৭৭]
আতাউর রহমান খান ঠিকই বলেছিলেন- লাহোরে ‘বোমা নিক্ষেপ’ করা হলো। আর এটা বঙ্গবন্ধু করেছিলেন শত্রুর দুর্গ, পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্র লাহোর নগরীতে। ২১ দফায় কিংবা পঞ্চাশের দশকে স্বায়ত্তশাসনের যে সব দাবি তোলা হয়েছে তাতে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও অর্থ কেন্দ্রের হাতে রাখার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু ৬-দফায় অর্থ প্রদেশের হাতে প্রদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তিন, চার ও পাঁচ নম্বর দফা অর্থ নিয়ে। তিন নম্বর দফায় বলা হয়েছে- পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করতে হবে। অর্থাৎ এক দেশে দুই মুদ্রা। অথবা সমগ্র পাকিস্তানের জন্য একই মুদ্রা ব্যবস্থা থাকবে, কিন্তু একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ও দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক রাখাতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে পারবে না।
চার নম্বর দফা- প্রদেশের হাতে সব রকম কর ও শুল্ক ধার্যের ক্ষমতা থাকবে। পাঁচ নম্বরে বলা হয়- দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব থাকবে এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা রাজ্যের হাতে থাকবে।
৬-দফা প্রদানের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট আইযুব খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদীরা ঠিকই বুঝতে পারেন- ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ বাঙালি নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করেন। তার ঠিক ২৬ বছর পর ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আরেক বাঙালি নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সেই লাহোর নগরীতেই ৬-দফা উত্থাপনের মাধ্যমে পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশের পথ উন্মুক্ত করেন। এ দাবি মানা হলে পাকিস্তান কেবল নামেই থাকবে, বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হবে বাংলাদেশ। ৬-দফা প্রদানের ৪০ দিন পর আইয়ুব খান রাজশাহীতে এক জনসভায় বলেন, ‘অখণ্ড বাংলাই শেখ মুজিবের লক্ষ্য। এই দাবি প্রতিরোধ করা আমাদের দায়িত্ব।’ [দৈনিক পাকিস্তান, ১৭ মার্চ ১৯৬৬]
কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো সেই ১৯৫২ সালের ১৪ জুনেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দিকে জানিয়ে রেখেছেন- ‘আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আমার জন্মই হয়েছে কষ্ট সহ্য করার জন্য- I have born to suffer. [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৩৯]
কী জন্য ত্যাগস্বীকার করবেন? বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য। ১৯৪৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের প্রাদেশিক সম্মেলনে তিনি বলেছিলে- ‘আমরা তিনটি বিষয় চাই- খাদ্য, শিক্ষা ও সামরিক প্রশিক্ষণ। প্রত্যেককে দেশ রক্ষার জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। পাঞ্জাবি সৈন্যরা পূর্ব বাংলার ভৌগলিক অবস্থা-পরিবেশে অভ্যস্ত নয়। এটা তাদের জন্য অচেনা পরিবেশ। আমাদেরকেই আমাদের ভূখণ্ড রক্ষা করতে হবে।’ [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৭০]
এর চার বছর পর ১২ জুলাই (১৯৫৬) করাচিতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘ক্ষমতাসনী চক্র পূর্ব পাকিস্তানকে প্রায় একটি কলোনীর মতো করিয়া রাখিয়াছে।’
পাকিস্তানের উপনিবেশিক ধরনের শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির জন্যই সংকল্পবদ্ধ ছিলেন তিনি। এটা যে অবাস্তব নয়, কল্পনা নয়ও সে বিশ্বাস তাঁর ছিল। স্বাধীনতা অর্জনের পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ত্রিশ লাখ নারী-পুরুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ সম্পর্কে চরম তাচ্ছিল্যপূর্র্ণ ও অপমানসূচক মন্তব্য করেন এভাবে- 'Bangladesh is an International Basket Case.'
জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের পর ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধু সাধারণ পরিষদে ভাষণ প্রদানের জন্য নিউইয়র্ক গিয়েছিলেন। বিশ্ব সভায় বাংলা ভাষায় বক্তব্য রাখেন তিনি। এর পর যান ওয়াশিংটন, সে সময়ের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে আলোচনার জন্য। কিসিঞ্জারের আগেও বিশ্বব্যাংকের দুই সিনিয়র অর্থনীতিবিদ একই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। তাদের বিবেচনায় ‘বাংলাদেশ যদি উন্নতি করতে পারে, তাহলে বিশ্বের যে কোনো দেশ উন্নতি করতে পারবে।’
বঙ্গবন্ধু হেনরি কিসিঞ্জার ও বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদদের বাংলাদেশ সম্পর্কে তাচ্ছিল্যপূর্ণ মন্তব্যের মোক্ষম জবাব প্রদানের জন্য ওয়াশিংটনকেই বেছে নেন। ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে লিখেছেন- ‘ওয়াশিংটনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, কেউ কেউ বাংলাদেশকে International Basket Case বলে উপহাস করেন। কিন্তু বাংলাদেশ Basket Case নয়। দুইশ’ বছর ধরে বাংলাদেশকে লুট করা হয়েছে। বাংলাদেশের সম্পদেই শ্রীবৃদ্ধি করা হয়েছে লন্ডন, ডান্ডি, ম্যাঞ্চেস্টার, করাচি, ইসলামাবাদের। আজো বাংলাদেশে অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে। একদিন আমরা দেখাবো বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে।’ [পৃষ্ঠা ১৯০]
বঙ্গবন্ধু কেবল নিজেকে নয়, পরিবারের সদস্যদেরও কষ্টসহিষ্ণু-ধৈর্য্যশীল হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে শেরে বাংলা নগরে নতুন গণভবন তৈরি হয়ে যায়। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ছোট বাড়ি ছেড়ে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গণভবনে উঠবেন, এটাই ধারণা করা হচ্ছিল। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মহিয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বলেন, সরকারি ভবনের আরাম-আয়েশে প্রতিপালিত হলে ছেলেমেয়েদের মন-মানসিকতা ও আচার-আচরণে অহমিকাবোধ ও উন্নাসিক ধ্যানধারণা সৃষ্টি হবে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। [বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া, পৃষ্ঠা ১৭৪]
এ কারণেই তো তিনি বঙ্গমাতা। দুঃসময়েও কখনও সাহস হারাননি, বিচলিত বোধ করেননি। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ- এটা ছিল তাঁর সহজাত গুণ। বঙ্গবন্ধু আদর্শভিত্তিক রাজনীতি করেছেন। ক্ষমতার জন্য এ-টু-জেড ঐক্যে তিনি বিশ্বাস করতেন না। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টে মুসলিম লীগবিরোধী সব দলকে গ্রহণ করার বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যাদের নীতি ও আদর্শ নাই তাদের সাথে ঐক্য করার অর্থ হল কতকগুলি করা লোককে বাঁচিয়ে তোলা। এরা অনেকেই দেশের ক্ষতি করেছে, রাজনীতি এরা ব্যক্তি স্বার্থের জন্য করে।’ [পৃষ্ঠা ২৪৮]
১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইয়ুব খানের বিরোধী দলগুলোর নেতারা কেবল পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চেয়েছেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সামনে আনেন ৬-দফা কর্মসূচি, যা জনগণ গ্রহণ করে নেয় মুক্তি সনদ হিসেবে। এ পথে চলতে গিয়ে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় পড়তে হয়। কিন্তু ছাত্র-জনতা তাকে আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্ত করে আনে, তিনি বরেণ্য হন বঙ্গবন্ধু হিসেবে।
জনগণের কথা বলা, দেশের স্বার্থকে সার ওপরে স্থান দেওয়া- এ কারণেই তিনি বঙ্গবন্ধু এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য আমরা আমলে নিতে পারি। ২০২১ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে বিএনপির শীর্ষ সারির কয়েকজন নেতা বলতে শুরু করেছেন- ‘শেখ হাসিনার সরকারকে ফেলে দিতে বাম-ডান সকল দলের ঐক্য চাই। আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে সরকার দমননীতি চালাচ্ছে। তাদেরও ঐক্যে আনতে হবে। যারাই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে, কারণ যাই হোক না কেন- তাদের পাশে থাকবে বিএনপি।’ [২৬-৩০ মে, ২০২১, বিভিন্ন সংবাদপত্র]
৩০ মে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীর কর্মসূচি কী হবে, এ নিয়ে ২৪ মে দলের স্থায়ী কমিটির সভায় এক নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ যদি তাদের নেতার জন্য ৩৬৫ দিনের কর্মসূচি নিতে পারে, তাহলে বিএনপি তার নেতা জিয়াউর রহমানের ৪০ তম মৃত্যুবার্ষিকীর জন্য ৪০ দিনের কর্মসূচি কেন নিতে পারবে না? [যুগান্তর, ২৫ মে, ২০২১]
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে পার্থক্য কতটা, সেটা বিএনপির নেতারাই স্পষ্ট করে দিয়েছেন। স্থায়ী কমিটির ওই সভায় কোনো কোনো নেতা জিয়াউর রহমানের শাহাদতবার্ষিকী না বলে কেন মৃত্যুবার্ষিকী বলেছেন, এটা নিয়ে বাকবিতণ্ডার খবর দিয়েছে কয়েকটি পত্রিকা।
বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসন-স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলনে উত্তরণ ঘটানোর জন্য দলকে প্রস্তুত করেছেন। ১৯৫৭ সালের মে মাসে তিনি মন্ত্রীপদ ছাড়েন দলকে আরও বেশি সময় প্রদানের জন্য। সে সময় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো জনপ্রিয় নেতা আওয়ামী লীগ ছেড়ে ন্যাপ গঠন করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে চলে যায় বিপুল সংখ্যক বামপন্থি নেতা-কর্মী। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগকে মানুষের কাছে নিয়ে যান। পঞ্চাশের দশকে বিভিন্ন জেলা ও মহকুমায় যে তরুণ নেতাদের সাধারণ সম্পাদক ও সংগঠনিক সম্পাদকের মতো পদে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তারাই ষাটের দশকে এমনকি আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের জেল-জুলুম উপেক্ষ করে আরও বড় দায়িত্বের জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠেন। ছাত্রদের প্রতিও তিনি নজর দেন। ছাত্রলীগ ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে স্লোগান দেয়- জয় বাংলা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা তোমার আমার ঠিকানা। পিন্ডি না ঢাকা ঢাকা ঢাকা। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ এই ছাত্রলীগ এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত ডাকসু স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ পতাকা তোলা যে প্রতীকী নয়, সেটা আমরা বুঝতে পারি এ স্লোগানে- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। বাস্তবেই ছাত্রলীগ অস্ত্র ধরেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করার জন্য। ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে সর্বস্তরের জনগণও অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। কৃষক-ক্ষেতমজুর-শ্রমিক-ছাত্র, সবাই অস্ত্র হাতে নেয়। আমি নিজে ত্রিপুরার পালাটোনায় প্রথম ব্যাচে সামরিক ট্রেনিং নিয়েছিলাম। এদের মধ্যে মাত্র ২০ জন ছিল ছাত্র, বাকি সবাই শ্রমজীবী। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ও মুক্তির ডাক তাদের কাছে পৌঁছেছিল তাঁর দলের মাধ্যমে, ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে।
লাহোরে শত্রুর ডেরা বা দুর্গে বসে কেবল মহত্তম কর্মসূচি দিয়েই বঙ্গবন্ধু দায়িত্ব শেষ করেননি, লক্ষ্য অর্জনে উপযুক্ত সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। এ সব কারণেই বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা প্রদানের প্রেক্ষাপট এবং তা আদায়ে পদক্ষেপ প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি, হারাবেও না। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এটাও কল্পনা ছিল না। ১৯৭৪ সালে প্রলয়ঙ্করী বন্যা-দুর্ভিক্ষের কঠিন সময় মোকাবিলায় করার সময়েই তিনি বলেছিলেন, ‘দুইশ’ বছর ধরে বাংলাদেশকে লুট করা হয়েছে। বাংলাদেশের সম্পদেই শ্রীবৃদ্ধি করা হয়েছে লন্ডন, ডান্ডি, ম্যাঞ্চেস্টার, করাচি, ইসলামাবাদের।.... আজো বাংলাদেশে অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে। একদিন আমরা দেখাবো বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেখিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। উন্নত বিশ্বের সারিতে বসার পথে চলতে পারে। এই যে নিজের পায়ে দাঁড়ানো, তাঁর পথনির্দেশনা এসেছিল ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঐতিহাসিক ৬-দফা কর্মসূচির মাধ্যমে। ওই সময়ের ঘটনাবলী স্মরণ, পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন সঙ্গতকারণেই প্রাসঙ্গিক।
লেখকঃ একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক