বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার: ৩৫ বছরের অপেক্ষার অবসান

6773

Published on জানুয়ারি 30, 2021
  • Details Image

রা'আদ রহমান:

২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বাঙালি জাতির কলঙ্কমুক্তির দিন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকারী ৫ খুনি ফাঁসিতে ঝুলেছিল এদিন। পিতার বুকে ব্রাশফায়ার করবার দীর্ঘ ৩৫ বছর পর অবশেষে আত্মস্বীকৃত খুনি নরপিশাচদের বিচার সম্পন্ন করতে পেরেছিলাম আমরা। একটা দেশের স্থপতি, জাতির জনক, স্বাধীনতা ও মুক্তির মহানায়ক, যে তার পুরো জীবনটাই স্বজাতিকে ভালোবেসে উৎসর্গ করে গেছে জেলে আর রাজপথে, তাকে পুরো পরিবারসহ ব্রাশফায়ারে মেরে ফেলার মত পৈশাচিক অচিন্তনীয় অপরাধের জন্য আসলে কোন শাস্তিই যথেষ্ট না, শতবার ফাঁসিতে ঝোলালেও খুনিদের প্রাপ্য শাস্তি নিশ্চিত হয় না, তবুও ফাঁসিতে ঝোলাবার মত এইটুকু শাস্তি নিশ্চিত করতেও তো যুগের পর যুগ পেরিয়ে গেল। খুনিদের আস্ফালন আর তাদের পুরষ্কৃত করা পৃষ্ঠপোষকদের ক্ষমতার দাপটে একসময় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার বিচার এই দেশে হবে সেটাই অসম্ভব মনে হচ্ছিল। সেই বিচারের রায় পাওয়া এবং সেটা বাস্তবায়িত হওয়ার পুরো ঘটনাটাই এতটা অনিশ্চয়তায় মোড়ানো ছিল যে সেটা ঘটে যাওয়ার আজ ১১ বছর হলো তা ভাবতেও অবিশ্বাস্য লাগে।

কি করা হয়নি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দেবার জন্য? আজ এতো বছর পর ২০২১ সালে দাঁড়িয়ে আমাদের সম্ভবত কল্পনা করতেও কষ্ট হবে যে এই দেশের স্থপতি, এই জাতির জনক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিকে সপরিবারে ব্রাশফায়ারে মেরে ফেলার মত চরম পৈশাচিক একটা গণহত্যার কোন ধরনের বিচার যেন না হয় এবং স্বঘোষিত খুনিরা, যারা অসংখ্যবার প্রকাশ্যে এই হত্যাকাণ্ড চালাবার জন্য গর্ববোধ করেছে, তাদের যেন কোন ধরনের শাস্তির মুখোমুখি হতে না হয়, সেজন্য এই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক নির্বাহী আদেশে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে। সেদিন খুনি ঘাতকদের হাতে নিহত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজি জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সাব ইন্সপেক্টর ছিদ্দিকুর রহমান, পেট্রোল ডিউটির সৈনিক সামছুল হক ও রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিলসহ আরও অনেক মানুষ। এদের মধ্যে শিশু শেখ রাসেলকে কোল্ড ব্লাডে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়েছিল এই সাইকোপ্যাথের দল। এমনকি গর্ভবতী নারীকেও নির্বিচারে খুন করেছে এরা। আর রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেই সবার প্রথমে সেই খুনিদের সুরক্ষা দিতে এবং নিরাপদ রাখতে রাষ্ট্রীয় নির্দেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা যাবে না এবং খুনিদের কোন ধরনের বিচারের মুখোমুখি করে শাস্তি দেওয়া যাবে না বলে অধ্যাদেশ জারি করেছিল খন্দকার মুশতাক। যে মানুষটার নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটা তৈরি হলো, তাকেই নির্মমভাবে খুনের বিচার করা যাবে না বলে অধ্যাদেশ জারি হলো সেই রাষ্ট্রে, রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশে। কি চরম নির্লজ্জ রসিকতা!

রসিকতার কিন্তু সেখানেই শেষ না। তাড়াহুড়ো করে জারি করা সেই অধ্যাদেশ টিকে রইলো আরও চার বছর। ততদিনে এই দেশে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ হয়ে গেছে ব্লাসফেমির সমপর্যায়ের পাপ। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আকর্ষণীয় চাকরি দেওয়া হয়েছে, অনেককে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধি অর্থাৎ রাষ্ট্রদূত কিংবা দূতাবাসের কর্মকর্তা বানিয়ে পাঠানো হয়েছে। এ যেন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে খুন করবার উপহার বিশেষ। যে জাতির জনক নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতা, মুক্তি আর সার্বভৌমত্ব এনে দিলেন, যার জন্য স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ পেলো এই জাতি, সেই জনককে ব্রাশফায়ারে ঝাঁঝরা করবার পুরষ্কার হিসেবে সেই দেশেরই রাষ্ট্রদূত আর প্রতিনিধি হিসেবে তাদের পাঠানো হয়েছিল বিভিন্ন দেশে। পাঠিয়েছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। যেন বাকি দুনিয়াকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলা যে, 'দেখো দুনিয়া, আমরা এমন এক নরাধম পাপিষ্ঠ জাতি যে আমরা শুধু জাতির জনককে হত্যা করেই ক্ষান্ত হইনি, পিতৃহন্তাকারীদের পরম সম্মানে ও মর্যাদায় রাষ্ট্রের প্রতিনিধি বানিয়ে ভিনদেশে পাঠাবার চরম নোংরা স্পর্ধা দেখিয়েছি, জাতি হিসেবে আমরা আসলে এতটাই নির্লজ্জ!'

কিন্তু আমাদের নির্লজ্জতার যে তখনো বাকি ছিল! জাতির জনককে সপরিবারে খুন করা হয়েছে, দেশ চলছে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত উগ্র ধর্মান্ধ পাকিস্তানী প্রেসক্রিপশনে, খুনিরা সসম্মানে বিশেষ মর্যাদায় নিরাপদে আছে, কিন্তু অবস্থা তো সবসময় এমন নাও থাকতে পারে, তাই না? হঠাৎ করেই দৃশ্যপট পাল্টে যেতে পারে। তখন যদি কেউ বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি তোলে? কেউ যদি বিচারে আগ্রহ দেখায়? উদ্যোগ নেয়? তাই তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান কোনধরনের ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা রাখা এবং খুনিদের সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে নিরাপদে রাখবার এই পুরো ঘটনা নিশ্চিন্ত রাখতে ১৯৭৯ সালে তিনি ছিয়াত্তরে মুশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন করে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করেন। অর্থাৎ যে মানুষটি জীবন-যৌবন সব বিলিয়ে দিয়ে, সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি এনে দিলেন, তার প্রিয় সে দেশের মাটিতে তারই হত্যার বিচার আইন করে বন্ধ করা হলো। ভাবতেও অবিশ্বাস্য লাগছে, তাই না?

কিন্তু সত্য কল্পনার চেয়েও বিস্ময়কর। সেই খুনিদের কথা মনে আছে? যারা জিয়াউর রহমানের আশীর্বাদে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে দেশের প্রতিনিধি হিসেবে সম্মানজনক চাকরি পেয়েছিল? জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে মেজর জেনারেল হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেবার পর সেই আত্মস্বীকৃত খুনির দলের বেশ ক’জন দেশে ফেরে এবং তৎকালীন এরশাদ সরকারের প্রশ্রয়ে ফ্রিডম পার্টি নামে একটা রাজনৈতিক দল তৈরি করে এই দেশে রাজনীতি শুরু করে। এবার তথ্যগুলো আরেকবার ভাবুন। সরকার পরিবর্তনে এই খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরে থাক, উল্টো এদের দেশে এসে সাদরে রাজনৈতিক দল খুলে রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল এবং এরা একটা নির্বাচনে অংশও নিয়েছিল। অর্থাৎ জাতির জনকের খুনির দল এই দেশে প্রকাশ্যে রাজনীতি করবে, নির্বাচনে অংশ নেবে, ক্ষমতায় যাবে এতে এই দেশের আপামর জনসাধারণের কোন সমস্যা ছিল না, তাদের রক্ত গরম হয়ে ওঠেনি, তারা খুব সহজেই এসব ঘটতে দিয়েছে। অথচ এই জনগণের মুক্তির জন্য, তাদের স্বাধীনতার জন্যই শেখ মুজিব তার জীবনের ১৪ বছরেরও বেশি সময় জেল থেকে জেলে কাটিয়েছেন, জেল থেকে সরাসরি রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামে গেছেন, আবার রাজপথ থেকে জেলে এসেছেন, সারাটা জীবনই উৎসর্গ করেছেন তার সন্তানসম জনগণের মুক্তির জন্য। সেই শেখ মুজিব, সেই জাতির জনককে মেরে ফেলা হলো, তার বিচারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো, তার বিচার করা যাবে না এহেন আইন তৈরি করে সেটা সংবিধানের অংশে পরিণত করা হলো, খুনিদের বিশ্বের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরির নামে পুরষ্কৃত করা হলো, তাদের দেশে ফিরে প্রকাশ্যে রাজনীতি করবার এবং নির্বাচনে অংশ নেবারও সুযোগ দেয়া হলো, তাতে বঙ্গবন্ধুর সেই সন্তানসম জনগণের কিচ্ছু আসে যায় নি, সারা দেশে আগুন ধরে যায়নি, সবাই খুব সহজেই মেনে নিয়েছে সবকিছু।

এভাবেই চলেছে দীর্ঘ ২১ বছর। এই আত্মবিধ্বংসী, আত্মবঞ্চনাকারী বেইমান জাতি তার জনকের আত্মস্বীকৃত খুনিদের আস্ফালন নীরবে চলতে দিয়েছে দীর্ঘ ২১ বছর। পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সংসদে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অ্যাক্ট’বাতিল করে হত্যাকাণ্ডটির বিচারের পথ তৈরি করা হয়। যে জনগণের জন্য শেখ হাসিনা তার বাবাকে জীবন উৎসর্গ করতে দেখেছেন, সেই জনগণ তার বাবার, তাদের জাতির জনকের পুরো পরিবারসহ নির্মমতম হত্যাকান্ডের বিচার নিশ্চিতে সামান্য ভূমিকা তো দূরে থাক, বরং হত্যাকারীদের পুরষ্কৃত হতে দিয়েছে নির্দ্বিধায়, প্রবল বিস্ময়ে আর বেদনায় সেই বাস্তবতা মেনে নিয়েই ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতির জনকের বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর উদ্যোগ নেন তিনি।

ওই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির সেই বাড়ির রিসেপনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ আ ফ ম মহিতুল ইসলাম (মৃত্যু: ২৫ অগাস্ট, ২০১৬) ঢাকার ধানমণ্ডি থানায় হত্যা মামলা (১০(১০)৯৬) দায়ের করেন। তিন মাসের বেশি সময় ধরে তদন্তের সিআইডির সে সময়কার সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল কাহহার আকন্দ ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি ১৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। তদন্তে বঙ্গবন্ধু হত্যায় সাবেক রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদসহ চারজনের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও আগেই তারা মারা যাওয়ায় অভিযোগপত্রে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

১৫ অগাস্টের পর যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যাওয়া খুনি ফারুক-রশিদ হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে ১৯৭৬ সালে যে টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ধারণ করা সেই সাক্ষাৎকারের ভিডিওসহ ৪৬ ধরনের আলামত অভিযোগপত্রের সঙ্গে আদালতে জমা দেওয়া হয়। সাক্ষী করা হয় ৭৪ জনকে। ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তিন প্রধান আসামি লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে এবং একই বছরের ১২ মার্চ ছয় আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়। মামলার বিচারের ২০২ কার্যদিবসে মোট ৬১ জনের সাক্ষ্য নেয় আদালত। বিচারের সব প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল (মৃত্যু: ১১ ডিসেম্বর, ২০১৪) বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। ১৭১ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারক ১৮ আসামির মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। বাকিদের খালাসের রায় দেন তিনি। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিলে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাই কোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ বিভক্ত রায় দেয়। বিভক্ত রায় হওয়ায় নিয়মানুযায়ী মামলাটি তৃতীয় বেঞ্চে পাঠান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি। তৃতীয় বেঞ্চের রায়ে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে।

মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ১২ আসামি- সাবেক মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) ফারুক রহমান, কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, একেএম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আব্দুর রশিদ, মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিম, মেজর (অব.) নূর চৌধুরী, রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন খান, লে. কর্নেল (অব.) রাশেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল মাজেদ ও লে. কর্নেল আজিজ পাশা (অব.)।

রায়ের আদেশে বলা হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর ৫টার দিকে ধানমণ্ডির নিজ বাসভবনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন ও অন্যদের ষড়যন্ত্র ও পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী গুলি করে হত্যা করার অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

রায়ে আরও বলা হয়, 'ঘটনার পর কোনো কোনো আসামি দেশ-বিদেশে নিজেদের আত্মস্বীকৃত খুনি হিসেবেও পরিচয় দিয়ে দাম্ভিকতা প্রকাশ করে। ঘটনাটি কেবল নৃশংস নয়, এই অপরাধ এমন একটি ক্ষতির কার্য যা শুধু ব্যক্তি বিশেষের জন্য নয়, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষেও এটা মারাত্মক ক্ষতি। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহ পরিণতির বিষয় স্বজ্ঞানে তারা ষড়যন্ত্রমূলক ও পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।'

'সুতরাং, তাদের প্রতি কোনো প্রকার সহানুভূতি ও অনুকম্পা প্রদর্শনের যুক্তি নেই। এই অনুকম্পা পাওয়ার কোনো যোগ্যতাও তাদের নেই। তাদের অপরাধের জন্য তাদের প্রত্যেককে দণ্ডবিধি ৩০২/৩৪ ধারা মতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো।'

কিন্তু গল্প এখানেই শেষ না। ২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে সেই বিচার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। যেখানে হাইকোর্ট থেকে রায় চলে এসেছে, মামলার আনুষ্ঠানিকতাও আর খুব বেশি বাকি নেই, সেখানে দীর্ঘ ৬ বছর আপিল বিভাগের সাতজন বিচারক মামলার শুনানিতে বিব্রতবোধ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানিতে উচ্চ আদালতের বিচারকরা বিব্রতবোধ করবেন- এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। তারা তো শপথ নিয়েই চেয়ারে বসেন। কিন্তু যেহেতু ক্ষমতায় জিয়াউর রহমানের উত্তরসূরী এবং আলবদরের দল ছিল, সুতরাং বিচারকেরাও জোট সরকারের কাছে মাথানত করে জাতির জনকের হত্যার বিচারকার্য থেকে নিজেদের বিরত রাখেন। একটা জাতি তার শেকড় অব্দি ঠিক কতখানি নির্লজ্জ বেইমানে পরিণত হলে ন্যায়-অন্যায়ের বিচার করার দায়িত্ব অর্পিত হওয়া বিচারকেরা পর্যন্ত জাতির জনকের সপরিবারে হত্যার বিচারে বিব্রত বোধ করেন, সেটাই বলাই বাহুল্য।

অবশেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামি হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসবার পর ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ হাই কোর্টের রায় বহাল রেখে পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করে দেয়। এরপর ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বজলুল হুদা, ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, একেএম মহিউদ্দিন ও মহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। বজলুল হুদাকে থাইল্যান্ড ও মহিউদ্দিন আহমেদকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা হয়।

তৎকালীন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক সেই সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে জানিয়েছেন, 'কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে এবং রাস্তায় ক্যামেরাসহ বহুসংখ্যক সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। অসংখ্য উৎসুক জনতাও ভিড় করেছিল। কেউ যেন সীমানা অতিক্রম করে বেষ্টনীর ভেতরে আসতে না পারে, সেজন্য বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও র‌্যাব সদস্য মোতায়েন ছিল। রাত ১২টার সময় খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান এবং সুলতান শাহরিয়ার রশিদকে হাতকড়া এবং কালো জমটুপি পরিয়ে ফাঁসির মঞ্চের কাছে নিয়ে আসা হয়। জল্লাদরা তাদের ফাঁসির মঞ্চে উঠাল। চতুর্দিকে পিনপতন নীরবতা। কোনো শব্দ নেই। ফাঁসির আসামিরাও নীরবে হেঁটে হেঁটে মঞ্চের কাছে গিয়েছিল। তারা কোনো কথাই বলেনি। দুটি ফাঁসির মঞ্চ পাশাপাশি ছিল। দু’জন জল্লাদ দুই ফাঁসির মঞ্চে ছিল। তারা আসামিদের গলায় ফাঁসির রশি পরিয়ে অপেক্ষা করছিল। অন্য দুই জল্লাদ আসামিদের পায়ের নিচের কাঠ সরিয়ে নেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। রাত ০০.০৫ মিনিটে সিনিয়র জেল সুপার তৌহিদুল ইসলাম তার হাতে থাকা একটি রুমাল মাটিতে ফেলে দিয়ে জল্লাদদের সিগন্যাল দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে জল্লাদদ্বয় দুই ফাঁসির আসামির পায়ের পাটাতন লিভারের মাধ্যমে টান দিয়ে সরিয়ে নিল। তাৎক্ষণিক আসামিরা নিচে পড়ে গেল এবং গলায় ফাঁস লেগে তাদের মৃত্যু হল। কিছুক্ষণ ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর মৃতদেহ ফাঁসির মঞ্চ থেকে নিচে নামানো হল। দ্বিতীয় ধাপে একেএম মহিউদ্দিন ও বজলুল হুদাকে ফাঁসির মঞ্চে আনা হল। তাদের ফাঁসি একই উপায়ে কার্যকর করা হল। সর্বশেষ লে. কর্নেল মহিউদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মহিউদ্দিন খুব কান্নাকাটি করছিল। প্রাণভিক্ষা চাচ্ছিল। ফাঁসির মঞ্চে উঠতে চায়নি। জোরপূর্বক তাকে ফাঁসির মঞ্চে উঠানো হয়েছিল। সিভিল সার্জন পোস্টমর্টেমের ব্যবস্থা করেন। পোস্টমর্টেম ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর কফিনে মৃতদেহ উঠিয়ে পুলিশের এস্কর্ট পার্টির কাছে হস্তান্তর করা হয়।'

ফাঁসি কার্যকরের পর শহীদুল হক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে খবরটা জানালেন। শুনে ভারী কন্ঠে শেখ হাসিনা তাকে বললেন, ‘সব দিকে খেয়াল রেখো। মৃতদেহগুলো ঠিকমতো পৌঁছে দিও।’

এই দেশে জাতির জনকের সন্তানদের পিতৃহত্যা, পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচার পেতে দীর্ঘ ৩৫ বছর লেগেছিল।

সৌজন্যেঃ সারাবাংলা

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত