বন্দিদশায় যেভাবে পরিবারকে বাঁচিয়েছিলেন বেগম মুজিব

2707

Published on ডিসেম্বর 16, 2020
  • Details Image

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় লাভ করলেও বঙ্গবন্ধুপত্নী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ও তার পরিবারের সদস্যরা তখনও মুক্ত হননি। ওই সময়য়ে ঘটনাবলি নিয়ে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে দৈনিক বাংলা পত্রিকা। বেগম শেখ মুজিব কেবল ঠান্ডামাথায় কৌশল অবলম্বন করে কীভাবে নিজেকে ও পরিবারকে বাঁচিয়েছিলেন সেই কথা তুলে ধরেছিলেন সাক্ষাৎকারে। সেখানে তিনি ডিসেম্বরের শুরু থেকে গৃহবন্দিত্বকাল শেষ হওয়া পর্যন্ত সময়ের শঙ্কা, ভয় ও জীবন নিয়ে কথা বলেছিলেন।

সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সেদিন কুকুরের মতো উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল দস্যুরা। ১৬ ডিসেম্বর দিনরাত ২৪ ঘণ্টা তারা যেন মৃত্যুর উৎসবে মেতেছিল। রাস্তা দিয়ে যে গাড়ি-ঘোড়া ও মানুষ চলাচল করছিল সেগুলো লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে। বাসার ভিতরে বঙ্গবন্ধুপত্নী বেগম শেখ মুজিব এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যা করার জন্য যতবার হানাদার সদস্যরা প্রবেশ করতে চেয়েছেন, নিজের মাথা ঠান্ডা রেখে ততবার তিনি এগিয়ে গিয়ে তাদের বাসার ভেতরে আহ্বান জানিয়েছেন, মিষ্টি করে কথা বলেছেন। এরপর লজ্জিত হয়ে কিছুক্ষণ পর ওরা চলে গেছে, কিন্তু আবারও এগিয়ে এসেছে। সেদিন অতি সাবধানে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করে গেছেন তিনি। কেবল উপস্থিত বুদ্ধি আর মিষ্টি কথার মাধ্যমে।

সাক্ষাৎকারে ডিসেম্বরের শুরুর দিনগুলোর অস্থিরতার কথা উঠে আসে। তিনি বলেন, নভেম্বরের শেষের দিকেই বুঝতে পেরেছিলাম ডিসেম্বর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আমার বন্দিজীবনে বাইরের সংবাদ আসার কোনও উপায় ছিল না। কিন্তু ট্রানজিস্টার ছিল। ডিসেম্বরের ৩ তারিখ বাসায় অবরুদ্ধ আমরা কজন প্রহর গুনছিলাম ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের প্রতীক্ষায়। আমার মন তখন আনন্দ আর বিষাদের স্পর্শে শিহরিত। যেদিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে সেদিন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হবে বলে শুনছিলাম। ৩ তারিখে কলকাতার ঐতিহাসিক জনসভা শোনার জন্য তাই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। ইন্দিরাজির ভাষণ খুবই ভালো লেগেছিল। কেন জানি ট্রানজিস্টারের সামনে থেকে নড়তে ইচ্ছা করছিল না। রাতে আকাশবাণী সংবাদ শেষ হলো। হঠাৎই বলা হলো একটি বিশেষ ঘোষণা আসছে। তখন ক্লান্ত দেহ মন। বাচ্চারা একে একে ঘুমাতে চলে গেলো। মাথার কাছে ট্রানজিস্টারটা খোলা রেখে প্রতীক্ষা করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙলো বিমান বিধ্বংসী কামানের শব্দে। কালো আকাশটায় অসংখ্য দ্বীপ জ্বলছে, বুঝলাম যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

১৯৭১ সালের জানুয়ারির ছবি, ১৯৭২ সালের ১৭ ডিসেম্বর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়বেগম শেখ মুজিব বলেন, ডিসেম্বরের দিনগুলো প্রতিদিন যেন নতুন নতুন বিভীষিকা হয়ে দাঁড়ালো কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরের আগে পর্যন্ত তার যত হুমকিই দিক, প্রত্যক্ষভাবে কোনও ক্ষতি করতে চেষ্টা করেনি। ১৬ তারিখ সকালে যখন দায়িত্বশীল দুজন অফিসারকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল তখন বাকি সেনারা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গিয়েছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি। বেগম মুজিব বলেন, কেননা তারা আশা করেছিল যে ওদেরকেও নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু দুপুর পর্যন্ত যখন চারদিক থেকে জয় বাংলা স্লোগান আসতে লাগলো তখন তারা ভীষণ ক্ষেপে গেলো। আমাদের ঘরের মধ্যে কাপড় শুকাবার দড়ি বাঁধা ছিল, রাতে কটকট করে উঠতেই সবাই দাঁড়িয়ে পড়লাম। রক্তের মতো লাল দুটি চোখ নিয়ে টহল দলের অধিনায়ক দাঁড়িয়েছিল বারান্দায়। এসে বললো খোকাকে ডাকো। আমি বললাম, খোকা ঘুমিয়ে পড়েছে। যা বলার আমাকেই বলতে পারো। আমার মুখের দিকে কঠোরভাবে তাকিয়ে সে বললো সাবধানে থেকো।

সাক্ষাৎকারে বিবরণ দিতে গিয়ে বেগম শেখ মুজিব বলে চলেন, মেজর তারা এলেন বেলা নয়টায়। তিনি সাধারণ পোশাকে এসেছিলেন কিন্তু পেছনে তিনি একদল সৈন্যকে পজিশন নিয়ে ঘিরে দাঁড় করিয়েছিলেন। খালি হাতে শুধু ওয়্যারলেসম্যানকে সঙ্গে নিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ওদের বোঝাচ্ছিলেন। প্রথমে ওরা স্যারেন্ডার করতে চায়নি। পরে দুই ঘণ্টা সময় চেয়েছিল। গেটের সামনে থেকে ওদের কথা শুনে মেজর তারা যেই পা বাড়ালেন ভেতর থেকে বাচ্চারা চিৎকার করে উঠলো, ‘আপনি যাবেন না। যাবেন না। সময় পেলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’ সত্যিই সময় পেলে সেদিন ওরা আমাদের মেরে ফেলতো। মেজর তারা তাদেরকে সেই সময় দেননি। পরে বাঙ্কার থেকে সৈন্যরা একে একে বেরিয়ে আসে। তারা তখন আত্মসমর্পণ করতে উদগ্রীব।

পরবর্তীতে বেগম শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ২৪ ডিসেম্বর সাহসিকতা এবং উপস্থিত বুদ্ধির জন্য মেজর তারাকে উপহার প্রদান করেন। বেগম মুজিব যখন গৃহবন্দি ছিলেন তখন পাকিস্তানি শাসকদের সৃষ্ট ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গিয়ে মেজর তারা অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন।

সৌজন্যেঃ বাংলা ট্রিবিউন

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত