গ্রাম উন্নয়ন ও মুজিববর্ষের প্রত্যাশা

2590

Published on ফেব্রুয়ারি 15, 2021
  • Details Image

সজল চৌধুরীঃ

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনেপ্রাণে ধারণ করতেন, গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত শক্ত না হলে শহরের খুঁটিও শক্ত হবে না- এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। তাই দিনবদলের হাওয়ায় গ্রাম উন্নয়ন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগ নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আসা যাক বাংলাদেশ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮-তে বর্ণিত 'আমার গ্রাম-আমার শহর'-এর অনুচ্ছেদে, যা সত্যিই আশা-জাগানিয়া।

ইশতেহারের ৩.১০ অনুচ্ছেদ 'আমার গ্রাম-আমার শহর'-এ বলা আছে প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের কথা। তা ছাড়া বর্তমান সরকার গ্রামকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির কেন্দ্রীয় দর্শন হিসেবে বরাবরই বিবেচনা করে এসেছে। স্বাধীন দেশে জাতির পিতা সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে নগর ও গ্রামের বৈষম্য ক্রমাগত দূর করার উদ্দেশ্যে কৃষিবিপ্লবের বিকাশ; গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতায়ন; কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ; শিক্ষা, যোগাযোগ ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার যুক্ত করেছিলেন। এবারের নির্বাচনী ইশতেহারেও সুস্পষ্ট বলা হয়েছে- পল্লি উন্নয়নের লক্ষ্য হবে গ্রামাঞ্চলে কর্মসৃজন, নাগরিক সুযোগ-সুবিধার প্রচার-প্রসার এবং গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসনের হার কমিয়ে আনা। প্রতিটি ইউনিয়ন সদরকে পরিকল্পিত পল্লি জনপদ হিসেবে গড়ে তোলা হবে। আবাসন, শিক্ষা, কৃষিনির্ভর শিল্পের প্রসার, চিকিৎসাসেবা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানীয় জল ও পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থার মাধ্যমে উপজেলা সদর ও বর্ধিষ্ণু শিল্পকেন্দ্রগুলোকে আধুনিক শহর-উপশহর হিসেবে গড়ে তোলা হবে; যা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নের সম্পূূরক।

বর্তমান সরকার প্রতিটি গ্রামকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে উন্নত করার কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলছে প্রতিনিয়ত। উন্নত রাস্তাঘাট, যোগাযোগ, সুপেয় পানি, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা ও সুচিকিৎসা, মানসম্পন্ন শিক্ষা, উন্নত পয়ঃনিস্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধি, কম্পিউটার ও দ্রুতগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামসহ মানসম্পন্ন ভোগ্যপণ্যের বাজার সম্প্র্রসারণের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রামে আধুনিকায়নের সব সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে ক্রমাগতভাবে; এমনকি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। গ্রামে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আরও বাড়ানো ও নির্ভরযোগ্য করার লক্ষ্যে বায়োগ্যাস প্লান্ট ও সৌরশক্তি প্যানেল বসানোয় উৎসাহ ও সহায়তা প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। গ্রাম পর্যায়ে কৃষিযন্ত্র সেবাকেন্দ্র, ওয়ার্কশপ স্থাপন করে যন্ত্রপাতি মেরামতসহ গ্রামীণ যান্ত্রিকায়ন সেবা সম্প্রসারণ এবং এসবের মাধ্যমে গ্রামীণ যুবক ও কৃষি উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানসহ বিশদ পরিকল্পনার সফলতা অচিরেই বাংলাদেশ দেখতে পাবে। কৃষি খাতের এসব সেবার পাশাপাশি হাল্ক্কা যন্ত্রপাতি তৈরি ও বাজারজাত করতে বেসরকারি খাতের প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ সুবিধাসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। কারণ 'সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ'- এ স্লোগানের ওপর ভিত্তি করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮-তে বর্ণিত হয়েছে বাংলাদেশের গ্রামগুলোর আধুনিকায়ন নিয়ে ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা। নিঃসন্দেহে গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের জন্য এটি একটি আশাব্যঞ্জক প্রতিশ্রুতি- এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। সবচেয়ে প্রধান ও ইতিবাচক হলো, উন্নয়ন চিন্তার মধ্যে সর্বপ্রথম আমাদের গ্রামগুলোকে স্থান দেওয়া, যা আগে কখনও হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী তার এই গ্রামোন্নয়ন ভাবনা অত্যন্ত বড় করে দেখছেন। তার এ দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। যেমনটি স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশের গ্রামগুলোর উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি যেমন দেখেছিলেন গ্রামনির্ভর প্রকৃত শিক্ষা ও উন্নয়ন না হলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন হবে না; বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও গ্রাম উন্নয়নের সঙ্গে গ্রামের মানুষদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়কে প্রাধান্য দিচ্ছেন সর্বাত্মক। স্বপ্ন দেখছেন বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষকে নিয়ে নতুন একটি 'অর্থনৈতিক শিল্প চেতনায়'।

গ্রামগুলোর ক্ষেত্রে প্রথমেই প্রয়োজন ইকো কিংবা স্মার্ট ভিলেজ উন্নয়নের ধারণা, যা করতে হবে গ্রাম্য পরিকল্পনার প্রতিটি পর্যায়ে। সেই সঙ্গে প্রয়োজন অভিজ্ঞ গবেষকদের পর্যাপ্ত সুযোগ প্রদান আমাদের পড়ে থাকা গ্রামগুলো নিয়ে ভাববার; প্রায়োগিক গবেষণা করার জন্য। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন গবেষণা ল্যাব স্থাপন করে সেখানে গ্রামগুলোর আবাসন এবং দূষণ ও পরিবেশগত উন্নয়নের চিন্তা করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে কাগজ-কলমে গবেষণার মধ্যে না থেকে প্রয়োজন প্রায়োগিক গবেষণা। এসব ক্ষেত্রে বিশেষ করে গ্রাম উন্নয়নে গৃহায়ন ও গণর্পূত বিভাগ আমাদের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক জেলাতেই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় নিজ নিজ এলাকার উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছার। তা ছাড়া প্রতিটি গ্রামে একটি সমন্নিত কর্ম-কমিটির মাধ্যমে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। কমিটিগুলো বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরিচালিত হবে, যা সরকারের কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে।

শক্তির অপচয় ও ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে গ্রামের আবাসনসহ অন্যান্য খাতকে সংখ্যা কিংবা মান অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের রেটিংয়ে ভাগ করা যেতে পারে। এই রেটিং সংখ্যা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। যে স্থাপনার রেটিং যত বেশি তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে। এতে গ্রামবাসীর মধ্যে টেকসই প্রযুক্তির ব্যবহার আরও আকৃষ্ট করবে। আমাদের দেশেও এমন চিন্তা করার সময় এসছে বৈকি গ্রাম ও শহর উভয় ক্ষেত্রেই। তবে চিন্তা করতে হবে সামগ্রিক অবস্থাকে বিবেচনা করে। প্রয়োজন গ্রামের আবাসন এবং অন্যান্য শিল্পে দেশীয় প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার ও দিকনির্দেশনা।

গ্রামের উন্নয়নের পূর্বশর্ত সেখানকার স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন। এ ক্ষেত্রে গ্রামের হাসপাতালগুলোর আধুনিকায়ন এবং সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। সর্বক্ষণ পর্যাপ্ত ডাক্তার ও ওষুধ থাকতে হবে। সর্বোপরি স্বাস্থ্যসেবার মান সুনিশ্চিত করতে হবে। গ্রামে পড়ে থাকা ডাক্তারদের সব ধরনের নিরাপত্তা এবং জীবন ধারণের সুবিধা থাকতে হবে। তা ছাড়া গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্থানীয়ভাবে ওয়েলিং ইন্ডেপ তৈরি করা যেতে পারে। যার মাধ্যমে গ্রামের মানুষদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। অন্যদিকে গ্রামের শিক্ষাকে আনন্দদায়ক করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নতুনভাবে সজ্জিত করতে হবে, প্রাণের আহ্বানে। অভিজ্ঞ শিক্ষক যেন গ্রামে বসবাস করার অনুপ্রেরণা পায়, সে জন্য তাদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। এমনকি সেটি শহরের সুযোগ-সুবিধার চেয়ে কোনো অংশে কম হবে না। প্রতিটি গ্রামে ছোট ছোট সাংস্টৃ্কতিক চর্চা কিংবা বিনোদন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা থাকা প্রয়োজন। গ্রামের মানুষদের মনন বিকাশে এর ভূমিকা অপরিসীম। হাটবাজারকে নতুনভাবে আরও চমকপ্রদ করে সাজানো প্রয়োজন। এতে তাদের মধ্য অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা বাড়বে। আগামী ১০ বছরের জন্য একটি গ্রাম পরিকল্পনা কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। সেখানে তিন পর্যায়ের প্রকল্প ভাগ করতে হবে- স্বল্পমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি, করণীয় এবং আশু করণীয়।

এ ছাড়াও বছরব্যাপী গ্রাম উন্নয়নের খসড়া প্রণয়ন করতে হবে প্রতিটি গ্রামের জন্য। সরকারিভাবে গ্রাম উন্নয়নের জন্য 'গ্রাম উন্নয়ন নীতিমালা' প্রণয়ন করা যেতে পারে। এখানে কৃষি, পানি, শক্তি, স্যানিটেশন, আবাসন, চিকিৎসা, শিক্ষা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ভাগ থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে বৃহৎ পরিকল্পনার চেয়ে ক্ষুদ্র ও স্বল্প সময়ের পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং দ্রুত বাস্তবায়নই হবে বেশি কার্যকর। এ ক্ষেত্রে মূল চিন্তা করতে হবে গ্রামের সাধারণ মানুষদের জীবনযাত্রায় কী কী স্বাভাবিক পরিবর্তন আনলে তারা একটি সুন্দর, সুস্থ ও পরিবেশবান্ধব অবস্থানে তাদের নিজ গ্রামে বসবাস করতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাদেরকে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে, তাদের সঙ্গে কথা বলে নিজস্ব জীবনযাত্রাকে উপলব্ধি করে কাজগুলো করতে হবে।

প্রতিটি গ্রামে অন্তত একটি 'ডিজিটাল তথ্যকেন্দ্র' গ্রামবাসীর জ্ঞান-বিজ্ঞান বিকাশে সহায়ক হবে। এসব ডিজিটাল কেন্দ্র থেকে গ্রামবাসী তার জীবন ধারণের প্রতিটি বিষয়ে জানতে পারবে; শিক্ষা থেকে শুরু করে চিকিৎসা পর্যন্ত। এমনকি একটি গ্রামের মানুষ তার আশপাশের গ্রামের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে নেটওয়ার্কিং করতে পারবে, যা তাদের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করবে। তবে এ ক্ষেত্রে বর্তমান বাংলাদেশ ডিজিটাল প্রযুক্তিতে যেভাবে এগিয়ে চলেছে, আমাদের গ্রামগুলোয় অচিরেই এ ধরনের পদক্ষেপের সুষ্ঠু প্রয়োগ দৃশ্যমান হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমনকি কিছু গ্রাম ইতোমধ্যে এসব পদক্ষেপের আওতাভুক্ত। প্রথমদিকে কৃষি খাত ও স্কুলে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাধ্যতামূলক এবং তাদের মাধ্যমে প্রযুক্তির জ্ঞান সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। বর্তমান করোনা মহামারি ডিজিটাল বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয়তা সবার সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে গ্রাম পর্যায়ে পর্যাপ্ত ডিজিটাল ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে গ্রামবাসীর মধ্যে।

আশার কথা এই, ইতোমধ্যে উল্লিখিত প্রায় প্রত্যিটি বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তা ছাড়া বাংলাদেশ প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়েছে। সবশেষে বলতে চাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা যে বৃহৎ স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশের গ্রামকে উন্নত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন, সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশের গ্রামের প্রত্যেক মানুষ ডিজিটাল গ্রামবাংলার সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। এই হোক মুজিববর্ষের প্রত্যাশা।

লেখকঃ শিক্ষক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক

সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত