1948
Published on ডিসেম্বর 2, 2020মার্চ থেকে শুরু হওয়া করোনা মহামারি মোকাবিলায় সরকার ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার পর অক্টোবরের মধ্যেই ৩৯ দশমিক ২৩ শতাংশ অর্থ বিতরণ সম্পন্ন করেছে। বিতরণ করা প্যাকেজের আর্থিক মূল্য ৪৭ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। এই সময়ে খাদ্য ও নগদ অর্থসহ বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় মোট ৩ কোটি ৫৪ লাখ মানুষকে সহায়তা দিয়েছে সরকার। দেশের ৭৬ লাখ ফার্ম, প্রতিষ্ঠান, উদ্যোক্তা এবং অন্য আরও কিছু খাতে অর্থনৈতিক সহায়তার অংশ হিসেবে বিনা সুদে ও স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হয়েছে।
মানুষের জীবনযাপন, কর্মমসংস্থান, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা স্বাভাবিক রাখতে মার্চের পর থেকে বিভিন্ন সময় প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। সব মিলিয়ে ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার যে প্রণোদনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেটি দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি)-এর ৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
অর্থ বিভাগের প্রতিবেদন জানায়, নগদ টাকা ও খাদ্য সহায়তা দেওয়ার কারণে দেশের প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়নি, কেউ অভাবে পড়েনি। সরকারের এই উদ্যোগের কারণে প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে যারা দরিদ্রসীমা জয় করে উঠে আসছিলেন, মহামারির ধাক্কায় আবারও তাদের দারিদ্রসীমার নিচে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পেয়েছে। এই তহবিল বিতরণের কারণে চলমান ব্যবসা খাতের ধস ঠেকানো গেছে এবং বিভিন্ন সেক্টরের অধীনে কাজ করা কয়েক লাখ মানুষকে কর্ম হারাতে হয়নি। সরকারের এই সহায়তার কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কর্মসংস্থান ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে, ফলে লাখ লাখ পরিবারকে হুট করে বিপদে পড়ার হাত থেকে বাঁচানো গেছে।
বিভিন্ন ক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি ও বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান; বিভিন্ন পরিষেবা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং খাদ্য সুরক্ষার জন্য খুব স্বল্প সুদের ঋণ হিসেবে ব্যাপক পরিসরে সহায়তা দেয় সরকার। এছাড়াও মহামারির কারণে সৃষ্ট অচলাবস্থায় ধাক্কা খাওয়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং কর্মহীন হয়ে পড়া লাখ লাখ মানুষের সুরক্ষার জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়। অন্যদিকে অর্থনীতি সক্রিয় রাখতে রফতানিমুখী ও বৃহৎ শিল্পের জন্য বরাদ্দ তহবিলও বিতরণ করা হয়েছে খুব দ্রুততার সঙ্গে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সরকারি সহায়তার এই ২১টি প্যাকেজকে ৩টি বৃহত্তর ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছে। সেগুলো হলো- প্রথমত, মানুষের চাকরি বাঁচানো এবং বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ধারাবাহিকতা স্বাভাবিক রাখা; দ্বিতীয়ত- কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা; তৃতীয়ত- সামাজিক সুরক্ষা ও খাদ্য সরবরাহ বাড়ানো।
৫০ লাখ কর্মীর বেতনের জন্য বিনা সুদে ২ হাজার প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান
প্রথম ক্যাটাগরিতে মানুষের চাকরি ধরে রাখা এবং বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ধারাবাহিকতা স্বাভাবিক রাখার জন্য ব্যাংকিং সিস্টেমের মাধ্যমে ৭টি প্যাকেজে ৮৬ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা বণ্টন করা হয়। এরমধ্যে ৩১ অক্টোবরের আগেই ৪১ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। ৭৩ লাখ ২৮ হাজার ২৫১টি ফার্ম এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এই ঋণ সহায়তা পেয়েছে। এমনকি সুবিধাভোগীদের অধিকাংশকেই অর্থাৎ ৭২ লাখ ৮০ হাজার ঋণগ্রহীতার দুই মাসের (এপ্রিল ও মে) সুদ পর্যন্ত মওকুফ করা হয়। এই দুই মাসে মাফ করে দেওয়া ঋণের পরিমাণ ১৬ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা।
প্রথম ক্যাটাগরির এই ৭টি প্যাকেজ থেকে দেশের রফতানি খাতে, মূলত তৈরি পোশাক শিল্পে, বিশেষ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। অন্য খাতের তুলনায় এই খাতে সহায়তা বিতরণও করা হয়েছে বেশি। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার জন্য রফতানি সংশ্লিষ্ট ১ হাজার ৯৯২টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে দুই ধাপে বিনাসুদে ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। পরিস্থিতি অবনতি না ঘটে যেন, তাই জুনের মধ্যেই পুরো অর্থ বিতরণ করা হয়েছে এবং প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক এই অর্থের সুবিধা পেয়েছেন। এই উদ্যোগের কারণেই তাদের স্বাভাবিক বেতন অব্যাহত থেকেছে এবং চাকরি টিকে গেছে। ফলে এই শ্রমিকদের পরিবার মহামারির অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে পেরেছে।
মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৯ শতাংশ হার সুদে মোট ৩৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকার তহবিল বিতরণের সিদ্ধান্ত হয়, সুদের সাড়ে চার শতাংশ শোধ করবে ঋণগ্রহীতা এবং বাকি সাড়ে চার শতাংশ ভর্তুকি হিসেবে সরকার শোধ করে দেবে। সেপ্টেম্বরে ২২ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে এবং ২ হাজার ৫৯৪টি ফার্ম এই সহায়তা পায়।
মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য সরকার ৯ শতাংশ সুদে ২০ হাজার কোটি টাকার মূলধন সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যার মধ্যে ৪ শতাংশ সুদ ঋণগ্রহীতা এবং বাকি পাঁচ শতাংশ সুদ সরকার ভর্তুকি হিসেবে দেবে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা বিভিন্ন খাত, ৪১ হাজার ৬৯টি ফার্ম এবং উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।
৩৫ লাখ পরিবারকে নগদ অর্থ সহায়তা
দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে ৪টি প্যাকেজের মাধ্যমে ১২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দের পরিকল্পনা করা হয়, যার মধ্যে অক্টোবর নাগাদ ৪ হাজার ২২৫ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এর সুবিধা পেয়েছে ৩৭ লাখ ২২ হাজার মানুষ ও বেশ কিছু ফার্ম।
হতদরিদ্রদের নগদ সহায়তা প্যাকেজে ৩৫ লাখ পরিবারকে এককালীন আড়াই হাজার করে টাকা দেওয়া হয়। এজন্য বরাদ্দ ১ হাজার ২৫৮ কোটি টাকার মধ্যে ৮৮০ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। সরকার এই প্যাকেজের আওতায় ৫০ লাখ পরিবারকে সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল কিন্তু উপকারভোগীদের তালিকা নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর এটা থামিয়ে দেওয়া হয়।
এদিকে আরও তিনটি পৃথক প্যাকেজের মাধ্যমে ২ লাখ ২২ হাজার ফার্ম এবং মানুষ আরও কিছু সহায়তা পেয়েছে। প্যাকেজগুলো হলো- কর্মসংস্থানের জন্য ক্রেডিট এক্সপ্যানসন করা, কৃষিখাতে পুনঃঅর্থায়ন এবং কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পুনঃঅর্থায়ন।
২ কোটি ৫৪ লাখ মানুষের মধ্যে বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ
তৃতীয় ক্যাটাগরিতে ১০টি প্যাকেজে ২২ হাজার ১২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করে সরকার। এই খাত থেকে এখন পর্যন্ত ২ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে এবং প্রায় ৩ কোটি ২৮ লাখ মানুষ এর সুবিধা ভোগ করেছেন।
এর একটি প্যাকেজের মাধ্যমে বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। ৪৯৬ পৌরসভা এবং উপজেলার ২ কোটি ৫৪ লাখ মানুষের মধ্যে সরকার পাঁচ লাখ টন চাল এবং এক লাখ টন গম বিনামূল্যে বিতরণ করেছে সরকার।
এছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় ৫০ লাখ পরিবারকে ওএমএস সুবিধার আওতায় ১০ টাকা কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে এবং শহরাঞ্চলের প্রায় ১৮ লাখ পরিবারকে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দিয়ে সহায়তা করা হয়েছে। যার ফলে দেশের কোনো মানুষকেই না খেয়ে থাকতে হয়নি।
রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়। করোনা মোকাবিলায় সরকার কর্তৃক গৃহীত সহায়তা প্রকল্পের অগ্রগতি মূল্যায়নের জন্য ২৬ নভেম্বর এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে উপস্থিত ছিলেন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এবং স্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা।
সেসময় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আহমেদ কায়কাউস বলেছেন, খাদ্য এবং নগদ অর্থ সহায়তার ব্যাপারে মূল্যায়ন করে দেখা গেছে যে প্রায় ২১ শতাংশ মানুষের কাছে এই দুই সুবিধা পৌঁছে দেওয়া গেছে।