2407
Published on এপ্রিল 1, 2021এম এ হালিমঃ
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবন থেকে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ নামে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারে এ পর্যন্ত অনেক লেখালেখি হয়েছে।
প্রত্যক্ষভাবে এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে ওই ঘটনার বর্ণনা করছি। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের সংবাদ চট্টগ্রামে পৌঁছালে ২৬ মার্চ সকাল থেকেই শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে। এর আগে রাত আনুমানিক ২টা থেকে ৩টার মধ্যে মাইকযোগে প্রচার করা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। সারা রাত মানুষের চোখে ঘুম আসেনি। সবাই স্বাধীনতা ঘোষণার কথা শুনে আনন্দে আত্মহারা।
এরই মধ্যে জনসাধারণের প্রতি বঙ্গবন্ধু ঘোষিত এক নির্দেশাবলি টেলিগ্রাম আকারে ইংরেজিতে সকাল থেকে চট্টগ্রামে বিলি করা হয়। আমার বন্ধু আবদুল মালেক এবং তৎকালীন আগ্রাবাদ কলোনির রেশন শপের মালিক সকাল ৮টার সময় মোটরসাইকেলযোগে আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনিতে আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর প্রেরিত বাণীর এক কপি আমাকে দিয়ে যান।
এর বাংলা অনুবাদ করেন তৎকালীন আগ্রাবাদ সরকারি কলোনির সেক্রেটারি শফিউদ্দিন আহমেদ (বর্তমান অবসরপ্রাপ্ত) এবং তাকে সাহায্য করেন চট্টগ্রাম আমদানি ও রপ্তানি অফিসের সহকারী কন্ট্রোলার (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) মোজাম্মেল হক। প্রথম সরকারি কলোনি মসজিদের (আগ্রাবাদ) মাইকযোগে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা প্রচার করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর প্রেরিত বাণীতে অনুপ্রাণিত হয়ে তার নির্দেশাবলি বেতার মারফত দেশবাসীর উদ্দেশে প্রচার করা যায় কিনা তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করি। এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মী ও কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। ইতোমধ্যে বেবিট্যাক্সিতে মাইকযোগে সারা শহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বাণী প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। আমার সঙ্গে তখন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ট্রেজারি সেকশনের ফজলুল হক (বর্তমান সুপার অবসরপ্রাপ্ত) ও মো. আলম নামে আরেকজন সহযোগী ছিলেন।
রেডিওর ব্যাপারে অনেকেই উৎসাহ দেখান। পরে তৎকালীন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী এমএ হান্নানের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশে রওনা হই। চট্টগ্রাম জিপিওর সামনে কিছু লোক ও কর্মীর সঙ্গে আলোচনা অবস্থায় তাকে দেখতে পাই। তখন তার বাসা ছিল জিপিওর দক্ষিণ পাশে আলকরণ মহল্লায়। আমরা একে অপরের পরিচিত ছিলাম।
আমি হান্নান সাহেবকে বিস্তারিতভাবে সব ঘটনা বলি। তিনি আমাকে প্রশ্ন করেন, ‘তোমরাও কি সেটা পেয়েছ?’ আমি বললাম, ‘জি পেয়েছি। আপনি যদি এখন দয়া করে আগ্রাবাদ রেডিও অফিসে যান তাহলে রেডিও অফিসের কর্মকর্তারা আপনার সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করবে বলে আমি মনে করি।’ কারণ তখন রেডিও অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কাজ করছিল। আমার কথা শোনার পরপরই এমএ হান্নান সাহেব আগ্রাবাদ রেডিও অফিসে আসার জন্য রাজি হন এবং ঠিক হয় তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন।
রেডিও ইঞ্জিনিয়ার আবদুস ছোবহানের পরামর্শক্রমে কালুরঘাট ট্রান্সমিশনকে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ নাম দেওয়া হয়। হান্নান সাহেব প্রথমে দেশের তখনকার পরিস্থিতি করুণভাবে বর্ণনা করেন।
তিনি তার বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণা ও নির্দেশের কথা বারবার উল্লেখ করেন। এ সময় হঠাৎ টেলিফোন বেজে ওঠে-আপনারা সরে পড়ুন। আমরা সবাই হান্নান সাহেবের নির্দেশে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ (কালুরঘাট ট্রান্সমিশন) থেকে বেরিয়ে আসি। এরপর হান্নান সাহেব আমাদের সবাইকে নিয়ে আন্দরকিল্লায় চলে আসেন। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে খবর ছড়িয়ে পড়েছে যে, হান্নান সাহেব এক গোপন রেডিও থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছেন।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কাস্টমস কর্মকর্তা
সৌজন্যেঃ দৈনিক যুগান্তর