2264
Published on ডিসেম্বর 7, 2020বীরেন্দ্র নাথ অধিকারীঃ
আগামী ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির মহান বিজয়ের ৪৯তম বছর এবং ৫০তম বিজয় দিবস। এই চূড়ান্ত বিজয়ের সোপান তৈরি করেছিল ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে বাঙালিদের ভূমিধস বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী এ বছর। কী করে বাঙালিদের অভূতপূর্ব এবং বিশ্ব-ইতিহাসে নজিরবিহীন বিজয় অর্জিত হয়েছিল; ঘটনা পরম্পরায় তার স্মৃতি রোমন্থন করা, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে তা উপস্থাপন করার এক দায়বদ্ধতা রয়েছে।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান নামক সাম্প্র্রদায়িক রাষ্ট্র সৃষ্টির মাত্র তিন মাসের মাথায় বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণ প্রথম জনসমক্ষে প্রকাশ পায়। ওই বছর ২৭ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত প্রথম শিক্ষা সম্মেলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহারের সুপারিশসহ প্রচারমাধ্যম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেবল উর্দু ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়। পূর্ব বাংলার জনগণ, বিশেষ করে ছাত্ররা তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রস্তাবের পরের দিন অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর প্রবল বিরোধিতা ও প্রতিবাদ এবং 'বাংলা'কে রাষ্ট্রভাষা করার জোর দাবি জানায়। সূত্রপাত ঘটে 'রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন'-এর। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে প্রথম 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহারের জন্য পাকিস্তান গণপরিষদে একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। এরপর জিন্নাহসহ অন্যান্য পাকিস্তানি শাসকের বাংলা ভাষাবিরোধী বিভিন্ন বক্তব্য ও ঘোষণার প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার জনগণ দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির মূল আন্দোলনসহ আগে ও পরে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত বাঙালিরা লড়াই করে বুকের রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় আসীন করে। ১৯৫৪ সালের ৭ মে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত এবং ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে তার ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আক্ষরিকভাবে এটিই ছিল বাঙালিদের কাছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রথম পরাজয়, যা মন থেকে তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। ফলে নানা অজুহাতে তারা বাঙালিদের ওপর বিভিন্ন কালাকানুন জারি করতে থাকে। তাই ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বাঙালিরা নিরঙ্কুশ জয়লাভ করলেও অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৯৫৪ সালের মার্চ থেকে ১৯৫৮ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মোট সাতবার মন্ত্রিসভা বদল ও তিনবার গভর্নরের শাসন চালু করে। ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক ফরমান জারি করে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক গণপরিষদ বাতিলপূর্বক সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করেন। মাত্র ২০ দিনের মাথায় ২৭ অক্টোবর ইস্কান্দার মির্জাকে উৎখাত করে দেশত্যাগে বাধ্য করেন আইয়ুব খান। পরের দিন ২৮ অক্টোবর নিজেই প্রেসিডেন্ট হয়ে সামরিক শাসন পাকাপোক্ত এবং ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচন বাতিল করেন। শুরু হয় এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ। নিজের ও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মসনদ পাকাপোক্ত করতে সব ক্ষেত্রে নিবর্তনমূলক কালাকানুন জারি করে বিশেষভাবে সেসব বাঙালির ওপর আরোপে বিভিন্ন কূটকৌশল অবলম্বন করেন।
তার আমলে বাঙালি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, ভাষা, সাহিত্য, গণমাধ্যম, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ওপর জেল-জুলুম, নিপীড়ন ও অত্যাচারের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। জিন্নাহর মতো আইয়ুব খানও প্রচণ্ডভাবে বাংলা ভাষা এবং বাঙালিবিরোধী ছিলেন।
বাঙালিদের কাছে পাকিস্তানি শাসকচক্রের চরিত্র এবং হীন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ক্রমেই পরিস্কার হতে শুরু করে। তাই মুষ্টিমেয় পদলেহনকারী ও স্বার্থান্বেষী বাদে ষাটের দশকের শুরুতেই তারা সর্বগ্রাসী আইয়ুবি আগ্রাসন রুখে দেওয়ার কৌশল অবলম্বন শুরু করেন। বিশেষ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিদ এবং গণমাধ্যম ও সংস্কৃতিকর্মীরা বিভিন্ন কৌশলে আইয়ুবের শাসনের বিরুদ্ধে নানান প্রকার কর্মসূচি পালন করেন। আন্দোলনের বিষয়টি মূলত রাজনৈতিক বিধায় এক পর্যায়ে রাজনীতিবিদরাই পকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে উদ্যোগী হন। তারই অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কয়েকজন বামপন্থি নেতা ও শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে ১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকার মগবাজারের এক বাসায় গোপন বৈঠকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের প্রথম পরিকল্পনা করেন। গোড়াপত্তন হয় স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম। এরপর ধারাবাহিকভাবে ৬১'র শিক্ষক আন্দোলন, ৬২'র শিক্ষা আন্দোলন, 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ' গঠন, ছয় দফা প্রণয়ন, ৬৬'র ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাবিরোধী আন্দোলন এবং '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পথ বেয়ে আসে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। ৭০-এর নির্বাচনের পটভূমিতে টালমাটাল আন্দোলনের মধ্যে উপায়ান্তর না দেখে আইয়ুব খান পদত্যাগ করে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনীপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখতে আইয়ুবের গৃহীত নীতির পরিবর্তে ইয়াহিয়া কিছুটা কৌশলী বটে, চাতুর্যপূর্ণ নীতি অবলম্বন করেন। এরই অংশ হিসেবে ভারত ভাগ করে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আসাবভূমির দাবিতে 'মুসলিম বিদ্রোহ দিবস'-এর ৩০তম বার্ষিকী উদযাপনের সুযোগ নিয়ে তিনি ১৯৭০ সালের ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে পাকিস্তানের ঐক্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং এর পাঁচ দিন পর অর্থাৎ ৩০ মার্চ ইয়াহিয়া 'লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার-১৯৭০' (এলএফও) জারি করেন। এলএফওর মূল প্রতিপাদ্যগুলো ছিল 'এক ব্যক্তি এক ভোট', পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট প্রথা বাতিল এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা পাকিস্তানের নতুন সংবিধান রচনা করবেন। তবে দুরভিসন্ধিমূলক এলএফওর ২৫ ও ২৭ অনুচ্ছেদে বিধি জুড়ে দেওয়া হয়েছিল- সংবিধান প্রণীত হলেও এটির অনুমোদন দেবেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। তাই অনেক রাজনীতিবিদ এলএফওর অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণে অস্বীকার এবং এর তীব্র সমালোচনা করেন। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে এতে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি বললেন, 'নির্বাচনের পর এই এলএফও আমি টুকরা টুকরা করে ছিঁড়ে ফেলব।' নির্বাচনে অংশগ্রহণ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, 'ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়, কে এই দেশের নেতা- বিশ্ববাসীর কাছে সেটি তুলে ধরার জন্যই আমি নির্বাচন করছি।'
নির্বাচনে বিজয়ের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু উল্ক্কার বেগে সারা পূর্ব পকিস্তান চষে বেড়ালেন এবং মাঠ-ঘাট-পথ-প্রান্তর-গ্রাম-গঞ্জ-শহর-বন্দরজুড়ে প্রচার করলেন তার প্রণীত বাঙালির মুক্তির সনদ 'ছয় দফা'। তাতে বাঙালি সমস্বরে আওয়াজ তুলল- 'আমার নেতা, তোমার নেতা- শেখ মুজিব, শেখ মুজিব', 'শেখ মুজিবের পিছে বাঙালি আছে', 'তোমার দফা, আমার দফা- ছয় দফা, ছয় দফা', 'নির্বাচনী পথ ধরো- ছয় দফা কায়েম করো', 'পদ্মা-মেঘনা-যমুনা- তোমার আমার ঠিকানা'।
অবশেষে এলো বাঙালিদের ভোটবিপ্লবের মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর উৎসবমুখর পরিবেশে তারা স্রোতের ধারায় দলে-দলে ভোট দিল 'নৌকা বাক্সে'। শুধু কথায় নয়, কাজেও তারা দেখিয়ে দিল- 'শেখ মুজিবের পিছে- বাঙালি আছে'। বিশ্ব-ইতিহাসে নজিরবিহীন নির্বাচনী ফলাফল- সমগ্র পাকিস্তানের ৩০০টি এবং পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি জাতীয় পরিষদ আসনের মধ্যে ১৬০টি পেল বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের দল 'আওয়ামী লীগ'। গণআনন্দের জোয়ারে ভেসে উঠল গোটা পূর্ব পাকিস্তান। আনন্দধারায় ওই জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের ১০ দিনের মাথায় অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হলো প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন। তাতেও মুজিবীয় ফল্কগ্দুধারায় বাঙালিদের বিজয়, নৌকার জয়জয়কার। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের নৌকায় উঠল ২৮৮টি আসন।
বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের মন জানতেন, বুঝতেন তারা কী চায়! তিনি নিশ্চিত ছিলেন- নির্বাচনে তার দলের বিজয় কেউ রুখতে পারবে না। তাই ৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু নৌকার পালে যে হাওয়া তুলেছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয় অর্জনে নেতৃত্বের মাধ্যমে বিশ্বমানচিত্রে জায়গা করে দিয়ে গেছেন স্বাধীন-সার্বভৌম 'বাংলাদেশ' ভূখণ্ড।
বিজয়ের মাসে ৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার সুযোগ্য সহকর্মীবৃন্দ, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহত সব শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
লেখকঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রযুক্তিবিদ
সূত্রঃ দৈনিক সমকাল