প্রধানমন্ত্রী’র শৈশবের অপেক্ষায় আমাদের গ্রামগুলো

2480

Published on জানুয়ারি 11, 2021
  • Details Image

সজল চৌধুরী:

বেশ অনেকদিন ধরেই টেকসই গ্রাম এবং শহর উন্নয়ন নিয়ে পত্র-পত্রিকা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ কিছু লেখালেখি এবং গবেষণার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এসব সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখতে পেলাম আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার টেকসই গ্রাম এবং নগর উন্নয়নের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ এবং সুদূর প্রসারী চিন্তাভাবনা রয়েছে। যা বাংলাদেশের গ্রাম এবং শহর গুলোর টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আমরা প্রতিনিয়তই লক্ষ্য করি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য এবং চিন্তাভাবনায় বাংলাদেশের গ্রামগুলো নিয়ে, সাধারণ মানুষের জীবন বোধ নিয়ে, প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদকে নিয়ে এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে থাকেন - যা শুধুমাত্র আমাদেরকে আন্দোলিত করে না বরং নতুন একটি চিরসবুজ বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়ার আশাকে আরও ত্বরান্বিত করে। শুধুমাত্র তাই নয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার অনেক দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত।

যেমন ধরা যাক বেশ কিছুদিন আগে লিখেছিলাম “আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও একটি ভ্যানযাত্রা”শিরোনামে একটি কলাম। লেখাটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হাস্যেজল মুখে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি ছবি - গোপালগঞ্জের কোন একটি রাস্তায় রিকশাভ্যানে চড়ে অতি সাধারন মানুষের মত গ্রামে ঘুরছেন, সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলছেন, খোঁজ খবর নিচ্ছেন - সঙ্গে তার পরম প্রিয় ছোট বোন শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও তার স্ত্রী সন্তানেরা। আবার অনেক সময় দেখা যায় হাতে ছিপ নিয়ে মাছ শিকার করছেন কিংবা রান্নাঘরে নিজ হাতে পরম মমতায় একজন সাধারণ বাঙালি মমতাময়ী মায়ের মত রান্না করছেন! এমন অনেক ছবি আমাদের মত সাধারণ মানুষকে অনেক আশার কথা বলে দিয়েছিল -আন্দোলিত করেছিল বৈকি!

লিখেছিলাম এমনটি এবারই প্রথম নয় তার ক্ষেত্রে, এর আগেও আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারন জীবন যাপনের উদাহরন সৃষ্টি করেছেন বহুবার! ছোটদের সাথে সময় কাটানো থেকে শুরু করে - হাসপাতালে ছুটে যান মুমূর্ষ কোন রোগীকে দেখতে কিংবা অন্যের দুঃখে যখন ব্যথিত হন - যা দেখলে আমার মতো বাংলার সাধারন মানুষ কিছু সময়ের জন্য হলেও বিমোহিত হয়, অনুপ্রাণিত হয়, আবেগি হয়। তাদের বুকে আঁশার সঞ্চার হয়, শুধুমাত্র এই ভেবে যে, তিনিও আমাদের মতো অতি সাধারন এ দেশেরই নাগরিক। আমাদের মতো তাদেরও সুঃখ দুঃখের অনুভূতি আছে। যেন উনারা আমাদের খুব কাছেই আছেন। আমাদের অতি পরম আপনজন। যিনি আমাদের কথা মন দিয়ে শোনেন সব সময়। চেষ্টা চালিয়ে যান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য। যাকে কিনা ভয়হীন ভাবে নিজেদের সমস্যা মোবাইলে মেসেজ দিয়েও জানাতে গ্রামের কোন সাধারণ মানুষ দ্বিধাবোধ করেন না। তিনি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মমতাময়ী দেশরত্ন শেখ হাসিনা।

তার লেখাগুলো পড়লে গ্রাম গুলোর প্রতি অন্য একটি ভালোবাসা বহিঃপ্রকাশ ঘটে। অতি সাধারণ একটি গ্রামের মধ্যে অনিন্দ্যসুন্দর বৈশিষ্ট্যগুলোকে তিনি দেখেছেন নিবিড় ভাবে। মানুষকে করে তুলেছেন আবেগি আর গ্রামগুলো হয়েছে মমতা দিয়ে ঘেরা। তিনি ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ লেখায় বলেছেন বাইগার নদীর তীর ঘেঁষে ছবির মতো সাজানো সুন্দর একটি গ্রামের কথা। সেই গ্রামের নাম টুঙ্গিপাড়া। যে নদীটি এঁকে বেঁকে গিয়ে মিশেছে মধুমতি নদীতে। এই মধুমতি নদীর অসংখ্য শাখা নদীর একটি নদী বাইগার। কি এক অপূর্ব সবুজ সমারোহ নদীর দুপারে! তার ভাষায়-

“…নদীর দু'পাড়ে তাল, তমাল, হিজল গাছের সবুজ সমারোহ। ভাটিয়ালি গানের সুর ভেসে আসে হাল ধরা মাঝির কণ্ঠে থেকে। পাখির গান আর নদীর কলকল ধ্বনি এক অপূর্ব মনোরম পরিবেশ গড়ে তোলে…।“

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর এই গ্রামোন্নয়নের ভাবনাকে অত্যন্ত বড় করে দেখছেন। তার এই দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। যেমনটি স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশের গ্রামগুলো উন্নয়নের লক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর তার সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নতুন একটি মাত্রা যোগ করেছেন গ্রাম উন্নয়ন কে কেন্দ্র করে। তিনি শুধুমাত্র গ্রাম উন্নয়নের ধারণাকে দেশের মধ্যেই সীমিত রাখতে চাননি। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইসতেহার থেকে শুরু করে গ্রাম উন্নয়নের দর্শনকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তিনি তুলে ধরার জন্য সদা সচেষ্ট। বঙ্গবন্ধু যেমন দেখেছিলেন গ্রাম নির্ভর প্রকৃত শিক্ষা এবং উন্নয়ন যদি না হয় তাহলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন হবে না বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গ্রাম উন্নয়ন এর সাথে গ্রামের মানুষদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন সর্বাত্মকভাবে । স্বপ্ন দেখছেন বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষকে নিয়ে নতুন একটি অর্থনৈতিক শিল্প চেতনায়।

গ্রামে তার ঘুরে বেড়ানো, গ্রাম নিয়ে তার ভাবনা আর শৈশব স্মৃতি গুলো আমাদের আন্দোলিত করে, যা আমরা পাই তার লেখার মধ্যে। “স্মৃতির দখিন দুয়ার - দুই প্রবন্ধে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তার শৈশবের গ্রাম বাংলার ছবি। তিনি বলেছেন টুঙ্গিপাড়ার পাশ দিয়ে কুল কুল ছন্দে ঢেউ তুলে বয়ে চলা নদীটির কথা। যদি কখনো দিনের আলোয় রোদ ছড়ায় কিংবা তারা ঝরা কোন এক রাতে সেই নদীর পানি তার ভাষায় ছিল রুপোর মতো চকচকে। আজও যখন আমরা কোন এক তারা ঝরা মধ্যরাতে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা সৌতসীনি কোন নদীর পাশে দাড়িয়ে থাকি ঠিক যেন সেই মায়াময় দৃশ্যই আমাদের চোখে ধরা দেবে। নদীর পাড় ঘেঁষে কাশঁবন, আখের ক্ষেত, সারি সারি খেঁজুর গাছ, বাশবাগানের ঝার, কিংবা বুনো লতা পাতার জংলা সবকিছুই যেন ছিল তার চিন্তায় চিরচেনা শৈশবে। এমন করে খুব আবেগ দিয়ে তিনি যেন গ্রামকে একেছেন কোন এক অচেনা শিল্পীর চিরচেনা রং তুলিতে। সেখানে খেলা করে শালিক - চড়ই, ক্লান্ত দুপুরে ঘুঘূর কুঁহ কুঁহ ডাক তাকে ফেলে দিত এক নিমগ্নে। তাইতো তিনি গ্রামকে ভালোবেসে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন “আমার জীবনের শেষ দিনগুলো আমি টুঙ্গিপাড়ায় স্থায়ী ভাবে কাঁটাতে চাই। খুব ইচ্ছে আছে নদীর ধারে একটি ঘর তৈরী করার ।” যদিও জানা নেই সেই ঘরের স্বরুপ কেমন হবে - তবে তার লেখার মধ্যে দিয়ে তারও কিছুটা আঁভাস পাওয়া যায়, সেই ঘর হবে খুব সাধারন, থাকবে মাটির দেওয়াল, বাঁশ-লতা দিয়ে মোড়ানো - ছোট্র একটি উঠোন, সামনে বয়ে যাবে ¯ নদী। এখানে এটা উল্লেখ্য যে, তাদের পূর্বপুরুষ যখন টুঙ্গিপাড়াতে জমি জমা ক্রয় করেন তখন সেখানে কলকাতা থেকে কারিগর এবং মিস্ত্রী নিয়ে সেখানে দালান তৈরী করেন, যা পরবর্তীতে পাক হানাদার আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। যার ধ্বংসাবশেষ এখনও কালের স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে। তার ভাষায়-

“… এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই দালানের ধ্বংসাবশেষ। একাত্তরে যে দুটো দালানে বসতি ছিল পাকিস্তানী হানাদার আগুন দিয়েছে দুটোই জ্বালিয়ে দেয়। এই দালানকোঠায় বসবাস শুরু হবার পর থেকে ধীরে ধীরে বংশবৃদ্ধি হতে থাকে আর আশেপাশে বসতির সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। এই দালানের উত্তর-পূর্ব কোণে টিনের দোচালা ঘর তোলেন আমার দাদার বাবা শেখ আব্দুল হামিদ। আমার দাদা শেখ লুৎফর রহমান এই বাড়িতেই সংসার গড়ে তোলেন। আর এখানেই জন্ম নেন আমার আব্বা ১৯২০ সালের ১৭ ই মার্চ।…”

প্রধানমন্ত্রীর কাছে ছেলেবেলা ছিল অত্যন্ত মধুর তার সবটুকুই যেন গ্রামের স্মৃতি। গ্রামের পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, ধুঁলোমাখা মেঠোপথে ধুঁলো মেখে বাড়ি ফিরে বকুনি খাওয়া কিংবা কোন কোন সময় বাবুই আর চড়ই পাখির বাসা তৈরীর কারসাজি দেখে দিন কাটতো! শৈশবের তার সমস্ত স্মৃতি জুড়েই রয়েছে গ্রামের সহজ-সরল প্রকৃতি আর পরিবেশ। আলোছায়ার খেলা। পাখিদের সাথে মিলেমিশে কাটানো শৈশব, তাদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ যেন বারে বারে উঠে আসে তার কথায়, তার লেখায়। গ্রামের সহজ সরল মানুষদের জীবন তাকে ভাবতে শিখাতো নিবিড় ভাবে। সেই সময় গ্রামের ঘরবাড়ি গুলো ছিল সব কিছুর আঁধার। দুধ, ছানা, মাখন ঘরেই তৈরী হতো। বাগানের ফল আর পুকুরের তাজা মাছ ছিল রোজকার বিষয়। গ্রামের কথা বলতেই যেন এগুলোই আমাদের মনে ভেসে আসে। কাচারি ঘরের ব্যাবহার ছিল তাদের জীবনযাত্রার সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে। গ্রামের বড় বড় সবুজ মাঠে ঘুরে বেড়ানো আর বন্ধুদের সাথে নিয়ে খেলায় মত্ত হওয়া এ যেন জীবনের সাথে একই সুত্রে গাঁথা ছিল। এমনকি ফড়িং এর পেছন পেছন দৌড়ানো আর ঝরে পড়া পাতা গুলোকে কুড়িয়ে কোথাও - কোন বারান্দায় গুছিয়ে রাখার স্মৃতিগুলো ছিল বড়ই আদরের। আর এভাবেই গ্রামের সাথে নিজেকে মিলিয়ে সবুজ বাংলার গ্রামের ছবি এঁেকছেন তিনি। তার আব্বার স্কুলে যাওয়া থেকে শুরু করে গ্রামের-ফুটবল-খেলা, সকলের সাথে মিলেমিশে থাকা, ছোটবেলার গল্প - সবকিছুই যেন গ্রামের সাথে একাকার হয়ে রয়েছে যা তার লেখার মধ্যে ফুটে ওঠে অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে।

তিনি লিখেছেন-

“… দাদীর কাছে গল্প শুনেছি যখন ছুটির সময় হতো তখন দাদি আম গাছের নিচে এসে দাঁড়াতেন। খোকা আসবে দুর থেকে রাস্তার উপর নজর রাখতেন। একদিন দেখেন তার খোকা গায়ের চাদর জড়িয়ে হেঁটে আসছে। পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি নেই। কি ব্যাপার? এক গরীব ছেলেকে তার শত ছিন্ন কাপড়ে দেখে সব দিয়ে এসেছেন।…”

আর তার সেই স্মৃতিগুলোর সাথে পথ চলতে চলতে আমরা দেখা পাই সবুজ শ্যামলে ভরপুর বাংলার অপরুপ গ্রামের চিরায়িত প্রতিচ্ছবি। তাইতো তিনি বলেছেন -

“…গ্রামের ছায়ায় ঘেরা, মায়ায় ভরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ এবং সরল সাধারন জীবনের মাধুর্যের মধ্য দিয়ে আমি বড় হয়ে উঠি…” - আর দিন শেষে আমরা পাই একজন পরম মমতাময়ী দেশনেত্রী- জননেত্রী। তিনি আরো বলেছেন -  

“…আমার শৈশবের স্বপ্ন রঙিন দিনগুলো কেঁটেছে গ্রাম বাংলার নরম পলিমাটিতে, বর্ষার কাদা পানিতে, শীতের মিষ্টি রোদ্দুরে, ঘাসফুল আর পাতায় পাতায় শিশিরের ঘ্রান নিয়ে, জোনাক জ্বলা অন্ধকারে ঝিঁঝিঁর ডাক শুনে. তাল - তমালের ঝোঁপে বৈচি, দিঘির শাপলা আর শিউলি বকুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে, ধুলো মাটি মেখে, বর্ষায় ভিজে খেলা করে।…”

আর এগুলো মিলেই তো আসলে পরিপূর্ণ একটি গ্রাম। সবুজ একটি গ্রাম, যার পরতে পরতে থাকা অনেক কথা, অনেক আবেগ আর অনেক গল্প। আজকালকার শহুরে ব্যাস্ত জীবনে আমরা কজনই বা পারি কলাগাছ ফেলে সাঁতার কাঁটতে, শীতের দিনে নদীর হালকা গরম পানিতে পা ভিজাতে, কিংবা গামছা বিছিয়ে টেংরা পুটি আর খল্লা মাছ ধরা! আমরা যখন গল্প শুনি বৈশাখের কাঁচা আম পেড়ে কুচি কুচি করে কেটে সর্ষেবাঁটা ও কাচা মরিচ মাখিয়ে - কলাপাতায় আমমাখা পুরে, তার রস টেনে খাওয়ার মতো আবেগি স্মৃতি - সত্যই তখন একরাশ শিহরন বয়ে যায় আমাদের ধমনীতে। কারন কিভাবে ঢিল ছুঁড়ে আম পাড়তে হয়, বরই গাছে ঝাঁকুনি দিতে হয় - তার সবটাই তো আজ অচেনা আমাদের এই শহর জীবনে। পাটক্ষেতের ভেতর দিয়ে ছোট্র ডিঙিতে ঘুরে বেড়ানো সে তো শুধূ গ্রামেই সম্ভব। সেই নৌকার জানালার ধারে বসে দূরের সবুজে ঘেরা গ্রাম যে আমরাও দেখতে চাই। তবে একথা সত্যি সময়ের পরিক্রময়ায় আর সভ্যতার বিকাশে বিজ্ঞানের আর্শীবাদকে আজ আর অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। পরিবর্তনের সাথে আমাদেরকেও তাল মেলাতে হবে। ব্যাবহার করতে হবে আধুনিক প্রযুক্তিকে। দুর্গা ও অপুর গ্রাম হয়তো আজ আমরা ইচ্ছে করলেই পাবো না। তবে এই বাংলার গ্রামগুলোই টিকিয়ে রেখেছে বাংলাদেশকে - আমাদের সরলতাকে।

বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে ধারণ করতেন গ্রামীণ অর্থনীতির ভীত শক্ত না হলে শহরের খুটিও শক্ত হবে না, একথা ভুলে গেলে চলবে না। তাই দিন বদলের হাওয়ায় গ্রাম উন্নয়ন এখন সময়ের দাবি মাত্র। এ বিষয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি আমাদের মানণীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তার সরকারকে। কারন “সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ” এই স্লোগানের উপর ভিত্তি করে নির্বাচিত সরকারের নির্বাচনী ইসতেহার ২০১৮ তে বর্ণিত হয়েছে বাংলাদেশের গ্রামগুলোর আধুনিকায়ন নিয়ে ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা। নিঃসন্দেহে গ্রাম প্রধান বাংলাদেশের জন্য এটি একটি আশা জাগানিয়া প্রতিশ্রুতি - একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। সবথেকে প্রধান ও ইতিবাচক হলো, উন্নয়ন চিন্তার মধ্যে সর্বপ্রথম আমাদের গ্রামকে স্থান দেওয়া। নাগরিক আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা এবং নাগরিক অধিকার গ্রামেও নিশ্চিতি করা। আর গ্রাম উন্নয়নের ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক আগেই তার ‘স্মৃতির দখিন দুয়ার’গ্রন্থে লিখেছেন সুষ্ঠ বিদ্যুতায়ন ব্যাবস্থা, হাসপাতাল, স্কুল - কলেজ, মাতৃসদন, কৃষি ও কারিগরি প্রশিক্ষণ-কেন্দ্র, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, খেলার মাঠ, প্রশস্ত রাস্তা ঘাট, মজবুত ঘরবাড়ি প্রভৃতির কথা। চেয়েছেন কৃষিতে সমবায়ের মাধ্যমে কৃষিব্যাবস্থার কথা, উৎপন্ন দ্রব্যের সুষম বন্টনের কথা, নির্ধারিত মূল্যে বাজারজাতের কথা। করতে চেয়েছেন সুষ্ঠ খাদ্য সংরক্ষন ব্যাবস্থাপনা এবং কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাবহারের নিশ্চয়তা। সেই সাথে নদ-নদী, খাল-বিলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি, গবাদিপশু ও হাস-মুরগির ব্যাপক উৎপাদন বৃদ্ধিকল্পে খামার তৈরী, সর্বপরি খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, কুটির শিল্পের মানোন্নয়ন এবং শিল্পের বিকাশ। বাড়াতে চেয়েছেন কর্মসংস্থান। ধর্মীয় গোড়ামি আর কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার প্রত্যয় ব্যাক্ত করেছেন তিনি। মেয়েদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে পথ চলার শক্তির কথা বলেছেন তিনি। শিশুদের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন -

“…তাদের শৈশব কৈশোর ও যৌবনকে আনন্দময় ও সুখময় করে তোলার উদ্যোগ আমাদেরকেই নিতে হবে।…”

তার মতে সাময়িক কোন ব্যাবস্থাপনা নয় বরং প্রয়োজন “সামগ্রিক উন্নয়ন” যার জন্য তিনি কাধে কাধ মিলিয়ে দেশের শিক্ষিত তরুন সমাজকে কাজে নামতে বলেছেন - তার লেখার মধ্য দিয়ে, বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। তাই আমরাও আজ অনেক আশাবাদী। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী সবুজ বাংলার গ্রামকে তার বুঁকে ধারন করেন সবসময়, লালন পালন করেন, যার স্মুতিতে রয়েছে গ্রাম বাংলার পথে প্রান্তরে ক্ষেত - খামারের অসংখ্য চিত্রপটে আঁকা বিচিত্র জীবনের চরিত্র - গল্প, তার হাত ধরে বাংলার গ্রামগুলো আবার ফিরে পাবে সবুজ প্রাণ - হয়ে উঠবে আরো কর্মচঞ্চল, আরো রঙিন। পরিকল্পনাহীনতায় গ্রামগুলো কোন ভাবেই নষ্ট হবে না। সবশেষে তার কথা দিয়েই শেষ করছি -

“… জীবনানন্দের রুপসী বাংলা যেন আমার গ্রাম - এর চেয়ে আর কোন আকর্ষণ, মোহ, তৃপ্তি আর কোন কিছুতেই নেই আমার। ধূলি-ধূসরিত গ্রামের জীবন আমার আজন্মের ভালোবাসা। আমার হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতি।…“  তিনি আরো বলেছেন -

“… গ্রামকে তো আমি আমার শৈশবের গ্রামের মতো করেই ফিরে পেতে চাই। কিন্তু চাইলেই তো আর হবে না। এখন সময় দ্রুত বদলে যাচ্ছে যান্ত্রিকতার স্পর্শে। গ্রামের সরল সাধারণ জীবনেও ব্যস্ততা বেড়েছে। চমক জেগেছে। মানুষ ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এই শতাব্দীতে বাস করে বিজ্ঞানের আশীর্বাদকে অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর গ্রামীণ জীবনের মান উন্নয়ন ও শ্রমের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে।…”

আর আমরাও প্রতিক্ষায় আছি তার স্বপ্নের পরিকল্পিত গ্রামোন্নয়নের লক্ষ্যে এই বাংলায়। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি গ্রাম বাংলার মানুষ তাকিয়ে আছে তাদের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে।

লেখকঃ শিক্ষক ও স্থপতি (বর্তমানে মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় এ স্থাপত্য-পরিবেশ বিষয়ক পিএইচডি গবেষক)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত