2647
Published on মার্চ 14, 2021বীরেন্দ্র নাথ অধিকারী:
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে তারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার গ্রেপ্তার হওয়া এবং স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান- এ দুটি বিষয়ই ২৬ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ ও আলাপচারিতায় উঠে আসে।
'পাকিস্তান পরিস্থিতি' শিরোনামে ২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে পাঠানো স্মারকপত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে বেশকিছু বাস্তব তথ্যচিত্র তুলে ধরেন। তিনি লিখে জানান, পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমন করতে মাঠে নেমে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের বিশ্বাস যে, ঢাকা এবং অন্যান্য বড় শহরের নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো পর্যাপ্ত শক্তি সম্ভবত সেনাবাহিনীর রয়েছে বটে; কিন্তু তারা বর্ধিত সময়কালে নিয়ন্ত্রণ রাখতে সক্ষম নয়। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তাৎক্ষণিক কিছু সমস্যার সৃষ্টি করেছে, যথা- পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত সরকারি ও বেসরকারি আমেরিকানদের নিরাপত্তা এবং যদি কোনো সুযোগ থাকে, তাহলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা পালন করা। তবে পূর্ব পাকিস্তানে আমেরিকান বা অন্য কোনো বিদেশি আহত হওয়ার বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো খবর পাওয়া যায়নি। আমেরিকানদের রক্ষার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা জরুরি এবং যদি প্রয়োজন হয় তাহলে রক্তপাত বন্ধে ইয়াহিয়াকে আর্থিক অনুদান ও সামরিক সহায়তা বন্ধের হুমকি দেওয়া যেতে পারে। ইয়াহিয়াকে রক্তপাত অবসান ঘটাতে চাপ দেওয়ার যুক্তিগুলো হলো- (ক) মানবিক, (খ) রাজনৈতিক এবং (গ) নতুন জাতিসত্তাবিশিষ্ট পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে কূটনৈতিকতা। মনে রাখা প্রয়োজন, পাকিস্তানের দুই অংশের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
২৬ মার্চ নিক্সনকে স্মারকপত্র পাঠানোর পরপরই কিসিঞ্জার ওয়াশিংটন সময় বিকেল ৩টা ০৩ মিনিটে 'ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন্স গ্রুপ'-এর একটি সভা ডাকেন। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, সিআইএ, জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের নীতিনির্ধারকরা উপস্থিত ছিলেন। উচ্চ পর্যায়ের এই গ্রুপ সভায় সিদ্ধান্ত হয়, পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান বিরোধে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত না থাকার নীতি অব্যাহত রাখা এবং স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানকে স্বীকৃতির জন্য অনুরোধ এলে সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ নিতে বিলম্ব করা উচিত।
সিআইএ পরিচালক রিচার্ড হেলমস পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেট সূত্রে সভায় এই মর্মে অবহিত করেন, পাকিস্তান সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র সময় ২৫ মার্চ দুপুর ১টার সময় মুজিবুর রহমানকে তাদের হেফাজতে নিয়েছে। তাকে গ্রেপ্তার করার সময় তার দু'জন সমর্থক নিহত হন। গ্রেপ্তারের আগে মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন বলে একটি গোপন রেডিওতে সম্প্রচারিত হয়েছে।
সভায় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্যান হোলেন অভিমত ব্যক্ত করেন, দীর্ঘ সময় ধরে পূর্ব পাকিস্তানে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর সক্ষমতা শূন্যের কোঠায়। তারা ঢাকা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হতে পারে, তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব গ্রামাঞ্চলে চলে যাবে। ভ্যান হোলেন আরও বলেন, আওয়ামী লীগ গত মাস থেকেই প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল এবং তাদের পেছনে অভূতপূর্ব সমর্থন ও জনপ্রিয় অনুভূতি রয়েছে বিধায় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হলেও তারা আন্দোলন চলমান রাখতে পারবে। তার অর্থ হচ্ছে, এই গৃহযুদ্ধের ফলাফল হবে মোটামুটি স্বল্পতম সময়ের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা। কারণ, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক সদস্য সরবরাহ করা খুবই দুরূহ হয়ে পড়ছে।
'ফরেন রিলেশন্স অব দি ইউনাইটেড স্টেটস, ১৯৬৯-১৯৭৬' শীর্ষক যুক্তরাষ্ট্রের দলিল থেকে সংকলিত।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ
সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল