অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাবঃ
বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের অমর ভাষণটি দিয়েছিলেন একাত্তরে। সেই ভাষণের পথ বেয়ে আমাদের চূড়ান্ত মুক্তি সংগ্রাম আর স্বাধীনতা। এই ইতিহাস সবার জানা। কাজেই নতুন করে বলার প্রয়োজন সামান্যই। ২০২১-এ ৭ মার্চটা অনেক স্বস্তির। আজ বাংলাদেশে যখন তার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দারপ্রান্তে এদেশের ক্ষমতায় তখন স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির নিরবচ্ছিন্ন একটি যুগ অতিবাহিত। বাংলাদেশও সেই সুফল উপভোগ করছে পরিপূর্ণভাবে। করোনা মোকাবেলায়ই হোক কিংবা হোক অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিংবা অন্য যে কোন খাতে যে কোনকিছু, সবকিছুতেই অগ্রগণ্য এখন বাংলাদেশ। করোনায় যখন মুখ থুবড়ে পড়ছে পৃথিবীর একের পর এক নামী-দামী অর্থনীতি, বাংলাদেশ তখন সামনে ছুটছে। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মীয়মাণ পদ্মা সেতু জুড়ে দিয়েছে প্রমত্তা পদ্মার একূল-ওকূল। দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে ঢাকায় মেট্রোরেল, কর্ণফুলীর তলদেশে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম যোগাযোগ টানেল আর মাতারবাড়ির গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে শুরু করে রূপপুরের পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের মতো একের পর এক মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন। তালিকা লিখে শেষ করা অসম্ভব। সেই চেষ্টাও তাই করব না। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশ। এর স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। বাংলাদেশের আজ যে আয়-উন্নতি আর একাত্তরের প্রতি অনুগত শক্তির পায়ের তলায় আজ যে এত শক্ত ভিত্তি তা নিয়ে আমাদের প্রশান্তির শেষ নেই। আমরা ধরেই নিচ্ছি একাত্তরের পরাজিত ওদের আমরা এবার চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেছি। এখন আমাদের শুধুই এগিয়ে যাওয়া।
ঠিক এমনটাই আমরা মনে করেছিলাম বাহাত্তরের ৭ মার্চ, ৭ মার্চের অমর ভাষণের বর্ষপূর্তিতে, যখন বাংলাদেশ ছিল পৃথিবীর নবীনতম স্বাধীন রাষ্ট্র। আর তা যেহেতু অর্জিত হয়েছিল পৃথিবীর চতুর্থ সামরিক শক্তিকে নাস্তানাবুদ করে, ত্রিশ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ বীরঙ্গনার সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে, আমরা ধরেই নিয়েছিলাম আমাদের সেই বিজয় সুসংহত ও শহীদের রক্তধারায় পরিশুদ্ধ। আমাদের ভুলটা ভেঙ্গেছিল মাত্র সাড়ে তিন বছর পর পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মম হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে। তারপর ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়ে তারিখটা যখন আবারও ৭ মাচর্, ১৯৭৬, কেমন ছিল সেই দিনটি? কিভাবে উদযাপিত হয়েছিল ছিয়াত্তরের ৭ মার্চ? আজ ৭ মার্চ যখন বাংলাদেশের জাতীয় দিবস আর ৭ মার্চের ভাষণ যখন ভাষণ হিসেবে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ, তখন ঘুরে আসা যাক বঙ্গবন্ধুর শারীরী অনুপুস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রথম ৭ মার্চ। সেদিন বাংলাদেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন জেনারেল জিয়া। তিনি ছিলেন একাধারে সেনাপ্রধান আর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় ছিয়াত্তরের ৭ মার্চ, ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানেই আয়োজন করা হয়েছিল একটি বিশাল ইসলামী জলসার। সামরিক শাসনের অধীনে দেশে সবরকম সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও এই জলসার ব্যাপারে তা প্রযোজ্য হয়নি। হয়নি কারণ এর আয়োজকরা সবাই ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সক্রিয় সদস্য। সিরাত মাহফিল নামে আয়োজিত এই ইসলামী জলসায় সভাপতিত্ব করেন আজকের চিহ্নিত, দন্ডিত যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রেখেছিলেন জিয়ার উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এয়ার ভাইস মার্শাল এমজি তোয়াব। সভা আলোকিত করে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন পাকিস্তানী এবং লিবীয় রাষ্ট্রদূতরা। সভায় রাজাকার সাঈদী ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। দৈনিক ইত্তেফাকের ৮ মার্চ, ১৯৭৬ সংখ্যায় দেখা গেছে এসব দাবির অন্যতম ছিল বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ ঘোষণা, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন আর বেদাতি শহীদ মিনার ধ্বংস করা। জিয়ার সামরিক সরকারের দ্বিতীয় ব্যক্তি তোয়াব এসব দাবির প্রতি তার সরকারের সমর্থনের ঘোষণা দেন ভাষণে। এ সময় স্লোগন ওঠে, ‘তোয়াব ভাই তোয়াব ভাই, চানতারা পতাকা চাই’।
আজ যখন আমরা আমাদের এগিয়ে চলা আর সুন্দর সময়গুলো উপভোগ করছি, উদযাপন করছি ৭ মার্চের সুবর্ণজয়ন্তী, ঊনপঞ্চাশ বছর আগের সেই অস্বস্তিকর স্মৃতিটুকু টেনে আনার উদ্দেশ্য একটাই- ওরা আছে। আছে ঘাপটিমেরে, কিন্তু আছে বহাল তবিয়তেই। ওরা সুযোগে আছে আবার ছোবল দেয়ার। আজ যখন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডে জড়িত থাকা আর একাত্তরের পরাজিত শক্তিকে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসনের দায়ে জিয়ার পদক বাতিলের সিদ্ধান্ত হয় তখন আমরা তাদের আবার দেখছি। দেখছি প্রেসক্লাবে ঘাপটিমেরে পুলিশের ওপর লাঠি হাতে চড়াও হতে। কদিন আগে দেখেছি কোভিশিল্ডকে মুরগির ভ্যাকসিন বলে গোটা জাতিকে বিভ্রান্ত করে এখন কি সুন্দর কোভিশিল্ড নিয়ে নিজের ভালটা ভালভাবে বুঝে নিতে। আমাদেরও আমাদের ভালটা ভালভাবেই বুঝে নিতে হবে, যাতে আর কখনই আমাদের কোন ৭ মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কোন জিয়া, তোয়াব বা সাঈদীর অমার্জনীয় ঔদ্ধত্য হজম করতে না হয়।
লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