আল জাজিরা নাটকের কুশীলব

1691

Published on ফেব্রুয়ারি 18, 2021
  • Details Image

ড. রাশিদ আসকারী:

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা টেলিভিশনের ‘All the prime minister’s men’ প্রতিবেদনটি যেভাবে রহস্যের হাওয়া দিয়ে ফোলাবার চেষ্টা করা হয়েছিল, তা মনে হয় বেশি হওয়ায় ফেটে গেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিকসন ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি-বিষয়ক বব উডওয়ার্ড এবং কার্ল বার্নস্টেইনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন যা ‘All the president men’ নামে ১৯৭২ সালে ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত হয়েছিল, সম্ভবত সেখান থেকে শিরোনাম ধার করে ঈষৎ এডিট করে আল জাজিরা চমক দেখাবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোথায় ওয়াশিংটন পোস্টের সেই বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, আর কোথায় সেই আল জাজিরার সাংবাদিকতা!

ওয়াশিংটন পোস্ট যা করেছিল তা সাংবাদিকতার জন্য সাংবাদিকতা। সত্য উন্মোচনের জন্য সাংবাদিকতা। আল জাজিরা যা করছে তাকে সাংবাদিকতা না বলে কুৎসা রটনা বলাই ভালো।

আল জাজিরার উদ্দেশ্য এই প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে আর যা-ই হোক সত্যানুসন্ধান যে নয়, তার প্রমাণ প্রতিবেদনের পরতে পরতে মিশে আছে ফেরারি আসামি হারিস আহমেদ সেনাপ্রধানের ভাই হতে পারেন কিন্তু সরকার তার কথামতো নাচে, এমনটি দাবি করা কি হাস্যকর নয়?

এত ক্ষমতাধর মানুষ কী করে ২৫ বছর ধরে পলাতক থাকে সে বিস্ময় তো থাকেই। আবার, আওয়ামী লীগের পুরো শাসনামলে এমনকি ২০১৮ সালে তার ভাই সেনাপ্রধান হওয়ার পরও রাষ্ট্রপতির ক্ষমা অর্জনে ব্যর্থ হন কী করে তা-ও ভাবার বিষয়।

১৯৯৪ সালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার পেছনে দাঁড়ানো হারিসের ছবি কি প্রমাণ করে যে, তিনি শেখ হাসিনার নিরাপত্তারক্ষী? রিজেন্ট গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর প্রতারক শাহেদকেও তো দেখা গেছে বড় বড় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে ছবি তুলতে। তবু সেনাপ্রধানের অপরাধী ভাইদের কিংবা বিদেশ-বিভুঁইয়ে তাদের আত্মম্ভরিতা কিংবা সেনাপ্রধানের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নিয়ে অভিযোগ উঠতেই পারে এবং কারও অনুসন্ধানী চোখে ধরা পড়তেই পারে।

সে ক্ষেত্রে যদি প্রতিবেদনের নাম হতো All the general’s men তাহলেও হয়তোবা পুরো প্রতিবেদনের সঙ্গে নামকরণের সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠত না। কিন্তু দেশের বাইরে সেনাপ্রধানের ভাইদের অপ্রত্যাশিত আচরণের বিবরণ দিতে গিয়ে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ বলে আক্রমণের তীরটা প্রধানমন্ত্রীর দিকে ছুড়ে দেয়ার চক্রান্ত কোনো সাংবাদিকতার এথিক্সের মধ্যে পড়ে না। তা ছাড়া কিছু বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির কিংবা বিচ্ছিন্ন ঘটনার জের টেনে আমি রাষ্ট্রকে একেবারে ‘মাফিয়া রাষ্ট্র’ বলে রায় দেয়া যুক্তির ধোপে কতটুকু টিকবে তা-ও বিচার্য।

একটি সরকারের বিরুদ্ধে একটি আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যম কর্তৃক কোনো গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করার জন্য যে তথ্য-সামর্থ্য দরকার তা কি রয়েছে আল জাজিরার ডকুফিল্মে?

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক ইসরায়েল থেকে ইন্টারনেট ও মোবাইল মনিটরিং সরঞ্জামাদি ক্রয়-সংক্রান্ত যে তথ্য জাজিরার প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে, তার কোনো প্রামাণিক দলিল নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরাইলের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকায় সে সম্ভাবনার কোনো অবকাশও নেই। তারপরও যদি জাজিরার হাতে কোনো অকাট্য প্রমাণ থাকে তাহলে তা হাজির করার এই মোক্ষম সময় নয় কি?

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তীব্র আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদের পরও জাজিরার নির্লিপ্ততা তাদের দুর্বলতারই প্রমাণ।

বিশ্ব বিতর্কিত সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এই বাংলাদেশ বিদুষণ অবশ্য নতুন কোনো বিষয় নয়। বিতর্কিত সাংবাদিক ডেবিড বার্গম্যান ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আল জাজিরায় ৩৫টি প্রতিবেদনে বাংলাদেশ নিয়ে বিষোদ্গার করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক তুলেছেন।

২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের তাণ্ডব নিয়ে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করেছেন। বারবার যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। জাজিরার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও তাতে দেখা গেছে বিতর্কিত চরিত্রে। কে এই বার্গম্যান? আল জাজিরার সঙ্গেইবা তার সম্পর্ক কী?

১৯৯৬ সালে আরব বিশ্বের প্রথম সার্বক্ষণিক সংবাদ চ্যানেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে কাতারভিত্তিক টিভি চ্যানেল আল জাজিরা। প্রথম আলোচনায় আসে জঙ্গিসম্রাট আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার প্রচার করে।

২০১৩ সাল থেকে তালেবান, আল-কায়েদা, মুসলিম ব্রাদারহুড, আইএসআইসহ বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর খবর প্রচার করে। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন জঙ্গিসংগঠনকে আর্থিক সহায়তা দেয়ার অভিযোগও রয়েছে। উসকানিমূলক ও বিতর্কিত সংবাদ পরিবেশনের জন্য এই মিডিয়ার ওয়েবসাইট ব্লক করে দেয় সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর ও বাহরাইন।

কুয়েত শাখার কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় কুয়েত সরকার। ২০১৫ সালে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের অভিযোগে আল জাজিরার তিন সাংবাদিককে কারাদণ্ড দেয় মিশরের আাদালত। হলুদ সাংবাদিকতা, ধর্মীয় উসকানি, জিহাদের অপব্যাখ্যা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা, প্রভৃতি কারণে বিশ্বে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে এই মিডিয়া। আল জাজিরা তার মৌল চারিত্রিক কারণেই শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নিলে তাদের গাত্রদাহ হয়। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর হলে তারা সংক্ষুব্ধ হয়। বাংলাদেশে জঙ্গি দমনে কঠোর উদ্যোগ নিলে তারা অভিমান করে। আর সে কারণে তাদের যত রাগ শেখ হাসিনার ওপর গিয়ে পড়ে। জাজিরার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে অভিন্ন লক্ষ্য-উদ্দেশ্যধারী মানুষ বাংলাদেশেও আছে।

শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে তাদের ঐক্যবদ্ধ করার মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে আল জাজিরার এদেশীয় এজেন্টরা। ডেভিড বার্গম্যান বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দণ্ডিত, জুলকার নাইন সায়ের খান (সামি) মাদকাসক্তির অপরাধে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি কর্তৃক বহিষ্কৃত একজন ক্যাডেট এবং তাসলিম খলিল বিতর্কিত নেত্র নিউজের প্রধান সম্পাদক। এই বার্গম্যান-সামি-খলিল চক্র তাদের ক্রীড়নক হয়ে কাজ করছে, তা সহজেই অনুমেয়।

গত এক দশকে এদের সাংবাদিকতার ট্রাক রেকর্ড জরিপ করলে দেখা যাবে, সাংবাদিকতা বলতে এরা বুঝেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদশের বিরোধিতা করা। শেখ হাসিনার প্রতিটি সাফল্য এদের নতুন বিরোধিতায় উৎসাহ দিয়েছে। নতুন ষড়যন্ত্রের সন্ধান দিয়েছে। আর এই ষড়যন্ত্র চলতেই থাকবে যত দিন না তাদের মনের মানুষেরা ক্ষমতায় আসে। বৈশ্বিক মহামারির এই সংকটকালে যেটি হাতে গোনা দেশ দক্ষতার সঙ্গে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে চলেছে এদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আর বাংলাদেশের এই সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ শেখ হাসিনার দক্ষ, সাহসী ও স্মার্ট নেতৃত্ব। করোনার এই ভয়াবহ সংকটের মধ্যে ও বাংলাদেশে পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যান বসল; আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাহাত্তর হাজার গৃহহীনকে বসতি স্থাপন করে দেয়া হলো; একেবারে প্রথমিক পর্যায়ে করোনা ভ্যাকসিন আনা হলো। এ রকম একটি সময়ে যখন নিজ দেশসহ সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, তখন আল জাজিরার এই প্রতিবেদন খুবই বিব্রতকর।

বিশেষ করে যে সেনাবাহিনী জাতিসংঘের শন্তিরক্ষী মিশনে বিশ্বের সর্বোচ্চ অবদান রাখছে, তার প্রধানকে বিতর্কিত করার চেষ্টা বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর। জাতিসংঘ এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে, তা জরুরি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তীব্র প্রতিবাদ দিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অভিযোগে বস্তুনিষ্ঠতা থাকলে তদন্ত করার আশ্বাস দেয়া হয়েছে, এটি স্বস্তিদায়ক।

এ ব্যাপারে সরকারকে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবিলা করবে বলে সবাই আশাবাদী। প্রধানমন্ত্রী যে দৃঢ়তার সঙ্গে পদ্মা সেতু প্রকল্পে উত্থাপিত অভিযোগ মোকাবিলা করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন- ওয়ার্ল্ড ব্যাংকসহ ডোনার কনসোর্টিয়ামের উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ অন্টারিওর আদালতে অপ্রমাণ করে বাংলাদেশের মাথা উঁচু রেখেছেন, ঠিক তেমনি এবারেও আল জাজিরার অভিযোগ আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে মিথ্যে প্রমাণ করে, নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সত্যাসত্য নির্ণয় করে, দেশের ভাবমূর্তি সমুজ্জ্বল রাখবেন।

বাংলাদেশকে এভাবে নিরন্তর লড়াই করে টিকে থাকতে হবে। একদা যারা বাংলাদেশকে ‘বাস্কেট কেস’ আখ্যা দিয়েছিল এখন তারাই একুশ শতকের অন্যতম প্রধান বর্ধিষ্ণু দেশ হিসেবে বিবেচনা করছে। বাংলাদেশের এই অভাবনীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যাদের গায়ে ফোসকা তোলে, তারা নিজের নাক কেটেও বাংলাদেশের যাত্রা নষ্ট করতে চাইবে। আল জাজিরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ওই সকল অভিযোগ তুলে বাংলাদেশের কতটুকু ক্ষতি করতে পারবে জানি না, তবে আল জাজিরা যে তথ্য সন্ত্রাসী তা আবারও প্রমাণ হবে। তবে, তাতে এই স্থূলচর্ম সংবাদমাধ্যমের কোনো আত্মোপলব্ধি হবে বলে মনে হয় না। তা না হোক, সত্যের জয় হবে। 

লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখকঅধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ ও সাবেক উপাচার্য ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত