মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী সম্প্রদায়ঃ মাকে বুঝিয়ে যুদ্ধে যাই ফিরি বিজয় নিয়ে

813

Published on মার্চ 23, 2021
  • Details Image

ধীরেন্দ্র সিংহ তখন টগবগে তরুণ। ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। এর মধ্যেই দেশের ওপর প্রবল হয় হায়নার থাবা। পাখির মতো মানুষ মারতে শুরু করল পাকিস্তানি বাহিনী। দেশের ওপর এমন আক্রমণ মানেই মায়ের ওপর আঘাত। দেয়ালে ঠেকেছে পিট। প্রতিরোধ গড়ে বীর বাঙালি। শুরু হয়ে যায় মুক্তির চূড়ান্ত সংগ্রাম। বিনাদ্বিধায় ধীরেন্দ্র সিংহও ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। তার মুখেই শোনা যাক সেই অকুতোভয় যুদ্ধদিনের স্মৃতিকথা। লিখেছেন- লাবণ্য লিপি

মৈতৈ মণিপুরী সম্প্রদায়ের ধীরেন্দ্র সিংহ এখন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ১৮-১৯ বছর। তখনকার স্মৃতিকে টেনে এনে তিনি বলেন- শ্রীমঙ্গল কলেজে পড়তাম। কলেজের ছাত্র সংসদের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলাম। ছাত্রলীগের। আমরা তো ছয় দফাসহ সব আন্দোলনেই অংশ নিয়েছি। তার পর মার্চে তো যুদ্ধ লেগেই গেল। আমি তখন গ্রামের বাড়িতে ছিলাম, শেরপুরে। সব খবরই পাচ্ছিলাম।

দেশকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। আমার ছিলই কেবল মা। তাকে বললাম যুদ্ধে যাব। সে শুনে প্রথমে ভয় পেয়ে যায়। সেটাই তো স্বাভাবিক। কোন মা চায় তার সন্তানকে যুদ্ধের মাঠে ঠেলে দিতে? তখন আমি তাকে বোঝাই। আমরা যদি দেশকে রক্ষা না করি, তা হলে চিরকালের মতো আমাদের পাকিস্তানের দাসত্ব মেনে নিতে হবে। মাকে বুঝিয়ে বলি ওরা কতটা নির্যাতন করছে আমাদের দেশের মানুষের ওপর, মা-বোনদের ইজ্জতের ওপর হাত দিয়েছে।

যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই আমি শ্রীমঙ্গলে চলে আসি। খোঁজখবর নিলাম। তার পর কয়েকজনের সঙ্গে ধলোই বর্ডার হয়ে ভারতে গেলাম ট্রেনিং নিতে। আমাদের ট্রেনিং হয় দেরাদুনে। ওখানে গিয়ে চেনাজানা আরও অনেককেই পেলাম। ভারতের আর্মি ছিল আমাদের

কমান্ডার। এখন আর নাম মনে করতে পারছি না। খুব বেশি দিন ট্রেনিং নেওয়ার সময়ও আমাদের ছিল না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যুদ্ধে যোগ দেওয়াই তখন মূল উদ্দেশ্য। কী পারি, কতটুকু পারি- সেটা ভাবার সময়ও ছিল না। শর্টকার্টে যতটুকু শেখা যায়, ততটুকুই শেখানো হয়েছিল আমাদের। রাইফেল চালানো, গ্রেনেড ছোড়া, মাইন বিছানো- এইগুলোই ট্রেনিং দিয়েছিল। আর শিখিয়েছিল কীভাবে আত্মরক্ষার মাধ্যমে শত্রুকে আক্রমণ করা যায়। ওই নিয়েই আমরা ধলোইতে ফিরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ি যুদ্ধে।

আমরা ছিলাম ৪ নম্বর সেক্টরের অধীন। বেশ কয়েকটা দলে আমরা ঢুকি। কতজন মুক্তিযোদ্ধা যে ছিল ঠিক বলতে পারব না। আসলে হিসাব করার সময়ই ছিল না তখন। ধরোইতে বিশাল একটা যুদ্ধ হয়েছিল। এখানে পাঞ্জাবিরা বড় ঘাঁটি গেড়েছিল। ওটা ভাঙাই ছিল আমাদের প্রথম টার্গেট। প্রথম কয়েক দিন কিছুতেই পারছিলাম না। বেশ কয়েক দিন ধরেই চলছিল আমাদের চেষ্টা। ওরা ছিল ওপরে। আমরা নিচে। প্রায় ১৫-২০ দিন আমরা ওভাবেই ছিলাম। তুমুল যুদ্ধ হলো। আমাদের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন চিত্ত রঞ্জন দত্ত।

