তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উদীয়মান নক্ষত্র বাংলাদেশ

1885

Published on জুন 5, 2021
  • Details Image

রূপা সুব্রামণ্য:

২৫ মে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট দেশ বাংলাদেশের জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। এদিন দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিবেশী দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকার জন্য ২০ কোটি ডলারের মুদ্রা বিনিময় চুক্তি অনুমোদন দেয়।

গত মাসে শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ৪.৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে যায়। ঋণদাতাদের দেনা পরিশোধ করে এবং করোনাভাইরাসের অভিঘাতে তীব্র অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে দেশটির অর্থনীতি এখন ক্ষতির মুখে। তবে বিপরীতে বাংলাদেশ এই করোনা মহামারির সময় বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এই করোনা মহামারির সময়ও ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, একটি তলাবিহীন ঝুড়ি।

২০২০-২১ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে জায়ান্ট প্রতিবেশী ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। সেই ভারত যার হস্তক্ষেপ ছাড়া বাংলাদেশের জন্মলাভ কঠিন হয়ে যেত, তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ এত দ্রুত আয়ের ব্যবধান কমিয়ে এনেছে, যা এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক দক্ষতার এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনকে উপস্থাপন করছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্থানে তৈরি পোশাক শিল্পের বড় অবদান রয়েছে। ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোং-এর গত মার্চ পর্যন্ত হিসেবে অনুযায়ী তৈরি পোশাক শিল্প দেশটির ৮৪ ভাগ রফতানি পণ্য জোগান দেয়।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধির সূচনা মূলত ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে হয়েছিল। ২০১২-১৩ সালে বেশ কয়েকটি কারখানার দুর্ঘটনায় প্রায় হাজারের বেশি শ্রমিকের মৃত্যু হয়। সে সময় গুরুত্বপূর্ণ কিছু গ্রাহক হারানো ও যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক সুবিধা হ্রাসের ঝুঁকিতে পড়ে এ শিল্প। সে সময় গার্মেন্টস শিল্পটিকে পুনর্গঠনে বাধ্য হয় বাংলাদেশ। নতুন এই ভিত্তির উপরই এগিয়ে যেতে থাকে শিল্প এবং মজবুত থেকে মজবুতর হয়।

গার্মেন্টসের শিল্পের পর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স হলো বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস। জুনে শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ২০ বিলিয়নের বেশি রেমিট্যান্স অর্জন করেছে বাংলাদেশ, যা একটি নতুন রেকর্ড। বাংলাদেশের বিশাল বৈদেশিক মুদ্রার উৎস এগুলোই। এসবের বদৌলতে দেশটি শ্রীলংকার প্রতি উদার হতে পেরেছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বিশাল রেমিট্যান্সের আরেকটি কারণ হলো দেশটি গত কয়েকবছর অবৈধ হুন্ডি ব্যবসা বন্ধ অভিযান চালায়। রেমিট্যান্সের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াতে এটিও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সাফল্য যে অনেক আগে থেকেই কোনো নির্ধারিত কারণে ঘটেছে হয়েছে তা নয়। দেশটি ঘন ঘন বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার শিকার হয় এবং দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে অস্থিতিশীলতার কারণে যুদ্ধ পরিস্থিতিও তৈরি হয়ে থাকে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ইসলামিক মৌলবাদ ও সন্ত্রাসের উত্থান হয়। এবং রাজনীতিও কর্তৃত্ববাদীতার দিকে মোড় নেয়।

যদিও ভৌগলিক অবস্থান ও রাজনীতি দেশটির উত্থানকে ব্যাখ্যা করতে পারে না, তবে দেশটির অগ্রগতির মূল চাবিকাঠি শক্তিশালী সামাজিক ও মানবসম্পদ উন্নয়নের মধ্যে নিহিত রয়েছে। এর মধ্যে নারীদের উত্থানও একটি বড় কারণ। দেশটিতে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২৬, যা ভারতের চেয়ে কম। ভারতে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২৮। বাংলাদেশে নারীশিক্ষার হার ৭২ শতাংশ, যা ভারতে ৬৬ শতাংশ। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, এই সূচকগুলোতে দিন দিন ভারতের অবনতি হচ্ছে, বিপরীতে বাংলাদেশের উন্নতি অব্যাহত রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন মানব উন্নয়নের সূচকে বাংলাদেশের বিকাশধারা ভারতের উপরে অবস্থান করছে।

বাংলাদেশ ও বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের মধ্যে যে কোনো তুলনা আসলে জটিল। যেখানে ভারত চীনকে টেক্কা দিয়ে বিশ্বে বৃহৎ শক্তিরূপে আবির্ভূত হতে চায়, সেখানে তার ক্ষুদ্র আয়তনের প্রতিবেশী বাংলাদেশ রাডারের আওতার নিচেই নীরবে উড়ে তার নিজস্ব উপায়ে শ্রম-নিবিড় পণ্যের ম্যানুফেকচারিং পাওয়ারহাউজ হওয়ার পথে।

গত বছর ভারতের জন্য লোকানোর মতো একটি বছর ছিল। সম্প্রতি প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশটির অর্থনীতি এর আগের বছরের তুলনায় ৭.৩ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। গত কয়েক দশকে এটি ভারতের সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্স। পক্ষান্তরে একই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৫.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। করোনা মহামারিতে ভারতের যেখানে বৃহৎ অর্থনীতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্স, সেখানে বাংলাদেশ সবচেয়ে ভালো পারফরম্যান্সের দেশগুলোর একটি।

যখন ভারত করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত, তখন গত ১৮ মে বাংলাদেশ দিল্লিতে হাজার বক্স জরুরি ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী ত্রাণ হিসেবে পাঠিয়েছে। এর কয়েক সপ্তাহে আগে, ভারতে ১০ হাজার রেমডেসিভির ভায়াল ত্রাণ হিসেব পাঠিয়েছিল ঢাকা।

ভারতে ২০১৯ সালে সাধারণ নির্বাচনের আগে তৎকালীন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের ‘উইপোকা’ হিসেবে উল্লেখ করে তাদের বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলার কথা বলেছিলেন।

এখন বাংলাদেশ থেকে ত্রাণ সহায়তা গ্রহণ করার মাধ্যমে ভারত সরকার নিশ্চিতভাবেই তাদের ভুল বুঝতে পারবে। যদি বাংলাদেশের বর্তমান গতিপথ অব্যাহত থাকে, তবে ভারত ও বাকি বিশ্ব তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উদীয়মান নক্ষত্র হিসেবে রূপান্তরিত বাংলাদেশের গল্প লিখে রাখবে।

মূল লেখাঃ নিক্কেই এশিয়ান রিভিউ

ভাষান্তরঃ সারাবাংলা ডট নেট

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত