3254
Published on এপ্রিল 9, 2021হোসেন আবদুল মান্নানঃ
জন্মশতবর্ষের বর্ণাঢ্য আয়োজনে চারদিকে বাঙালির আবেগ, উচ্ছ্বাস, ঐক্য ও জয়গানের প্রতিধ্বনি শুনছি। এ মাহেন্দ্র সময়ে তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেশে দেশে বাঙালিরা স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে ও উৎসবমুখর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্মরণ করছে জাতির পিতাকে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত শত সংগীতের বন্দনায় আজ অভিষিক্ত হচ্ছেন তিনি। ক্ষণগণনায় ১৭ মার্চ, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১০১ বছর হয়েছে এ পৃথিবীতে তাঁর আগমনের। বাংলাদেশ জাতীয় ও রাষ্ট্রগতভাবে যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের আওতায় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করেছে। এ লক্ষ্যে যথাসময়ে গঠন করা হয়েছে একটি জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি বা (National Implementation Committee for the celebration of birth centenary)। বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ পরিস্থিতির মধ্যেও কমিটি জন্মশতবর্ষ পালনের মতো শ্রমসাধ্য, ঝুঁকিপূর্ণ জাতীয় গুরুত্ববহ দায়িত্ব পালন করেছে। প্রধান উপদেষ্টা বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাই গোটা বাঙালি জাতির অকুণ্ঠ প্রশংসার দাবি রাখেন।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতকে ‘মুজিব চিরন্তন’ (The Eternal Mujib) নামে মনোরম ও রুচিসম্মত অলঙ্ককরণে একটি সংকলনও প্রকাশিত হয়; যা উদ্বোধনীসহ প্রতিদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের নির্ধারিত আসনে সংরক্ষিত ছিল।
একখানা পরিবেশবান্ধব কাপড়ের ব্যাগে পাওয়া পরিপাটি, নান্দনিক এবং বর্ণিল এ স্মরণিকার সূচিপত্র পাঠ করে দেখা যায়, এতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাণীসহ অসাধারণ কিছু সমৃদ্ধ রচনা সন্নিবেশিত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ছোটবোন শেখ রেহানার স্মৃতিময় তথ্যবহুল লেখা ছাড়াও ২০টি মূল্যবান প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতার অংশবিশেষ সংযোজিত হয়েছে। বরেণ্য লেখকের মধ্যে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন, অন্নদাশঙ্কর রায়, কবীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, সালাহ্উদ্দীন আহমদ, আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম, মফিদুল হক, শামসুজ্জামান খান। কবিদের মধ্যে পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, শামসুর রাহমান, সুফিয়া কামাল, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, আসাদ চৌধুরী এবং সম্পাদক ও কবি কামাল চৌধুরী। লেখাগুলোয় বঙ্গবন্ধুর মানবিক ও সংবেদনশীল জীবনাচার, মানুষভাবনা, রাজনীতি, দর্শন ও তাঁর নেতৃত্বের সম্মোহনী শক্তির প্রকাশ পেয়েছে নানা ব্যঞ্জনায়। কবিতার ভাষা, অনুপ্রাস, অনুকার বা উপমায় মূর্তমান হয়ে আসে মুজিবের অনবদ্য ও অবিসংবাদিত ইতিহাস-নির্ধারিত স্থান।
বঙ্গবন্ধু মুজিব সম্পর্কে উপর্যুক্ত বিখ্যাত লেখক, গবেষক, পন্ডিতমনীষী, কবি বাদেও মননশীল, দেশপ্রেমিক, সৃজনশীল বাঙালিরা বা বিশ্বপরিমন্ডলের মানবিক, বিবেকবান ব্যক্তিগণ অতীতে এবং বর্তমানে কেমন মন্তব্য করেছেন এদিকে খানিকটা দৃষ্টিপাত করা যায়।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পন্ডিত নেহরুকন্যা ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব তাঁর দেশের জনগণের কাছে স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং তিনি তাদের তা এনে দিয়েছেন। তাঁর অনন্যসাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের কাছে প্রেরণাদায়ক ছিল।’
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রখ্যাত পরমাণুবিদ, দার্শনিক এ পি জে আবদুল কালাম বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু মুজিব নিজেই ছিলেন “ঐশ্বরিক আগুন” এবং তিনি নিজেই সে আগুনে ডানা যুক্ত করতে পেরেছিলেন।’
ফিলিস্তিন কিংবদন্তি ইয়াসির আরাফাত বলেছেন, ‘আপসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য।’
রবীন্দ্র-অন্তঃপ্রাণ অমর্ত্য সেনের কথা, ‘বঙ্গবন্ধু মানে বাংলার বন্ধু। শেখ মুজিবুর রহমান অবশ্যই এর চেয়েও বেশি কিছু। তিনি বাংলাদেশের একজন মহান রাজনৈতিক নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশ ধারণার প্রবক্তা, বাংলাদেশিদের জীবনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা বাংলার সর্বাধিক প্রশংসিত ব্যক্তিত্ব। তাঁকে “বাংলাদেশি জাতির পিতা” হিসেবেই বারংবার ভূষিত করা হয়েছে এবং সেটিই যৌক্তিক। বঙ্গবন্ধু বিশ্বের ইতিবাচক পরিবর্তনের কারিগর। তাঁকে, “বিশ্ববন্ধু” বললেও অত্যুক্তি হবে না। তবে তাঁর সম্পর্কে আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার অবকাশ তৈরি করে।’
কবি, কথাসাহিত্যিক ও আইসিএস অন্নদাশঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধুর কীর্তি নিয়ে বলেছেন, ‘বাঙালির জন্য একটি পৃথক আবাসভূমি বা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন অনেকেই, কিন্তু বাস্তবতায় তা কখনো আসেনি। শেখ মুজিবই প্রথম নেতা যিনি বাঙালিদের জন্য একটি পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পেরেছেন।’
জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘অন্যান্য জাতির জীবনে যেসব অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাদের নেতাদের জাতির পিতার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, বঙ্গবন্ধু মুজিবের অবদান এদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি।’
বিদ্রোহী পন্ডিত অধ্যাপক আহমদ শরীফ যিনি জীবনভর নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেও তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘নির্বাচনের পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমানই বাঙালির বল-ভরসার আকর ও ভিত্তি, প্রেরণার, প্রণোদনার, সংগ্রামের প্রবর্তনার উৎস। তাই নির্বাচনকালে দেশসুদ্ধ সবাই আওয়ামী লীগপন্থি হয়ে উঠল। মুজিবই হলেন বাঙালির একচ্ছত্র অবিসংবাদিত নেতা এবং নায়ক।’
অধ্যাপক আবুল ফজল বলেছেন, ‘শালপ্রাংশু দেহ মুজিবের মুখের দিকে চেয়ে থাকা যায় অনেকক্ষণ ধরে। ওই মুখে কোনো রুক্ষতা বা কর্কশতার চিহ্ন ছিল না। তাঁর হাসি ছিল অপূর্ব অননুকরণীয়। এমন হাসি অন্য কারও মুখে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।’
কবি শামসুর রাহমান তাঁর কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরেছেন অনন্য উপমার ইন্দ্রজালে-
‘ধন্য সেই পুরুষ, যার নামের ওপর পাখা মেলে দেয়
জ্যোৎস্নার সারস,
ধন্য সেই পুরুষ, যার নামের ওপর পতাকার মত দুলতে থাকে স্বাধীনতা,
দেখ, প্রত্যেকটি মানুষের মাথা
তোমার হাঁটুর চেয়ে এক তিল উঁচুতে উঠতে পারছেনা
কিছুতেই।’
উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল বিবিসি বাংলা সার্ভিসের শ্রোতা জরিপের ফলাফল প্রকাশিত হয়। শ্রোতা ভোটে বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হন। সেদিন একটি আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র শিরোনাম করেছিল- Listeners name the greatest Bengali. এতে বলা হয়, Listeners of the BBCs Bengali service have voted Bangladeshis first President Sheikh Mujibur Rahman, the greatest Bengali of all Times. প্রসঙ্গত, একই জরিপে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অর্জন করেন দ্বিতীয় স্থান এবং তৃতীয় স্থানে অবস্থান করেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিশ্ব বাঙালিদের এমন নৈর্ব্যক্তিক মতামতটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কি শুধু সাড়ে ৭ কোটি মানুষের প্রেরণাজাগানিয়া বজ্রকণ্ঠবাণী? কেবল আবালবৃদ্ধবনিতার ধমনিতে শিহরণ তোলা মন্ত্রধ্বনি?
নিশ্চয় না। এসবের পরও এর ভিতরে ছিল ইতিহাসের অন্তর্নিহিত তুমুল গাঢ় বার্তা। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিতর থেকে ২৩ বছরের সুদীর্ঘ শোষণ-উৎপীড়নের ইতিহাসের ক্যানভাস তিনি মেলে ধরেছিলেন মাত্র ১৯ মিনিটের ন্যায়সংগত প্রতিবাদী অথচ অসাধারণ রাজনীতির ভাষা-কৌশলে। এমন মুগ্ধতায় বাঙালিকে এর আগে বা পরে কখনো আচ্ছন্ন হতে দেখেনি কেউ। কাজেই এ ভাষণই স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের আরেক নাম। এটাই ধ্রুব সত্য। এটাই বাস্তবতার চিত্রলিপি।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের অক্টোবরে UNESCO কর্তৃক ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ স্বীকৃতি বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদান এমন ধারণারই প্রকাশ। একই সঙ্গে বলা যায়, ২০১৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত Jacob F. Field-এর বই We Shall Fight on the Beaches : The speeches that Inspired History-তে খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১-এ Pericles Gi Funeral Oration থেকে শুরু করে ১৯৮৭ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের Tear Down This Wall পর্যন্ত যে ৪২টি ভাষণ স্থান পেয়েছে এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ৪০তম। এ ভাষণের যথাযথ এবং প্রাণবান চিত্রায়ণ দেখতে পাওয়া যায় কবি নির্মলেন্দু গুণের কালজয়ী কবিতায়-
‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা।
কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠবাণী?’
বঙ্গবন্ধুর কারান্তরাল থেকে লেখা বইগুলো বাঙালির অবশ্যপাঠ্য। তাঁকে জানা-চেনা-ভাবার জন্য এর বিকল্প কিছু নেই। যিনি অশ্রুসজল হয়ে বলতে পারেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানব জাতি নিয়েই আমি ভাবী। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ তাঁর দার্শনিক মতবাদ তাঁর আদর্শ বা ব্যক্তিগত জীবনাচার এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে কি? বিখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর যে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন (নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত) জনস্বার্থে তাও পাঠকের সামনে উপস্থাপন করা জরুরি। আমাদের অনেক অর্জন, অনেক প্রাপ্তি, অনেক প্রত্যাশার মাঝেও জাতির ললাটজুড়ে দীর্ঘ এক দুর্ভাগ্যলিপি। বেদনাবিধুর অপকর্ম, অপপ্রচার, অপপ্রয়াসের ইতিহাসও কম নয়। এমনকি শতাব্দী কাঁপানো এ ভাষণকেও বিকৃতভাষ্য করা হয়েছিল, নিষিদ্ধ করে রাখার চক্রান্ত হয়েছিল। অথচ অর্বাচীন অনুকারকরা মোটেও ভাবেনি যে এটি সম্ভব নয়, এ করা যায় না। ইতিহাসের সত্যভাষণের পুনরাবৃত্তিকে কৃত্রিমতার ফানুস দিয়ে কখনো ঠেকিয়ে রাখা যায় না। ইতিহাসের এমন সত্যের বিনাশ নেই, লয় নেই, ক্ষয় নেই বরং ঘটনাপঞ্জি বিশ্বসভ্যতার চিরন্তন অনুষঙ্গের পাদটীকা হয়ে সতত বেঁচে থাকে।
জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ ও মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এমন মহানন্দ মুহূর্তগুলো যেন বাঙালির জাতীয় জীবনে কেবল এক দিন বা এক বছর নয় প্রতিদিনই ঘুরে-ফিরে আসে।
লেখক : গবেষক ও গল্পকার।