ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন

5084

Published on জানুয়ারি 27, 2021
  • Details Image

'আপনার সন্তানরা বড় হয়ে কী হবে বলে আশা করছেন?' জবাবে তিনি বলেন, 'আমি চাই, এ মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠুক। এ-ই হলেন শেখ মুজিব। এ প্রশ্নের জবাবে জীবনের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খানিকটা ফুটে ওঠে। তাদের ক্যারিয়ার তিনি বললেন, ওরা যে যার ক্যারিয়ার নিজেদের পছন্দমতো বেছে নেবে। আমি তার মধ্যে নাক গলাতে চাই না। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি একজন অমায়িক, বিনয়ী ও সুবিবেচক মানুষ। তাঁর আচরণ অত্যন্ত আন্তরিক। তাঁর সর্বদা সৌম্য মুখখানা সহজেই উদার হাসিতে ভরে যায়। তাঁর রসবোধ তাঁকে জীবনের যত যন্ত্রণা ও মামলা-মোকদ্দমা থেকে রক্ষা করেছে। তার যে জিনিসটি সবচেয়ে অবাক করে তা হলো দুর্দান্ত আত্মবিশ্বাস। একবার যদি মনস্থির করেন যে তিনি ঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছেন, পথে যতই বাধাবিপত্তি আসুক না কেন সব ঠেলে এগিয়ে যান সামনে। ভিড়ের মধ্যে সহজেই তিনি নজর কেড়ে নেন। যেখানেই থাকুন, সহজেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষক হয়ে ওঠেন। তরুণকালের লম্বা, রোগা শরীরটি থেকে তাঁর রূপান্তর ঘটে এক দারুণ ব্যক্তিত্বময় নেতায়।

তিনি যখন জনতার মাঝে দাড়িয়ে তাদের উদ্দেশে প্রবল ও শক্তিশালী কণ্ঠে সরকারের নির্বুদ্ধিতা নিয়ে ভাষণ দেন, তখনো আসল মানুষটিকে ঠিক চেনা যায়। না। কাছাকাছি এলে বোঝা যায়, ইনি আচরণে কতটা আন্তরিক, ঘরোয়া ও সংবেদনশীল, যার মুখে প্রায়ই ফুটে থাকে হাসি। তবে তাকে কেউ বোকা বানাতে পারতেন না। তিনি নতুন নতুন আইডিয়া পছন্দ করলেও আগের আইডিয়াগুলো ভালোভাবে নেড়েচেড়ে না দেখে তা বাতিল করেন না।

শেখ মুজিবের জীবনযাপন কৃচ্ছসাধনের এক অতি সাধারণ জীবন। আরাম- আয়েশ, ভোগবিলাস ইত্যাদির প্রতি তার কোনো মোহ নেই বলেই তিনি সফল। বাড়ি, টাকা, আরাম-আয়েশ ইত্যাদির প্রতি এ ঔদাসীন্য তাঁর প্রতি লোকের শ্রদ্ধা ও সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছে বহু গুণ । জীবনের প্রতি তাঁর পদক্ষেপ সাধারণের চেয়ে দ্রুত ও প্রবল।

যেসব মানুষ শেখ মুজিবের সান্নিধ্যে আসে তাদের মধ্যে তিনি ছড়িয়ে দেন নিজের প্রবল ব্যক্তিত্বের কারিশমা। তিনি মঞ্চে বক্তৃতা করার সময় স্পষ্ট, সরল ভাষায় ভাষণ দেন এবং তাতে মাঝে মাঝেই মজার মজার টীকা-টীল্পনী যুক্ত করেন। মানুষকে এই যে সংবেদনশীল এবং কুশলী হাতে সামলানোর ক্ষমতা, এটি তাঁর জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতাকে আরো বৃদ্ধি করেছে। তাঁর মাঝে একগুয়ে ও প্রচণ্ড তেজস্বী যে ভাবটি রয়েছে তা খুবই বিরল। একদা ডি ভ্যালেরা সম্পর্কে লয়েড জর্জ বলেছিলেন, উনি যেন চামচ দিয়ে পারদ তুলবার মতো একজন। শেখ মুজিবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে এরকমই জিদ্দি ও স্পর্ধিত একটি ব্যাপার রয়েছে।

একগুঁয়ে স্বভাবের হলেও তিনি কিন্তু ক্ষমাশীল একজন মানুষ। তার ভেতরে জেদ ও ক্ষমতার এক আশ্চর্য মিশেল রয়েছে, যার সাহায্যে তিনি যে-কোনো সমস্যা পড়ে যান। তিনি মানুষকে ক্ষমা করেন এবং তাদের অপরাধের কথা ভুলেও যান। যেসব সাবেক রাজনীতিবিদ তাঁর সম্পর্কে কুৎসা রটিয়েছেন এদের বিরুদ্ধে কিন্তু তার কোনো প্রতিহিংসা নেই। কিংবা তিনি এদের অমঙ্গল কামনাও করেন না।

আওয়ামী লীগের এক সহসভাপতি ভেবেছিলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিব শেষ হয়ে যাবেন এবং অন্তত ২০ বছর জেলের ঘানি তো তাকে টানতেই হবে। এই লোকটি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা রটালেও এখন আবার আওয়ামী লীগে ফিরে এসেছেন। ইদানীং আওয়ামী লীগ অফিসে যাতায়াতও শুরু করেছেন। মুজিব তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সময় মনে হলো তিনি বুঝি অতীতের কথা একদমই ভুলে বসে আছেন। যদিও এর আগে তিনি তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের আবেগতাড়িত হয়ে বলেছিলেন, 'এই লোকটিকে আমি আবার আওয়ামী লীগে অ্যালাউ করব না।

জন গুনথার বলেছিলেন জেলখানার এককিত্ব উপভোগ করতেন গান্ধীজি। তিনি ধ্যান করতেন এবং ঈশ্বরধ্যানে মগ্ন থাকতেন। শেখ মুজিবেরও কোনো রকম জেল ভীতি ছিল না। বলা চলে, এটি ছিল তাঁর দ্বিতীয় আবাস। একদিন তিনি একজনকে বলেই ফেলেছিলেন, 'কারাগার আমার আরেক বাড়ি। তবে কারাগারের জীবন তার জন্য খুব একটা সুখকর ছিল না। বাইরে অনেক কাজ পড়ে আছে বলে কারাগারে অন্তরীণ থাকাকে তিনি স্রেফ সময়ের অপচয় ভাবতেন। তাঁর মতে, "নির্জন কারাবাস সরকারের সবচেয়ে জঘন্য শাস্তি।' তাঁকে জেলঘুঘুও বলা যায়। পাকিস্তান সৃষ্টির পরে জেলখানায় তাকে নয় বছর আট মাস বন্দি থাকতে হয়েছে। যে-কোন পাকিস্তানি রাজনীতিবিদের জন্য এটি ছিল দীর্ঘতম কারাবাস।সরকার বদল হলেই তার প্রথম শিকার হতেন শেখ মুজিব। তাঁকে জেলে পোরা যেন সরকারের নৈমিত্তিক কাজে পরিণত হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারির পরে তাঁকে মওলানা ভাসানী ও আবুল মনসুরের সঙ্গে জেলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। প্রথম রাতটি তারা একত্রে কাটান এবং সারা রাত কথা বলেই পার করেছেন সময়। এটি ছিল একটি রাজনৈতিক গেট-টুগেদার। তারা রাজনীতি ও সামরিক শাসনের ভয়ানক পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করেন। পরদিন তাদের আলাদা সেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

শেখ মুজিবের মতো হাসিখুশি, সঙ্গলিলু মানুষের জন্য এটি ছিল নির্যাতনের সামিল। অন্যান্য অনেক রাজনীতিবিদের মতো তিনিও জেলখানায় থিতু হয়ে যান বই পড়ে, সবজি ও ফুলের বাগান করে। জেলের আরেকটি ওয়ার্ড থেকে একটি আমগাছের চারা সংগ্রহ করে তিনি সেটি নিজের সেলের পেছনের আঙিনায়। লাগিয়ে দেন। চারা রোপণ করার সময় তিনি জেল সুপারিনটেনডেন্টকে বলেছিলেন, 'আমি এ জেলখানা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই এই গাছের আম যেয়ে যেতে চাই।' রসিকতার ভঙ্গিতে কথাটি বলা হলেও তার বলার ঢঙে মনের শক্তি ও আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠেছিল তা জেল সুপারিনটেনডেন্টকে অভিভূত করে। শেখ মুজিব কেবল সাহসীই ছিলেন না, তাঁর আত্মাটি ছিল গ্র্যানাইট পাথরের মতো দৃঢ় ও শক্ত।

অতীতে যতবার তিনি জেলে গেছেন, পাঁচ সন্তানকে কোথায়, কার কাছে রেখে যাবেন তা নিয়ে সমস্যা হয়েছে। তবে ঢাকার ধানমন্ডিতে বাড়ি করার পরে পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাই হয়েছে ভেবে তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।আকদিন তিনি বলেন, 'সামরিক আইন জারির পরে আমার বন্ধুরাও আমাকে ঘর ভাড়া দিতে সাহস পায়নি।' এ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তাড়া করে ফিরেছে তাঁর স্ত্রীকে। সেই অনিশ্চিত, দুর্দশাময় দিনগুলোতে তাকে একের পর এক বাড়ি বদল করতে হয়েছে। ঢাকায় একটি স্থায়ী ঠিকানা হবার পর পরিবারের জন্য তাঁকে আর দুশ্চিন্তা করতে হয়নি। আপনজনদের কোন পীড়া না দিয়েই তিনি এখন যে-কোন ঝুঁকির মধ্যে ঝাপিয়ে পড়তে পারবেন।

তিনি ধানমন্ডির বাড়ির বৈঠকখানাটি কালেভদ্রে ব্যবহার করেন। যেকেউ সহজেই তাঁর সামনের বেডরুমে ঢুকে যেতে পারতেন। ওখানে তিনি পিঠ খাড়া চেয়ারে কিংবা বিছানার এক কোণে বসেন। দর্শনার্থী দেখলে মুখে অভ্যর্থনার হাসি ফুটিয়ে উঠে দাঁড়ান এবং হেঁটে গিয়ে তাকে স্বাগত জানান, তাঁকে আলিঙ্গন করে বসতে দেন চেয়ারে।

তিনি সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন। তবে শুধু ঐতিহাসিক ছবি। তিনি বলেন, 'আমি দুই-তিন বছরে একটি বা দুটির বেশি ছবি দেখার সুযোগ পাইনি। সম্প্রতি সামরিক আইন জারির পরে তিনি ঐতিহাসিক ছবি সিরাজউদ্দৌলা দেখেছেন। যদিও এই সিনেমাটি দেখার ইচ্ছে ছিল তাঁর দীর্ঘদিনের।

তাঁর কাছে তাঁর প্রিয় বইয়ের কথা জানতে চাই তিনি বলেন, "নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, বার্নার্ড শ, কেনেডি এবং মাও সে তুংয়ের লেখা আমার ভালো লাগে।' তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির মস্ত ভক্ত। কেনেডিকে মানুষ হিসেবে তাঁর খুব পছন্দ। কেনেডির একটি উদ্ধৃতি তাঁর বিশেষ পছন্দ, দেশ তোমাকে কী দিতে পারে তা জানতে চেয়ো না, বরং তুমি দেশের জন্য কী করতে পারবে নিজেকে সে প্রশ্ন করো।

তার পছন্দ-অপছন্দের তালিকাটি বেশ বিস্তৃত ও পরিশীলিত। তবে জেলায় জেলায় বক্তৃতা প্রদান কিংবা দর্শনার্থীদের সময় দিতে হয় বলে বই পাঠের সময় তিনি খুব কমই পান।তার বাড়ির লাইব্রেরিতে দুই আলমারি বোঝাই শুধু বই- চার্চিল, কার্ল মার্কস থেকে শুরু করে বাংলার ইতিহাস, ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের ইতিহাসসহ কেনেডি ও বারট্রান্ড রাসেলেরও প্রচুর বই রয়েছে।

ইসলাম ধর্মের প্রতি রয়েছে তার গভীর শ্রদ্ধা ও আস্থা। তিনি বলেন, 'আমি একজন মুসলমান। এ কথার মাধ্যমে তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয় আত্মবিশ্বাস এবং মনের অভ্যন্তরীণ বিশ্বাস। মূলের প্রতি কারো গভীর বিশ্বাস থাকলেই কেবল এটি সম্ভব।তিনি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের চেয়ে বরং ইসলামের মৌলিকত্বে গভীর বিশ্বাসী। তিনি ভীত এ কথা ভেবে যে বছরের পর বছর ধরে প্রচলিত আচার অনুষ্ঠানগুলো নবীজির ইসলামকে এমনভাবে ঘিরে ফেলেছে, যা মুসলমানদের ভুলপথে চালিত করতে পারে ।

তিনি প্রসঙ্গত একবার বলেন, আমার স্ত্রী বড্ড বেশি মিতব্যয়ী ও সাবধানি, তিনি সব সময় দুর্দিনের জন্য প্রস্তুত থাকেন। তারপর যোগ করেন, সংসার নামের রণাঙ্গনটি চালানোর সমস্ত কর্তৃত্ আমি তাঁকে দিয়েছি। তার চোখে ফুটে ওঠে কৌতুক, 'আমি যেমন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন চাই তেমনি গৃহপ্রশাসন চালাতে আমার স্ত্রীকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিয়ে দিয়েছি।তার স্ত্রী প্রসন্ন মেজাজের এক মহীয়সী নারী। একজন বাঙালি মায়ের সমস্ত গুণই তার মাঝে বিদ্যমান। তিনি কোমল, স্নেহময়ী ও দয়াবতী। তিনি দরিদ্র ও অভাবী মানুষদের দিল খুলে সাহায্য করেন। এই মহীয়সী নারীটির রসবোধও প্রবল। সামরিক শাসন জারির কয়েক দিন পরে তিনি মন্তব্য করেন, মার্শাল ল হয়ে ভালাই হয়েছে। আমি এখন ওনার সঙ্গে একটু কথা বলার সুযোগ পাই। নইলে তো উনি সারাক্ষণই দর্শনার্থী দ্বারা ঘিরে থাকেন। তারা রাত ১২টা পর্যন্ত তার সঙ্গে থাকে, আবার ভোর হতেই তার কাছে চলে আসে।'আর্থিক দুঃসময়ে তিনি স্বামীকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। দুর্দশা ও ভোগান্তির সময়ে সর্বদা তার পাশে এসে দাড়িয়েছেন। শেখ মুজিব যখন-তখন বিপদ ও ঝুঁকির মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছেন কারণ তিনি জানতেন তাঁর স্ত্রী দুশ্চিন্তা বা উৎকণ্ঠায় কাবু হবেন না। মুজিবের আত্মত্যাগের পেছনে তার স্ত্রীর আত্মত্যাগও কম নয়, যিনি বছরের পর বছর দুঃখ-কষ্ট-ক্লেশ সয়ে গেছেন। মুজিব জেলে গেলে তিনি জানেন না, কবে তার স্বামী জেল থেকে ছাড়া পাবেন। স্বামীর চিন্তা এবং তাঁর কর্মকাণ্ডের প্রতি বিশ্বাসই ছিল মহীয়সী এ নারীর শক্তির একমাত্র উৎস।

শেখ মুজিব তাঁর স্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। জেলে গেলে মুজিব দুশ্চন্তাগ্রস্ত নন, কারণ তিনি জানেন, ছেলেমেয়েদের নিরাপদ হাতে রেখে যাচ্ছেন। তিনি ভাবেন, তাঁর স্ত্রী একজন স্নেহশীলা ও দয়াময়ী নারী। তবে যে ব্যাপারটি তাঁকে সবচেয়ে আকর্ষণ করে তা হলো তিনি অত্যন্ত সাহসী।' অতীতে পুলিশ এসে যখন তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য জেলে পুরে দিত, তাঁর স্ত্রী কখনো চোখের পানি ফেলতেন না এবং ভেঙে পড়ার কোন চিহ্নও দেখতেন না। তিনি কি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় কান্নাকাটি করেছিলেন? মুজিব বলেন, কান্নাকাটি করে আমি জানি না। হয়তো আমার আড়ালে কেঁদেছেন। আমি ঠিক বলতে পারব না।

শেখ মুজিব তার এক চাচার দুই মেয়ের একজনকে বিয়ে করেন। এরকম একজন জীবনসঙ্গিনী পেয়েছেন বলে তিনি নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। মুজিবের। পিতা-মাতা এ বিয়ের আয়োজন করেন। তাদের বিয়েটি ছিল অত্যন্ত সফল এবং পাত্র-পাত্রী হিসেবে দুজনেই ছিলেন উপযুক্ত।দৃশ্যত দুজনকে মনে হয় আলাদা। মিসেস মুজিব মৃদুভাষী, চুপচাপ আর শেষ মুজিব তাঁর উল্টো। তিনি অত্যন্ত উষ্ণ, বন্ধুপরায়ণ এবং ঝুঁকি নিয়ে চলাফেরাই তাঁর পছন্দ। তবু তারা সাহস ও জনদরদি চেতনায় একই বন্ধনে গ্রন্থিত।

১৯৬৬ সালে জেলে যাওয়ার আগে মুজিব তার ১৮ বছরের বড় মেয়ে সম্পর্কে বলেছিলেন, 'ভালো কোন পাত্র পেলে হাসিনার বিয়ে দিয়ে দিয়ো। আমার অপেক্ষা কোরো না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরুর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হাসিনার বিয়ে হয়ে যায় পদার্থবিদ্যায় ডক্টরেট ডিগ্রিধারী ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে। কুর্মিটোলা থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে মুজিব প্রথম তার জামাইকে দেখেন। পিতার আকস্মিক মুক্তিতে হাসিনা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। শেখ মুজিব এগিয়ে এসে প্রিয় কন্যাকে জড়িয়ে ধরেন। ১৯৬৭ সালে ইডেন কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি ছিলেন হাসিনা।

তিন দিনের মধ্যে বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে যায় এবং কুর্মিটোলার জেল থেকেই মুজিব বিয়েতে অনুমতি দিলে তাদের বিয়ে হয়ে যায়।বর রংপুরের ছেলে, কাজ করেন ঢাকার আণবিক শক্তি কমিশনে। বিয়ের সময় হাসিনার বয়স ছিল ২২, বাংলা অনার্সের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তিনি বিয়ের পরে ইতালি চলে যান স্বামীর সঙ্গে। ওখানে ওয়াজেদ মিয়া উচ্চতর শিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন। শেখ মুজিবের তিন ছেলে। বয়স যথাক্রমে ২০, ১৬ ও ৪ বছর। দুটি মেয়ে- ২২ ও ১৪ বছর বয়স।

শক্তিশালী মনের এই মানুষটি বাস্তবতা বেশ ভালো বোঝেন এবং তিনি বেশ নাছোড়বান্দাও বটে। ব্যক্তিজীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি উদাসীন। অত্যন্ত কঠোরভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণ করেন, জীবনে মদ স্পর্শ করেননি। শুধু মাঝেমধ্যে প্রিয় পাইপ দিয়ে ধূমপান করেন। তিনি ভদ্র, নম্র, যুক্তিবাদী, ধৈর্যশীল এবং বিস্ফোরক একজন বাঙালির মধ্যে এ ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সম্মিলন সত্যি বিরল।
দলীয় কর্মীরা তাকে অত্যন্ত সম্মান ও বিনয় নিয়ে 'মুজিব ভাই সম্বাধন করে। ফজলুল হক তাকে নাতি বলে ডাকতেন আর সোহরাওয়ার্দী তাকে নিজের সন্তানের মতো আদর করতেন। একজন মার্কিন সাংবাদিকের কাছে তিনি বলেছেন, 'আমি আমার দলের মানুষদের কাছে শেখ মুজিবুর রহমান নই। আমি শ্রেফ মুজিব ভাই।

পরিবার, জনগণ ও রাজনীতির বাইরে মুজিবের আরেকটি ভালোবাসার জায়গা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চল । তিনি একবার তার এক বন্ধুকে বলেছিলেন, আমার যদি গ্রামের রাস্তার ধারে একটি বাড়ি থাকত। তাহলে রাজনীতি থেকে কিছুদিনের জন্য দূরে থেকে সবুজ প্রকৃতি দেখতাম মন ভরে।জীবন ও রাজনীতির প্রতি ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন একজন নিয়তিবাদী। এক নির্বাচনী প্রচারণায় যাওয়ার সময় তিনি বলেন, শেষতক। সকলেরই দরকার হবে কয়েক হাত জমি।''আপনি কি মৃত্যুর কথা মাঝে মাঝে চিন্তা করেন? জিগ্যেস করলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন 'আমি সব সময়ই মৃত্যুর কথা ভাবি’

খাওয়াদাওয়া নিয়ে কোন খুঁতখুতি নেই শেখ মুজিবের।প্রিয় খাবার সম্পর্কে তিনি বলেন 'আমি কিন্তু সাদা ভাত, ডাল আর আলু ভর্তা খেতে সবচেয়ে পছন্দ করি। মাছের ঝোলও তার বেশ পছন্দ। পান তিনি খুব একটা খান না। তবে কেউ খেতে দিলে মানাও করেন না। আড্ডায় বসলে এবং পাশে পানের সরঞ্জাম থাকলে এক বৈঠকে তিনি অনেকগুলো পান খেতে পারেন।
আমি শেখ মুজিবের এক ভাতিজা ১৯৪৪ সালের গ্র্যাজুয়েট, সরকারের একটি নিম্নপদে চাকরি করত ।তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, তুমি তো তোমার চাচা শেখ মুজিবকে বলে এর চেয়ে ভালো চাকরি পেতে পারো। সে অভিযোগের সুরে বলল, 'তিনি নিজের সুনাম নিয়ে খুব ভাবেন। কোন আত্মীয়স্বজনকে তিনি সাহায্য করবেন না। আসলে আমি তার কাছে কোন দিন কোন সাহায্য চাইতে যাইনি। জানি, সাহায্য করবেন না। তাঁর কাছে কেনই-বা যাব? তিনি মনে করেন, আত্মীয়স্বজনকে সাহায্য করলে তার সুনাম ক্ষুন্ন হবে।

নিঃসন্দেহে এটি একটি গুণ- এক দুর্লভ গুণ। জানি না আমাদের দেশের মানুষজন শেখ মুজিবের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটির কথা জানেন কি না।

শেখ মুজিব সম্পর্কে অনেক গল্প-কাহিনি আছে। তবে ওসব দিয়ে কিংবদন্তি সৃষ্টি করা যায় না। তাঁর সম্পর্কে যা শোনা যায় তা অবাস্তব কিংবা বিভ্রান্তিমূলক। জনসভায় তার বক্তৃতাগুলো লক্ষ করুন। তিনি অসাধারণ রকম বলিষ্ঠ এবং অকপট একজন মানুষ- এ গুণ তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন বলে দাবি করেন।

সরাসরি এবং অপ্রত্যাশিতভাবে কথা বলার ক্ষেত্রে তাকে একটি প্রতিভাই বলা চলে। গোলটেবিল বৈঠক থেকে ফিরে তিনি যখন সেই রাজনীতিবিদদের নাম ধরে বলেন, যারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থে কথা বলেন, তখন অবাক হওয়ার কিছু থাকে না। নেতাদের নাম ধরে কথা বলার কথা শুনলে অনেকেই ভয়ে সিটিয়ে যান গোলটেবিল বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থের পক্ষে যারা কথা বলেননি। সেই নেতাদের নাম ফাস করে লেয়ায় অনেকেই শেখ মুজিবের প্রশংসা করেছেন।

শেখ মুজিব বাস্তব উপলব্ধির ক্ষমতাসম্পন্ন একজন ব্যক্তি। বইপত্র পড়ে কিংবা বিমূর্ত কিছু থেকে তাঁর এ অন্তর্দৃষ্টি আসেনি, এসেছে বেকার যুবকদের হতযশা, কৃষকদের অসহায়ত্ব, তাদের সন্তানদের ক্ষুধা ও অসুস্থতা দেখে। বুদ্ধিবৃত্তির চেয়েও অন্তর্দৃষ্টি ছিল তাঁর প্রধান শক্তি।অলস, অদক্ষ ও আবেগনির্ভর আদর্শবাদীদের তিনি পছন্দ করেন না। এদের নির্বুদ্ধিতা তাঁকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। টেবিলে ঘুষি মেরে তিনি নিজের যুক্তিগুলোর সপক্ষে বক্তব্য দেন। তিনি তাঁর সহকর্মী, সেক্রেটারি কিংবা ভূত্যদের সঙ্গে চেঁচামেচি করলেও কিছুক্ষণ পরেই তা ভুলে যান। এ গুণটি তাঁর নেতা সোহরাওয়ার্দীর মাঝেও ছিল ।বিশ্বস্ততা ও কৃতজ্ঞতা দুটি ভাল রাজনৈতিক অস্ত্র, তিনি জানেন। তিনি তাঁর বন্ধুদের পরিত্যাগ করেন না। যত দূর সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করেন।

তিনি তা- ই।তাঁর জীবনের লক্ষ্য হলো মানুষের মঙ্গল করা। তিনি বলেন, 'আমি স্বায়ত্তশাসন দাবি করেছি পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানের জন্যই। আমার চোখে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের গরিব মানুষদের মধ্যে কোন প্রভেদ নেই।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তিলাভের পরে বঙ্গবন্ধু আগের চেয়ে অনেক বেশি খুশি হয়েছিলেন। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানিরা হয়তো পূর্ব পাকিস্তানিদের দুঃখ দুর্দশা বুঝতে পেরেছে। শেখ মুজিবকে ঘটনাপ্রবাহের নানান দিক আর অ এবং আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে।

গোলটেবিল বৈঠকে তাঁর সঙ্গে ছিল এমন এক তরুণ ব্যারিস্টারকে জিগ্যেস করা হয়েছিল, সে শেখ মুজিবকে প্রভাবিত করতে পেরেছিল কি না।সে জোর দিয়ে বলে, আরে না, ওনাকে প্রভাবিত করা যায় না। অসম্ন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ। তাঁর ব্যক্তিত্ব আমাদের মাঝে অদৃশ্য দেয়াল তুলে দাড়িয়েছিল।

পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত অহংকার এবং গর্ব বুকে ধারণ করেও তিনি কিন্তু হীনম্মনা এবং অন্তর্মুখী জাতীয়তাবাদী নন। আইয়ুব সরকার যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা-গান বাদ দিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক জীবন সংকুচিত করার চেষ্টা করেছিল, শেখ মুজিব তখন ঘোষণা করেছিলেন, 'রবীন্দ্রনাথ শুধু বাঙালি কবি নন, তিনি বিশ্বকবি। লোকে যেমন শেক্সপিয়র, অ্যারিস্টটল, কার্ল মার্কস পড়তে চায়, তেমনি তারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখাও পাঠ করতে চায়।

তিনি নিদারুণ সব দুর্দশায় পড়েছেন, তার পরও আশাবাদ ছাড়েননি। সব সময়েই অনুভব করেছেন, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নিয়তির একটি উপাদান। একবার তিনি আপনমনেই বলছিলেন, 'আমি ভেবেছিলাম আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় হয়তো আমার ২০ বছরের জেল হয়ে যাবে। মামলার বিষয়টি বিবেচনা করে যদি দণ্ড মওকুফ করাও হয়, আমি যখন জেল থেকে বেরিয়ে আসব তখন আমার বয়স হবে ৬৪। যদি তখনো আমার লোকদের শোষণ বন্ধ না হয় এবং আমার ছয় দফা অর্জিত না হয়, আমি এর জন্য লড়াই করে যাব।

বঙ্গবন্ধুর জীবন বিশ্লেষণ করলে শেখা যায় “সাহস সেরকম একটি জিনিস নয়, যা কোন মানুষ একটিমাত্র কাজ করেই অর্জন করতে পারে। সারা জীবন এই সাহসকে নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত