1425
Published on ডিসেম্বর 14, 2020আমরা প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করি। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল তার উল্লেখযোগ্য একটি উদাহরণ হলো বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড চালানোর মধ্য দিয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করে পাকিস্তানি হায়েনারা। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানি বাহিনীদের প্রধান শিকার ছিলেন এদেশের প্রতিথযশা শিক্ষাবিদ, চিকিত্সক, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ প্রথম শ্রেণির মানুষগুলো। আর এই হত্যাকাণ্ড প্রকটরূপ ধারণ করে ১০-১৪ ডিসেম্বর এবং ১৪ ডিসেম্বরের সেই ভয়াবহতা সত্যিই মর্মান্তিক ছিল। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের অভাব জাতি এখনও অনুভব করে চলেছে। তাদের অবদান ভুলবার নয়। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও দেশীয় আলবদর, রাজাকাররা মিলে পরিকল্পিত এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে।
মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের অবদান ছিল অসামান্য। তাদের অনুপ্রেরণা এবং উত্সাহে মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পরিচালিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের অসংখ্য লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী, চিকিত্সক, শিক্ষক তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে অগ্রগামী করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের মূল নিয়ামক শক্তি ছিল জনগণ, তথাপি মানুষকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের অবদান ছিল খুবই প্রশংসনীয়। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে খবর পাঠ, দেশাত্মবোধক গান, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গান, কবিতা পাঠ, নাটক, কথিত ও অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলো বুদ্ধিজীবীরাই পরিচালনা করেন।
বুদ্ধিজীবীরা রণক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের মানসিক, নৈতিক মনোবল ধরে রাখতে সহায়তা, সাহস জোগানো এবং জনগণকে শত্রুর বিরুদ্ধে দুর্দমনীয় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এক কথায় যদি বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশক কারা ছিলেন? বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন অগ্রভাগে, সেটাই হবে উত্তম উত্তর। অন্যদিকে স্বাধীনতা আন্দোলনে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের অবদান অতুলনীয়। রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য বাঙালিদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও জীবনের বিনিময়ে বাঙালি বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে যখন উপস্থিত তখন পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি এক সুদূরপ্রসারী কুপরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি এদেশের শ্রেষ্ঠ মানুষদের নিঃশেষ করে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার এক নীলনকশা আঁকেন।
সেই নকশানুযায়ী পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ধরে নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবীদের ওপর কী পরিমাণ অত্যাচার করা হয়েছিল সেটা বোঝা যায় তত্কালীন উল্লেখযোগ্য পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার একটা বিবরণ দেখে। ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি উল্লিখিত পত্রিকায় কাঁটাসুরের বধ্যভূমি শীর্ষক এক মর্মস্পর্শী প্রতিবেদনে অধ্যাপক হামিদা রহমান বুদ্ধিজীবীদের নির্মম হত্যাকাণ্ডে বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন:
‘আর একটু দূরে যেতেই দেখতে পেলাম, একটি কঙ্কাল। শুধু পা দুটো আর বুকের পাঁজরটিতে তখনো অল্প মাংস আছে। বোধ হয় চিল-শকুন খেয়েছে। কিন্তু মাথার খুলিটিতে লম্বা লম্বা চুল। চুলগুলো ধুলো-কাদায় মিলে গিয়ে নারীদেহের সাক্ষ্য বহন করছে। আর একটু এগিয়ে যেতেই বেশ কয়েক জন লোক দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখছে। আমি উপরে উঠতে একজন ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে আমাকে ওপরে উঠিয়ে নিলেন। সামনে দেখি নিচু জলাভূমির ভেতর এক ভয়াবহ বীভত্স দৃশ্য। সেখানে এক নয়, দুই নয় একেবারে বারো-তেরো জন সুস্থ মানুষ একের পর এক শুয়ে আছে। পাশে দুটো লাশ তার একটির হূিপণ্ড যেন ছিঁড়ে নিয়েছে। মাঠের পর মাঠ চলে গিয়েছে। প্রতিটি জলার পাশে হাজার হাজার মাটির ঢিবির মধ্যে কঙ্কাল সাক্ষ্য দিয়েছে কত লোককে যে মাঠে হত্যা করা হয়েছে।’
একই বছর ৮ জানুয়ারি দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় মিরপুরের শিয়ালবাড়ী বধ্যভূমি নিয়ে আনিসুর রহমান তার প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, ‘অথবা যদি না যেতাম সেই শিয়ালবাড়ীতে তাহলে দেখতে হতো না ইতিহাসের বর্বরতম অধ্যায়কে। অনুসন্ধিত্সু হিসেবে যা দেখাও কোনো মানুষের উচিত নয়। ওখানে না গেলে গায়ে ধরত না এমন দহনজ্বালা। সহ্য করতে হতো না ভয়, ক্রোধ, ঘৃণা মিশ্রিত এমন তীব্র অনুভূতি যে অনুভূতি বলে বোঝাবার নয়।’ বুদ্ধিজীবীদের নাম স্মরণ করতে গেলে প্রথমেই যে নামগুলো আসে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, দর্শনশাস্ত্রের গোবিন্দচন্দ্র দেব, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, আবদুল মুকতাদির, এস এম রাশিদুল হাসান, ড. এন এম ফয়জুল মাহী, ফজলুল রহমান খান, এ এন এম মুনিরুজ্জামান, ড. সিরাজুল হক খান, ড. শাহাদাত আলী, ড. এম এ খায়ের, এ আর খান নাদিম, সাদেক, শরাফত আলী, গিয়াস উদ্দীন আহমদ, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য ও সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, অধ্যাপক ড. হবিবুর রহমান, ড. শ্রী সুখরঞ্জন সমাদ্দার, মীর আবদুল কাইয়ুম, চিকিত্সক ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ, ডা. হুমায়ুন কবীর, ডা. মুনসী আলী, ডা. নুরুল ইমাম, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, সেলিনা পারভীন, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, গীতকার ও সুরকার আলতাফ মাহমুদ, রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, লেখক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, কবি মেহেরুন্নেসা, শিক্ষাবিদ ড. আবুল কালাম আজাদ।
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ১৪ ডিসেম্বরকে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস ঘোষণা করেছিলেন। কারণ এই দিনেই সব থেকে বেশি অপহরণ এবং হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।
২০ ডিসেম্বরর ১৯৭১ মুজিবনগর সরকারের এক মুখপাত্র জানান, ১৬ ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণের আগে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ৩৬০ জন বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। ১৯৭২ সালের সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ’ নামক প্রামাণ্য চিত্রে বলা হয়, স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন ৬৩৭ জন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক-শিক্ষিকা, ২৭০ জন সেকেন্ডারি স্কুলশিক্ষক এবং ৫৯ জন কলেজশিক্ষককে এবং ৫৯ জন কলেজশিক্ষককে হত্যা করা হয়। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭২ একদল সাংবাদিক ঢাকার রায়েরবাজার এলাকায় পচনশীল একটি গণকবরের সন্ধান লাভ করে। জাতির মেধাবী ব্যক্তিবর্গের দেহগুলো অত্যাচারের সুস্পষ্ট চিহ্ন নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। অন্যদিকে লালমাটিয়ায় শারীরিক প্রশিক্ষণকেন্দ্রে একটি বন্দিশালা আবিষ্কার করা হয়, যেটা আলবদরদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ এবং কামাল উদ্দীন, চিকিত্সক ফজলে রাব্বি, আব্দুল আলিম চৌধুরী এবং আবুল খায়েরের পচনশীল লাশগুলো সেই দিনই পরিবার কর্তৃক শনাক্ত করা হয়।
সাংবাদিক সেলিনা হোসেনের লাশ শনাক্ত করা হয় তার পরের দিন। এছাড়াও কিছুদিনের মাঝে আরো বেশ কিছু শহিদ বুদ্ধিজীবীদের লাশ চিহ্নিত করা হয়। লাশ শনাক্ত করার সময় শহিদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের অনেকেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন। এরকম আরো বধ্যভূমি হলো মিরপুর, রায়েরবাজার এলাকা, তেজগাঁওয়ের কৃষি বর্ধিতকরণ বিভাগের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মহাখালীর টিবি হসপিটালসহ আরো অনেক। প্রতিবছর বুদ্ধিজীবী দিবস পালন বাঙালির মনে একটি নতুন প্রশ্ন রেখে যায়। বুদ্ধিজীবীরা যেমন তাদের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গিয়েছেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, সর্বোপরি দেশের কল্যাণের জন্য তারা যেমন অকাতরে নিজের জীবন দিতে দ্বিধাবোধ করেননি, বীর সৈনিক হিসেবে কাজ করে গিয়েছেন, ঠিক তেমনি যেন আমরা দেশমাতৃকার প্রয়োজনে তাদের মতো করে তৈরি হই। আর এটাই হলো বুদ্ধিজীবী দিবসের প্রধান শিক্ষা।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ঢাকার মিরপুরে প্রথম শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। স্মৃতিসৌধটির স্থপতি মোস্তফা হালি কুদ্দুস। ১৯৯১ সালে ঢাকার রায়েরবাজারে শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নামে আরেকটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ শুরু হয়, যা ১৯৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বরের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর নকশা করেন জামী-আল সাফী ও ফরিদউদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে একটি স্মারক ডাকটিকিটের সিরিজ প্রকাশ করেছে। বিজয়ের মাসে আমাদের প্রত্যাশা—সব সাম্প্রদায়িক শক্তির ষড়যন্ত্র পরাজিত হোক বুদ্ধিবৃত্তি, জ্ঞান, শিক্ষা ও অসাম্প্রদায়িকতার সেতুবন্ধের কাছে।
লেখক :সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)