8518
Published on জুন 1, 2021মোহাম্মদ শাহজাহানঃ
৩০ মে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোর রাতে একদল বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তার হাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে জিয়া নিহত হন। গত চার দশকে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান হত্যার কোনো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত বা বিচার হয়নি। জিয়া হত্যার তিন মাসের মধ্যে সামরিক আদালতে তড়িঘড়ি করে গোপন বিচারের মাধ্যমে ১৩ সামরিক কর্মকর্তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। ফাঁসিতে মৃত ১৩ জনের ১২ জনই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।
তাড়াহুড়া করা তদন্তে ৩৩ অফিসার ও ২ জন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারকে কোর্ট মার্শাল করার সুপারিশ করা হয়। সব আইনকানুন ও নিয়মনীতি ভঙ্গ করে চট্টগ্রামের বেসামরিক জেলখানায় ওই বিচারকাজ চলে। অভিযুক্তদের কঠিন ও ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়। তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগই দেয়া হয়নি। ওই বিচার ছিল সম্পূর্ণ সাজানো ও উদ্দেশ্যমূলক।
প্রহসনের ওই কোর্ট মার্শালে ১৩ অফিসারের ফাঁসি এবং ১৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। দুজন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারকে ইচ্ছাকৃতভাবে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। যাতে করে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক, এনসিও ও জেসিওদের মধ্যে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না হয়। উল্লেখ্য, জুনিয়র কমিশন্ড অফিসাররা সৈনিক থেকে পদোন্নতি পেয়ে থাকেন।
জিয়াকে যখন হত্যা করা হয় তখন চট্টগ্রাম সেনানিবাসের জিওসি ছিলেন জেনারেল আবুল মন্জুর। এই নিবন্ধ লেখার ব্যাপারে মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রমের ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য- ‘স্বাধীনতার প্রথম দশক’, কর্নেল এম এ হামিদের ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’, মুনতাসীর মামুনের ‘ষড়যন্ত্রের রাজনীতি- দুই রাষ্ট্রপতি হত্যা’, জিয়া হত্যার সময় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দিনের ইংরেজি ভাষায় লেখা ‘অ্যাসাসিনেশন অব জিয়াউর রহমান অ্যান্ড আফটারমাথ’ (জিয়াউর রহমান হত্যা ও তারপর), পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ‘বাংলাদেশ : এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ (বাংলাদেশ : একটি রক্তাক্ত অধ্যায়), গবেষক ও লেখক এএসএম সামছুল আরেফিনের ‘জিয়া-মনজুর হত্যাকাণ্ড ও তারপর’সহ আরও কিছু গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার সহযোগিতা নেয়া হয়েছে।
গত চার দশকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে, রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যা কোনো পরিকল্পিত সামরিক অভ্যুত্থান বা বিদ্রোহ ছিল না। এটা ছিল কিছু তরুণ সেনা অফিসারের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এবং তা ক্ষমতা দখলের জন্য ছিল না। জিয়া হত্যার সময় মইনুল হোসেন ছিলেন অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল।
জেনারেল মইনুল ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। জিয়া হত্যায় অভিযুক্ত অন্যতম পলাতক আসামি মেজর খালেদ ও মেজর মোজাফফর ওই সময় থাইল্যান্ডে মইনুল হোসেনের সঙ্গে দেখা করেন। জিয়া হত্যা নিয়ে তাদের সঙ্গে রাষ্ট্রদূতের দীর্ঘ আলোচনা হয়। আলোচনার সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে : ‘লে. কর্নেল মতিউর রহমান (মতি), লে. কর্নেল মাহবুব ও মেজর খালেদের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম ২৪ ডিভিশনের জুনিয়র অফিসাররা জিওসি জেনারেল মনজুরের অজান্তে রাষ্ট্রপতি জিয়াকে সার্কিট হাউস থেকে অপহরণ করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল জিয়াকে চাপ দিয়ে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়, বিশেষ করে সেনাপ্রধান এরশাদসহ অন্যান্য দুর্নীতিপরায়ণ সামরিক অফিসার এবং পাকিস্তানপন্থি প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজ ও অন্য দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীদের মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ করানো।
‘এরশাদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হয়রানি- বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ঢালাওভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলিসহ সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের ব্যাপক দুর্নীতি নিয়ে জুনিয়র অফিসারদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভ ছিল। ওই উচ্ছৃঙ্খল বিদ্রোহের মাধ্যমে জুনিয়র অফিসারদের ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।’
জিয়া হত্যার বিষয়টি যে লে. কর্নেল মতি ও তার মদতদাতা তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ ভালোভাবেই জানতেন, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। এটা শতভাগ নিশ্চিত যে, জিয়া হত্যার বিষয়টি জেনারেল মনজুর কোনোভাবেই জানতেন না। সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে, ঘুম থেকে উঠিয়ে জেনারেল মনজুরকে জিয়া হত্যার খবর জানানো হয়। ভোরে মনজুর ও তার স্ত্রী যখন শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন তখন তারা স্লিপিং ড্রেস পরা ছিলেন। মনজুর যে জিয়া হত্যার ষড়যন্ত্রের বিষয়টি জানতেন না, এর হাজারটা প্রমাণ দেয়া যাবে। কিন্তু হত্যার সঙ্গে জড়িত না থাকা সত্ত্বেও তার অধীন অফিসাররা যেহেতু ঘটনাটি ঘটিয়ে ফেলেছে, জিওসি হিসেবে জেনারেল মনজুর নিজেই এর দায়ভার গ্রহণ করেন।
দলের দুই উপদলের কোন্দল মেটাতে জিয়া ২৯ মে ১৯৮১ চট্টগ্রাম গিয়ে সার্কিট হাউসে ওঠেন। সঙ্গে ছিলেন দলের মহাসচিব বদরুদ্দোজা চৌধুরী, উপপ্রধানমন্ত্রী জামালউদ্দিন আহমদ, মন্ত্রী আমেনা বেগমসহ দলের আরও কয়েকজন। সার্কিট হাউসে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সভা হবে। জিয়া রাতটা চট্টগ্রামে কাটিয়ে পরদিন সকালে ঢাকা চলে যাবেন। দুপুরে খাবারের পর দলের মিটিং শুরু হয়। ৮টায় রাতের খাবার খেয়ে আবার মিটিং শুরু করেন। বিদ্রোহের সেই রাতে বেশ ঝড় হচ্ছিল। জিয়া সার্কিট হাউসের দোতলায় ঘুমিয়ে ছিলেন। ভোর ৪টার দিকে অফিসাররা অতর্কিতে সার্কিট হাউস আক্রমণ করে।
ওই আক্রমণের উল্লেখ্য বিষয় হলো, এতে কোনো সৈনিক, জেসিও বা এনসিওকে সরাসরি জড়ানো হয়নি। জুনিয়র অফিসাররা সরাসরি নিজেরা দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে প্রথমে সার্কিট হাউসে রকেট লান্সার নিক্ষেপ করে। গুলির শব্দ শুনে জিয়া রুম থেকে বের হয়ে এলে কয়েকজন অফিসার তাকে ঘিরে দাঁড়ায়। হঠাৎ করেই ওই সময় লে. কর্নেল মতিউর রহমান মাতাল অবস্থায় টলতে টলতে ‘জিয়া কোথায়, জিয়া কোথায়’ বলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে আসে এবং পলকেই গজখানেক সামনে থেকে তার চায়নিজ স্টেনগানের এক ম্যাগাজিন (২৮টি) গুলি জিয়ার ওপর চালিয়ে দেয়। জিয়ার পুরো শরীর ঝাঁজরা হয়ে যায়। উপস্থিত অন্য অফিসাররা ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে যান। তারা কেউ কোনো গুলি ছোড়েননি। দু-একজন অফিসার ‘কী করছেন, কী করছেন’ বলে চিৎকার করে ওঠেন। প্রত্যক্ষদর্শী মেজর খালেদ ও মেজর মোজাফফর এভাবেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীকে অবহিত করেন।
জিয়াকে হত্যার পেছনে লে. কর্নেল মতির ক্রোধ ও আক্রোশের কারণ ছিল। ১৯৮১ সালের মে মাসের প্রথম দিকে, অর্থাৎ হত্যাকাণ্ডের কদিন আগে আমেরিকায় সামরিক প্রশিক্ষণে মনোনয়নের জন্য তৎকালীন লে. কর্নেল মতিউর রহমান, লে. কর্নেল ইমামুজ্জামান (পরে মেজর জেনারেল) ও পাকিস্তান প্রত্যাগত লে. কর্নেল (পরে ব্রিগেডিয়ার) সাখাওয়াত হোসেনসহ ৫ জনকে একত্রে সেনাসদরে বাছাইয়ের জন্য ডাকা হয়।
ইমামুজ্জামান ও মতিকে বাদ দিয়ে সেনাপ্রধান এরশাদ আমেরিকায় প্রশিক্ষণের জন্য সাখাওয়াতকে মনোনীত করেন। সাখাওয়াতের চেয়ে মতি ও ইমামুজ্জামান অধিকতর যোগ্য ছিল বলে অনেকের ধারণা। মনোনয়ন-বঞ্চিত মতিউর রহমান এতে ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হন এবং ওই দিনই বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি জিয়ার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল সাদেকের সঙ্গে দেখা করে ক্ষোভের কথা জানান।
মতি আরও অভিযোগ করেন, মুক্তিযোদ্ধা অফিসারগণ আর্মিতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন এবং এই বিষয়টি রাষ্ট্রপতিকে জানানোর জন্য জেনারেল সাদেককে অনুরোধ করেন। বিদ্রোহী অফিসারদের পরিকল্পনা ছিল জিয়াকে সেনানিবাসে নিয়ে চাপের মুখে দুর্নীতিবাজ এরশাদকে বরখাস্তসহ মুক্তিযোদ্ধাদের দাবিদাওয়া আদায় করা। হঠাৎ করেই কার প্ররোচণায় মতি হত্যা করল জিয়াকে? পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে জিয়া হত্যায় মতির মূল ইন্ধনদাতা ও মদতদাতা সেনাপ্রধান এরশাদ।
বঙ্গবন্ধু হত্যায় সবচেয়ে লাভবান ব্যক্তি জিয়াউর রহমান। আর জিয়া ছিলেন জাতির পিতা হত্যা ষড়যন্ত্রে খুনিদের মদতদাতা, আশ্রয়দাতা ও ইন্ধনদাতা। জিয়া-মনজুর হত্যায় সবচেয়ে লাভবান ব্যক্তি হচ্ছেন এরশাদ। আর এরশাদই যে পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছেন, এর অসংখ্য দালিলিক প্রমাণ রয়েছে। কর্নেল হামিদ তার গ্রন্থে ১৫১ পৃষ্ঠায় একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। হামিদ লিখেছেন- ঘটনাপ্রবাহ থেকে জানা যায়, জিয়া হত্যার চার দিন আগে চট্টগ্রামে হিলটপ মেসে সেনাপ্রধান এরশাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিবেশে প্রায় দুই ঘণ্টা কোনো বিষয়ে আলোচনা করেন মতিউর রহমান। সব প্রটোকলের বাইরে এমন সন্ধিক্ষণে সেনাপ্রধান লে. জেনারেল এরশাদের সঙ্গে লে. কর্নেল মতিউর রহমানের এমন কী ব্যক্তিগত গোপন আলাপ থাকতে পারে? এর কয়েক দিন আগে ঢাকায় গিয়েও মতি এরশাদের সঙ্গে দেখা করেন। জিয়া হত্যার কয়েক দিন আগে এরশাদের সঙ্গে মতির দুই দফা আলাপ-আলোচনার বিষয়টি অন্যত্রও উল্লেখ রয়েছে।
জেনারেল মইনুল হোসেনকে ৩০ মে ভোরেই ফোন করে তার সহকর্মী আর্মি হেড কোয়ার্টারের পিএসও জেনারেল নূরউদ্দিন ফোন করে সত্বর সেনাসদরে যেতে বলেন। মইনুল সেনাসদরে গিয়ে দেখেন সেনাপ্রধান আগে থেকেই উপস্থিত রয়েছেন। সামরিক পোশাক পরিহিত এরশাদ ছিলেন ধীরস্থির ও শান্ত। আরেক পিএসও জেনারেল মান্নান সিদ্দিকীসহ (পরে এরশাদের মন্ত্রী) পদস্থ সেনা কর্মকর্তারা উপস্থিত হন সেনাসদরে। সবাই এরশাদের কাছে জানতে চান, এখন কী হবে? সরাসরি উত্তর না দিয়ে এরশাদ সামরিক আইন জারির ইঙ্গিত দেন।
উপস্থিত অফিসাররা জানান, এ সময় সামরিক আইন জারির কোনো যুক্তি বা পরিস্থিতি বিরাজমান নেই। উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ছিলেন ওই সময়। আশ্চর্য হলেও সত্য, ক্ষমতা দখলের উন্মাদনায় ব্যস্ত এরশাদ জিয়া হত্যার বিষয়টি উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে অবহিত করেননি। উপস্থিত অফিসাররা বলার পরই এরশাদ হাসপাতালে গিয়ে বিচারপতি সাত্তারকে জিয়া হত্যার কথা জানান। দুদিনের মধ্যে চট্টগ্রামে বিদ্রোহীরা পিছু হটে।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার একজন সৎ, মেধাবী, চরিত্রবান ও চৌকস সেনা কর্মকর্তা নিরপরাধ জেনারেল মনজুরকে ঠান্ডা মাথায় এরশাদের নির্দেশে একটিমাত্র বুলেটে হত্যা করা হয়। জিয়া হত্যার সঙ্গে মনজুরের সামান্যতম সংশ্লিষ্টতা ছিল না। জেনারেল এরশাদকে তার নষ্টচরিত্রের জন্য প্রকাশ্যে ঘৃণা করতেন মনজুর। এরশাদের নামটিও ঘৃণায় উচ্চারণ করতেন না। এরশাদকে বলতেন ‘থিফ’। জিয়া হত্যার পর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলেও মনজুরের উপস্থিতিতে এরশাদ নিশ্চিন্ত মনে দেশ শাসন করতে পারত না। আর এ জন্যই মনজুরকে হত্যা করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যার বিষয়টি বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে সম্ভবত শুধু কর্নেল মতিই জানতেন। কোনো দিন সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্ত হলে হয়তো জানা যাবে চট্টগ্রাম বিদ্রোহ ছিল এরশাদের সাজানো ও পরিকল্পিত একটি বিদ্রোহ। আর্মির মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হত্যা, অপসারণ ও বিভিন্নভাবে কোণঠাসা করে সর্বস্তরে অমুক্তিযোদ্ধাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাই ছিল জিয়া-মনজুর হত্যার মূল লক্ষ্য। ১২ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ১৩ জনকে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে সাজানো কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে গোপন বিচারে ফাঁসি দেয়ার পরপর ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে বিভিন্ন অজুহাতে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার করা হয়।
ওই তথাকথিত বিচারের সঙ্গে জড়িত বিচারকসহ অন্যরাও ইতিহাসের আদালতে খুনি হিসেবে চিহ্নিত হবেন। বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা অফিসার পরিস্থিতির চাপে অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য হন। মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল শওকত আলীকে অবসরে পাঠানো হয়, বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীন পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল মইনুলসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে সর্বদা সেনা গোয়েন্দারা লেগে থাকত। এরশাদ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের বিভিন্ন অজুহাতে বিদায় করে দিয়ে সবস্তরে অমুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।
জিয়া হত্যার ১০ মাসের মাথায় দেশের স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সামরিক আইন জারি করে ১০ বছর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে রাখেন এরশাদ। দীর্ঘ ৪০ বছরেও জিয়া-মনজুর হত্যার প্রকৃত বিচার হয়নি। কারণ, এরশাদের নির্দেশে তথাকথিত বিচারের মাধ্যমে যে ১৩ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয় এটা ছিল বিচারের নামে ঠান্ডা মাথায় আরেকটি হত্যাকাণ্ড। জিয়া-মনজুরকে হত্যা না করলে এরশাদ কোনো দিনই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারতেন না।
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, জিয়া হত্যার পর তার দল বিএনপি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১০ বছর ক্ষমতায় থাকলেও এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করেননি। অবশ্য জিয়া হত্যার পর এরশাদ বাড়ি-গাড়ি, অর্থসহ জিয়া পরিবারকে অস্বাভাবিক সুবিধা প্রদান করে। জিয়া-মনজুর হত্যার বিচার এবং মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা, অপসারণ, অবসর, হয়রানি-নির্যাতনের বিষয়টি উদ্ঘাটনের জন্য ট্রুথ কমিশন গঠন করা যেতে পারে। জিয়া-মনজুর হত্যার বিচার হলে এবং ট্রুথ কমিশন তদন্ত করলে ইতিহাসের বহু অজানা তথ্য যেমন উদ্ঘাটিত হতো, তেমনি কথিত বিচারে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবার-পরিজন ও সন্তানরা তাদের হারানো সম্মান ফিরে পেতেন।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, সিনিয়র সাংবাদিক।
সৌজন্যেঃ নিউজবাংলা২৪