শেষ পর্যন্ত ঘাঁটিটি আমরা ভাঙতে পেরেছিলাম। বাংকারটা ছিল অনেক বড়। ভেতরে ৪০-৫০ পাঞ্জাবি ছিল। সন্ধ্যা ৭টার দিকে গোলাগুলি শুরু হলো। প্রত্যুত্তরে গোলা ছুড়ছে ওরা। মুক্তিযোদ্ধারা আহত হচ্ছেন। তাদের হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। অস্থায়ী হাসপাতাল ছিল কাছেই। আমরা প্রতিরোধ করছি। সে যে কী অবস্থা, বলে বোঝানো যাবে না। একসময় বোমা মেরে আমরা ভেঙে দিই বাংকারটি। ওরা তখন ভয়ে পেছনে হঠতে থাকে।

এ ছাড়া কয়েকবার আমরা মুখোমুখি যুদ্ধ করেছি। প্রত্যেকটি অভিযানে ভারতীয় সৈনিকদের সঙ্গে মিলেই গেছি। তিনটি স্তরে সৈনিক সাজানো হতো। প্রথম স্তরে থাকত ভারতীয় আর্মি। মধ্যম ও শেষ স্তরে থাকতাম আমরা মুক্তিযোদ্ধারা। একটা অভিযানে আমার পায়ে গুলি লেগেছিল। একটু ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছিল। প্রাথমিক চিকিৎসায়ই ঠিক হয়ে যায়। তবে রেকি করত আমাদের সৈনিকরা। মানে খোঁজখবর আনা। এ কাজটাই ছিল খুব ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এ কাজের জন্য শত্রুর ক্যাম্পে ঢুকে যেতে হতো। ওরা কী করবে, কী ভাবছে- এই ইনফরমেশনগুলো নিয়ে জানানোই ছিল তাদের কাজ। সে এক নিদারুণ সময়। খেয়ে না খেয়ে দিন কেটেছে। খাওয়ার কথা আমাদের মনেও থাকত না। সব সময় প্রস্তুত থাকতাম কখন ডাক পড়বে। এক সন্ধ্যায় ক্যাম্পে বসে আছি। তখন আমাদের বলা হলো- তোমাদের এখনই যেতে হবে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে রেডি। এমনই হতো। কমান্ডারের অর্ডার ফলো করা এবং শত্রু মারাই ছিল আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।

শ্রীমঙ্গল শত্রুমুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর। আমরা বর্ডারেই ছিলাম। খবর পেয়ে শ্রীমঙ্গলে ঢুকি। সেদিন একটা বড় ঘটনা ঘটেছিল। কলেজের সামনে পাঞ্জাবিরা ঘাঁটি করেছিল। সেখানে অনেক গোলাবারুদ মজুদ করেছিল ওরা। হঠাৎ সেই বারুদ বিস্ফোরণ হয়। মুক্তিযোদ্ধারাই আগুন দিয়েছিল। সেই বিস্ফোরণে ১৯ পাঞ্জাবি মারা পড়েছিল। মানুষের সে কী আনন্দ। সেদিন বিজয় উৎসব হয়েছিল। চারপাশ থেকে জয়বাংলা ধ্বনি ভেসে আসছিল। উড়ছিল পতাকা। সে আনন্দ চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। পরের দিন আমি গ্রামে ফিরে যাই। সেই ফেরার আনন্দ তো অন্যরকম। বিজয় নিয়ে ফিরেছি।

যুদ্ধের পর যে যেমন পারি দেশ গড়ার কাজে লেগে যাই। আমরা একটা স্কুল করলাম। সেই স্কুলেই শিক্ষক হিসেবে আমি দায়িত্ব নিই। টানা ৩২ বছর চাকরি করে অবসর নিয়েছি। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাই। এই সরকার (আওয়ামী লীগ সরকার) মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যতটুকু করেছে, তাতে আমি সন্তুষ্ট। এখন আমার সব আশা এ দেশের তরুণ সমাজের কাছে। ওরা যেন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার দায়িত্ব এখন তাদের হাতেই।

সৌজন্যেঃ আমাদের সময়

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত