2348
Published on জুন 3, 2021অধ্যাপক ড.মুনাজ আহমেদ নূর:
১৯৪৭ সালে বিশ্বাসের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান দুই ভাগে ভাগ হয়। প্রতিষ্ঠা লাভ করে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি দেশ। কিন্তু ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র ভাবনায় ছিলো না।বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় ছিল ভারত পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাইরে তৃতীয় স্বাধীন অখণ্ড বাঙালি রাষ্ট্র। মূলত ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান বাঙালি রাজনৈতিকদের মধ্যে প্রগতিশীল অংশের অনেকের রাষ্ট্র ভাবনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। তাঁদের রাষ্ট্র ভাবনার মূলে ছিল ১৯৪০ এর লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই ধারণার অনুসারী। বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করতে পেরেছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্রে এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন হবে না।তবে বঙ্গবন্ধুর ভাবনার সেই স্বাধীন অখণ্ড বাঙালি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন সম্ভব হবে। সেই ভাবনা থেকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন অখণ্ড বাঙালি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ হিসেবে পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন।
বঙ্গবন্ধু যে ধারণা পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে পোষণ করেছিলেন বস্তুত তাই হল। অর্থনীতি, রাজনীতি,বাংলাভাষা,সংস্কৃতি,সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া,নানা কালাকানুনের মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষের উপর শোষণ, জুলুম,নির্যাতন আর নিপীড়ন চালাতে থাকলো পশ্চিম পাকিস্তান সরকার। বাঙালি সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানিরা কখনোই উচ্চ ধারণা পোষণ করতে পারেনি,তারা বাঙালির শ্রেষ্ঠত্বকে বুঝতেই পারেনি। এমন একটি পরিস্থিতিতে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই অঞ্চলের মানুষকে শোষণ, জুলুম,নির্যাতন আর নিপীড়ন থেকে মুক্ত করতে নতুন কর্মপন্থা ঠিক করেন। বাঙালি জাতির পিতা বাঙালি জাতির শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে গেছেন।বঙ্গবন্ধু সবসময় ছিলেন শান্তি ও শোষিতের পক্ষে।তিনি কখনোই সহিংস আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন না।
পশ্চিম পাকিস্তান প্রথমে আঘাত হানে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির উপর। বঙ্গবন্ধু শান্তিপূর্ণভাবে এর প্রথম প্রতিবাদ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ, জুলুম,নির্যাতন আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের লক্ষ্যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরের বছরই বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের অ্যাসেম্বলি হলে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা করেন।পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ন-সম্পাদক।প্রতিষ্ঠাকালে দলটির নামের সাথে ‘মুসলিম’ শব্দটি যুক্ত থাকলেও চেতনা ও বিশ্বাসে প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ ছিল অসাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের অনুসারী।পরবর্তীতে সঠিক সময়ে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয় যা ছিলো বঙ্গবন্ধুর আরেকটি রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।পাকিস্তান আন্দোলন বা পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা যে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র ভাবনায় ছিল না তা স্পষ্ট হয় বাংলাভাষা আন্দোলনের সময়। বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র ভাবনায় যদি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা থাকতো তাহলে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরপরই ভাষা আন্দোলন হতো না। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ভাষা-অন্দোলনের প্রথম কারাবন্দী (১১ মার্চ ১৯৪৮)।মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে বাঙালির আন্দোলন এবং ছাত্র সমাজের চরম আত্মত্যাগের ফলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের রোডম্যাপ মুলত রচিত হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা থেকেই। এটি ছিল রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। যেটাকে বাঙালির মুক্তির সনদ বা ম্যাগনাকার্টা বলে অবহিত করা হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানের ইতিহাসে ৬-দফার ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
আইয়ুব খানের শাসনামলে (১৯৫৮-৭১)বাংলাভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি,এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক,সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াসহ সকল ক্ষেত্রে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তান বাঙালির দীর্ঘ জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষা পূরণ না করে তাদেরকে নতুন করে এক ধরনের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে। প্রয়োজন হয়ে পড়ে শৃঙ্খলমুক্তির।পাকিস্তানি ২৪ বছরের রাষ্ট্রীয় শাসন আমলে বাঙালির শৃঙ্খলমুক্তির বা জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনই হয়ে দাঁড়ায় বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল লক্ষ্য বা কেন্দ্রবিন্দু। এ লক্ষ্য অর্জনে তাঁকে ‘স্টেপ বাই স্টেপ’ অগ্রসর হতে হয়েছে।
৫২-র ভাষা আন্দোলন,৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন,৬২র শিক্ষা কমিশন আন্দোলন,৬৬-র ঐতিহাসিক ছয় দফা উপস্থাপন, ৬৮-র আগরতলা মামলা প্রতিহত করণ,৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এ সবই ছিল বঙ্গবন্ধুর শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। সেই ধারাবাহিকতায় এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু এক ঐতিহাসিক,অবিস্মরণীয় ভাষণ প্রদান করেন।ইউনেস্কো এই ভাষণকে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’এর অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।জাতির পিতা ৭ মার্চের ভাষণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘাতের ডাক দিতে পারতেন,কিন্তু তিনি তা না করে সেই ভাষণে শান্তির ডাক দিয়েছেন যার মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ সংগ্রামের শুরু হয়।যা বিশ্বের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।এখানে অর্থনৈতিক মুক্তি হচ্ছে দরিদ্রতা দূরীকরণ এবং স্বাধীনতার ডাক হচ্ছে একটি জাতি রাষ্ট্রের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।
১৯৬৫ সালের ১৭ দিনের ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধে পূর্ব বাংলা সম্পূর্ণ অরক্ষিত হয়ে পড়ে। তাই যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর পক্ষে নতুন রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে দেশবাসীর সামনে হাজির হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়। এদিকে ৫–৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ লাহোরে পাকিস্তানের সব বিরোধী দলের কনভেনশন আহ্বান করা হয়। নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলের ওই কনভেনশনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি উত্থাপনের চেষ্টা করেন,কিন্তু ওই কনভেনশনে আলোচনার জন্য সাবজেক্ট কমিটিতে তা গৃহীত হয়নি। তাই ১১ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু আগারগাঁও [তেজগাঁও] পুরাতন বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে প্রথম তাঁর ছয় দফা কর্মসূচি প্রকাশ করেন। আওয়ামী লীগের এ কর্মসূচি মুখ্যত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে শঙ্কিত করে তোলে। বঙ্গবন্ধু ছয় দফা কর্মসূচিকে ‘আমাদের (বাঙালির) বাঁচার দাবী’হিসেবে আখ্যায়িত করে তা নিয়ে পূর্ব বাংলার জনগণের দরবারে হাজির হন। এরই মধ্যে মতিঝিলের ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল (১৮–২০ মার্চ ১৯৬৬) ডেকে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা কর্মসূচি অনুমোদন করিয়ে নেন। সেদিন ৬-দফা কর্মসূচি অনুমোদনের সময় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল দলের সিনিয়র সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ পরিবেশন করা হয়। তারমানে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত তখনি জাতির পিতার চিন্তায় ছিল।কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু দলের সভাপতি নির্বাচিত হন।
বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন,৬-দফা বাস্তবায়ন ছাড়া বাঙালির জাতীয় মুক্তি সম্ভব নয়।তাই বাঙালি জাতির পিতা ৬-দফা প্রসঙ্গে দ্বিধাহীন চিত্তে বলেছিলেন, ‘সরাসরি রাজপথে যদি আমাকে একা চলতে হয় চলব, কেননা ইতিহাস প্রমাণ করবে বাঙালির মুক্তির জন্য এটাই সঠিক পথ’।
তৎকালীন সামগ্রিক রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক ধাঁচের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভেঙে বাঙালির জাতীয় মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যেই ৬-দফা প্রণয়ন করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।অন্য কথায়, ছয় দফা কর্মসূচির লক্ষ্য–উদ্দেশ্য ছিল ধর্ম–বর্ণ–শ্রেণি নির্বিশেষে বাঙালি জনগণকে জাতীয় মুক্তির চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষায়:
‘৬-দফা দফা বাংলার শ্রমিক–কৃষক, মজুর–মধ্যবিত্ত তথা আপামর মানুষের মুক্তির সনদ, ৬-দফা শোষকের হাত থেকে শোষিতের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ছিনিয়ে আনার হাতিয়ার,৬-দফা মুসলিম–হিন্দু–খ্রিষ্টান–বৌদ্ধদের নিয়ে গঠিত বাঙালি জাতির স্বকীয় মহিমায় আত্মপ্রকাশ আর আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের চাবিকাঠি... ছয় দফার সংগ্রাম আমাদের জীবন–মরণের সংগ্রাম’।
শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু ৬-দফা কর্মসূচির প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন। তাঁর কাছে এটি ছিল এক দফার রাজনীতি,আর সেই এক দফা হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধুর নিকট ৬-দফা নিছক ম্যানিফেস্টো বা ভোট লাভের কৌশল ছিল না। ৬-দফা প্রচারকালে বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত বিভিন্ন ভাষণ থেকেই তা সুস্পষ্ট। যেমন তিনি বলেছিলেন ‘এ দাবি সস্তা রাজনৈতিক স্লোগান নয়’ ‘ইহা দলের প্রয়োজনে প্রণীত রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়’ ছয় দফা কোন দল বিশেষের কর্মসূচি কিংবা ভোট লাভের কৌশল নয়। ইহা রূঢ় বাস্তবায়ন প্রতিধ্বনি এবং আমাদের জীবন-মরণ প্রশ্ন’ ‘ছয় দফা বিনিময়যোগ্য ব্যাপার বস্তু নয়’ ‘৬-দফা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন’ ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধুর এসব বক্তব্য বা উক্তি দ্বারা বুঝা যায়, ৬-দফার প্রশ্নে তিনি কতটা অনড় বা আপসহীন ছিলেন। পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে ৬-দফার ভিত্তিতে বাঙালিদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া কিছুতেই তাঁর লক্ষ্য ছিল না। তাঁর লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক কাঠামো ভেঙ্গে বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জন।
৬-দফাকে অনেকে স্বাধীকারের আন্দোলন বলে থাকে।কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে থেকে ৬-দফা বাস্তবায়ন মানেই একটি দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়া। ৬-দফার মর্মকথাও ছিল তাই, যদিও একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অভ্যন্তরে থেকে সরাসরিভাবে তা তেমনটি করে বলা রাজনীতি বিজ্ঞানসম্মত ছিল না। রাজনীতি বিজ্ঞানের এই পাঠ বঙ্গবন্ধুর ভাল করেই রপ্ত ছিল। তাই একজন নিপুণ কৌশলীর মত তিনি উপযুক্ত সময়টির জন্য অপেক্ষা করেছেন। এর মধ্যে নানাভাবে ও ভাষায় তিনি ৬-দফার পেছনে তাঁর মূল রাজনৈতিক লক্ষ্য বাঙালির নিকট তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।
৬-দফা বাস্তবায়নের ফলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে এই কারণে যে,সার্বভৌম আইন পরিষদ তৈরি হবে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের সরাসরি ভোটে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করতে হবে,দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব থাকবে এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা রাজ্যের হাতে থাকবে, দুই অংশের মধ্যে দেশীয় পণ্য বিনিময়ে কোন শুল্ক ধার্য করা হবে না এবং রাজ্যগুলো যাতে যে কোন বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে সংবিধানে তার বিধান রাখতে হবে, প্রতিরক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে আধা-সামরিক রক্ষীবাহিনী গঠন,পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় নৌবাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করতে হবে, প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক এবং অপর সব বিষয় ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত রাজ্যসমূহের হাতে ন্যস্ত থাকবে।এগুলো একমাত্র একটি স্বাধীন দেশেই সম্ভব।ফলে ৬-দফা বাস্তবায়িত হলে যেকোনো রাষ্ট্রই একটি স্বাধীন দেশে পরিণত হবে।তারমানে সামরিক,অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক স্বাধীনতাটাই ছিলো ৬-দফা এবং এটি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কাঠামো ছাড়া কখনোই সম্ভব না। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত ৬-দফা কর্মসূচির আসল উদ্দেশ্য শুরু থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিকট দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায়। ফলে এই কর্মসূচি তাদরে মারাত্মকভাবে শঙ্কিত করে তোলে।৬-দফার বিষয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া ছিলো অত্যন্ত কঠোর।তারা ৬-দফাকে ‘বিচ্ছিনতাবাদী’ ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী’ ‘ধ্বংসাত্মক’ ‘বিদেশী মদদপুষ্ট’ ‘বৃহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ‘এক নম্বর দুশমন’ হিসেবে চিহ্নিত করে ‘অস্ত্রের ভাষা’ প্রয়োগের হুমকি দেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শুধু হুমকি দিয়ে থেমে থাকেনি তার অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগও করেছে। মূলত ৬-দফা কর্মসূচিকে নস্যাৎ করে দিতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে বন্ধী থাকা অবস্থায় এক নম্বর আসামী করে একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করে যা সাধারণ মানুষের কাছে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ‘নামে পরিচিত।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬-দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণআন্দোলনের সূচনা হয়।১৯৬৬ সালের ০৭ জুন ৬-দফার বাস্তবায়নের দাবীতে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া,শফিক,শামসুল হকসহ ১১ জন বাঙালি শহীদ হন।সেই থেকে প্রতি বছরের ০৭ জুন ৬-দফা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এসব কারণেই ৬-দফা হচ্ছে বাঙালির বাঁচার দাবি।
লেখক, উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি,বাংলাদেশ