৭ মার্চের ভাষণ ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব

1905

Published on মার্চ 7, 2021
  • Details Image

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার:

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়– ‘কোনো কালে একা হয়নি ক’জয়ী পুরুষের তরবারী, প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।’ বাংলাদেশের ইতিহাসে কবির ভাষার ‘বিজয় লক্ষ্মী নারী’ ছিলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব। তিনি বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। শেখ জহিরুল হক এবং হোসনে আরা বেগমের সন্তান শেখ ফজিলাতুননেছার শৈশব কেটেছে নিজ গ্রামে। গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে তাঁর শিক্ষা জীবনের পরিসমাপ্তি হলেও তিনি কখনও পড়ালেখা ছেড়ে দেননি। সংসার জীবনে বই ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ পাঠক। বিচিত্র বিষয়ের বই পাঠে তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। বিভূতিভূষণ, বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র, প্রবোধ সন্যালের বই ছিল তাঁর খুব প্রিয়। ওই পাঠাভ্যাসই তাকে রাজনীতি সচেতন করে তোলে। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীকার আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে তিনি জড়িয়ে পড়েন। সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীকার আন্দোলনের অন্যতম বুদ্ধিজীবী। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নানা ক্রান্তিলগ্নে তাঁর বুদ্ধি পরামর্শ ও বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণে ওই আন্দোলন নতুন গতি পায়। বাংলাদেশের অনেক বুদ্ধিজীবী যখন নীরব ছিলেন অথবা স্রোতে গা ভাসিয়েছেন অথবা ঘটনার দূরদর্শী প্রভাব বুঝতে পারেননি তখন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবের দূরদর্শী ও বাস্তবধর্মী চিন্তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে নতুন মোড় দিয়েছে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট রচনার বুদ্ধিজীবী। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এই দাবির বড় প্রমাণ। যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার সব আসামির মুক্তির দাবিতে শ্লোগানে আন্দোলনে উত্তাল হয় রাজপথ। আইয়ুব শাহীর গদি কেঁপে ওঠে। তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান নতুন ফন্দি আঁটেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে আলাপ করবেন বলে তাকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে রাওয়ালপিন্ডি নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেন। প্রথমদিকে বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তি নেওয়ার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবের বাস্তবধর্মী ও ত্বরিত পদক্ষেপের কারণে বঙ্গবন্ধু তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। প্যারোলে মুক্তি নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ গ্রন্থে এমএ ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন: বঙ্গবন্ধু কোর্টে প্যারোল চেয়ে আবেদন পেশ করার নির্দেশ দিয়েছেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি পক্ষের প্রধান কৌসুলি ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের কাছে এমন কথা শুনে বেগম মুজিব মনে মনে ভীষণ রুষ্ট হন। তিনি বঙ্গবন্ধু যাতে প্যারোলে মুক্তি না নেন সেই বার্তা পাঠান বন্দিশালায় বন্দী বঙ্গবন্ধুর নিকটে। বঙ্গমাতার চিন্তা পরবর্তীকালে সঠিক প্রমাণিত হয়। বঙ্গবন্ধু সেদিন প্যারোলে মুক্তি নিয়ে রাওয়ালপিন্ডি গেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন স্তিমিত হতো। জনগণ ও বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধারা হতাশ হতো। আইয়ুব শাহীর শাসন দীর্ঘ হতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্যারোলের বদলে মুক্তি পাওয়ায় জনগণ, সহযোদ্ধা ও পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের নিকট বঙ্গবন্ধুর আপসহীন ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। আর বঙ্গবন্ধুর ওই আপসহীন ভাবমূর্তিই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে নতুন গতি এনে দেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ত্বরান্বিত করে। নতুন দিশা পায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে কারাবরণের দিনগুলোয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব আত্মশক্তিতে বলিয়ান হয়ে বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধাদের সাহস ও শক্তি জোগান। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেরণার বাতিঘর। তাঁর উৎসাহ ও প্রেরণায় বঙ্গবন্ধু রচনা করেন ৭ মার্চের অমর কাব্যখানি। ৭ মার্চের ভাষণের পূর্বে নানা মুনির নানা মত উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু তাঁর চিরচেনা ভঙ্গিতে লক্ষ জনতার সামনে যে ইতিহাস খ্যাত দূরদর্শী ও সময়োপযোগী ভাষণ দেন তার প্রেরণা তিনি পান বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবের কাছ থেকে। বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বড় সাক্ষী। তিনি তাঁর ‘কিছু স্মৃতি কিছু কথা’ বইয়ে লিখেছেন– বাসায় গিজগিজ করছে মানুষ। বেগম মুজিব সবাইকে তাদের ঘর থেকে বাইরে যেতে বললেন। ঘরে তখন বঙ্গবন্ধু বেগম মুজিব আর হাসিনা। তিনি বললেন তুমি দশটা মিনিট শুয়ে রেস্ট নাও। শেখ হাসিনার ভাষায়– ‘আমি মাথার কাছে, মা মোড়াটা টেনে নিয়ে আব্বার পায়ের কাছে বসলেন। মা বললেন, মনে রেখ তোমার সামনে লক্ষ মানুষের বাঁশের লাঠি। এই মানুষগুলোর নিরাপত্তা এবং তারা যেন হতাশ হয়ে ফিরে না যায় সেটা দেখা তোমার কাজ। কাজেই তোমার মনে যা আসবে তাই তুমি বলবা। কারও কোনো পরামর্শ দরকার নেই। তুমি মানুষের জন্য সারা জীবন কাজ করো, কাজেই কী বলতে হবে তুমি জানো। এত কথা, এত পরামর্শ কারও কথা শুনবার তোমার দরকার নেই। এই মানুষগুলোর জন্য তোমার মনে যেটা আসবে সেটা তুমি বলবা।’

বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানের উদ্দেশ্যে রওনা হলে বেগম মুজিবও শামিল হন লক্ষ জনতার মিছিলে। তিনি সেদিন ঘরে বসে থাকেননি, ছুটে যান রাজপথে। মিছিলে মিছিলে উত্তাল নগরীতে। লক্ষ জনতার ভিড়ের কারণে তাঁর পক্ষে রেসকোর্স ময়দানে প্রবেশ করা সম্ভব না হলেও সেদিন তিনি ওই ভাষণ শোনেন শাহবাগ মোড়ে বসে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের প্রেক্ষাপট থেকে ভাষণের ময়দানে ছুটে এসে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব হয়ে ওঠেন ইতিহাসের অমরসাক্ষী। লক্ষ জনতার একজন মুক্তিকামী।

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবকে শুধু বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী হিসেবে মূল্যায়ন করলে একজন নারী হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকার প্রকৃত মূল্যায়ন হয় না। তাই স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবের অবদানের স্বতন্ত্র মূল্যায়নের দাবি করছি। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন যে প্রেরণা পায় তাঁর মূল্যায়নে তিনি অবশ্যই ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান রাখা অন্যতম বুদ্ধিজীবী। তাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এই মহীয়সী নারীর জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দাবি করছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবের অনেক আগেই স্বাধীনতা পদক প্রাপ্তির হকদার ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বদলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নিরবে সাহসের সাথে সক্রিয় আবদান রাখা এই মহীয়সী নারীর কপালে জোটে ঘাতকের নির্মম বুলেট। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সাথে সপরিবারে ৩২ নম্বরে ঘাতকের নির্মম বুলেটে তিনিও শহীদ হন নির্মমভাবে।

ঘাতকের বুকে পদাঘাত করে বাংলাদেশ আবারও মুক্তিযুদ্ধের মন্ত্রে বলিয়ান হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের বুকে। এই স্বর্ণালী সময়ে তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অনবদ্য অবদান রাখার জন্য শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবকে স্বাধীনতা পদক প্রদানের জোর দাবি জানাই। স্বাধীনতা পদক প্রদান কমিটিসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সকলে বিষয়টি ভেবে দেখবেন বলে আশা করি। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী ও বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মাতা হিসেবে নয়, একজন নারী হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে ও মুক্তিযুদ্ধে শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব যে অবদান রেখেছেন তার মূল্যায়নে তিনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও স্বাধীনতা পদক প্রাপ্তির অন্যতম দাবিদার বলে আমরা মনে করি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত