বঙ্গবন্ধু হত্যাঃ পলিটিক্যাল নয় ফিলোসোফিক্যাল কিলিং

3725

Published on নভেম্বর 23, 2020
  • Details Image

হায়দার মোহাম্মদ জিতু:

মাধ্যমিক পর্যায় বা তার নিম্ন শ্রেণীর গণিতে বামপক্ষ সমান ডানপক্ষ মেলানোর অঙ্ক শেখানো হয়। প্রোমোশন ও নম্বর পাবার আকাংক্ষায় সেই অঙ্ক শেখার অতীত সকলেরই আছে। কিন্তু ইতিহাসের বাঁক বদল বুঝতেও যে এই পন্থা সহায়ক হতে পারে সে বিষয়টি বহুলাংশেরই অজানা। তেমন এক ঐতিহাসিক বিষয় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, যাকে এর মাধ্যমে জানা সম্ভব।

এই হত্যাকাণ্ডের একদিকে অর্থাৎ বামপক্ষে পরাজিত পাকিস্তান, তার মিত্র শক্তিগুলো ও অন্যদিকে মানে ডানপক্ষে জিয়াউর রহমানকে রেখে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এর সমান অংশীদারিত্বের প্রমাণ মেলে। যেমন পাকিস্তান এবং তার মিত্র শক্তিগুলো বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় বাংলাদেশের স্বীকৃতি কিংবা এর পাশে থাকার রীতিতে ছিলেন না। বরং বিরোধিতা করেছেন যে কোন ফোরামে। অর্থাৎ আদতেই বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ বিরোধী ছিলেন। শুধু তাই নয় দেশ স্বাধীন হবার পরও তারা বঙ্গবন্ধুকে চাপ দিয়েছিলেন যে বাংলাদেশ যেন মধ্যপ্রাচ্যের ভাবধারায় গঠিত হয়।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু এসবের তোয়াক্কা না করে বাঙালীর স্বাধীন, সার্বভৌম ও সাংস্কৃতিক চিন্তা অর্থাৎ জাতীয় চার নীতি, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণ করেছিলেন। যা তাদের চিন্তা, চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত পরিপন্থী ছিল। অন্যদিকে সেই তারাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পর রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে তৎপর হয়ে উঠলেন, সঙ্গে ও পাশে থাকতে উন্মুখ হয়ে হাত বাড়ালেন। কারণ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের হত্যার সঙ্গে জড়িত জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশী প্রভুদের নীতিতে হাঁটতে আরম্ভ করেছিলেন।

বাংলাদেশের সাংবিধানিক চার মূলনীতিকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাকে হত্যাকারীদের মুক্ত করে দিয়েছিলেন। তাদের ভোটাধিকার ও নাগরিকত্ব প্রদান করেছিলেন। শুধু তাই নয় সহজিয়া বাংলার সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন ও রাজনীতি করবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এসবই তিনি করেছেন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে হত্যার রক্তাক্ত হাতকে ধর্মের লেবাসে মুছতে, মানুষকে ধোঁকা দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে। কিন্তু তিনি এটা ভুলে গেছেন যেখানে একজন মানুষকে হত্যা করা সমগ্র মানব জাতিকেই হত্যার সমান সেখানে তিনি হত্যা করেছেন বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পুরো পরিবারকে।

বহিঃশক্তি অর্থাৎ অঙ্কের হিসেবে বামপক্ষ স্বাধীনতার পূর্বে থেকে যা চেয়ে এসেছিল বা চেষ্টা করে আসছিল ডানপক্ষ মানে জিয়াউর রহমান সেটাকেই বাস্তবায়ন করেছেন। অর্থাৎ দুই পক্ষের আকাঙ্ক্ষার সুর-তাল অভিন্ন ছিল। অঙ্কের হিসেবে বামপক্ষ সমান ডানপক্ষ।

তবে এসবের বাইরেও বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটা বাজে পলিটিসাইজ আছে। আর তা হলো এই হত্যাকাণ্ডকে কেউ কেউ শুধুই একটা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মোড়কে বিবেচনা করে মত প্রকাশ করেন। কিন্তু আদতে এটা কখনই শুধু একটা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নয়। কারণ প্রাচ্য থেকে শুরু করে পাশ্চাত্য আমেরিকার আব্রাহাম লিংকন থেকে শুরু করে ভারতের ইন্দিরা গান্ধী সকলেই এককভাবে ক্ষমতা কেন্দ্রিক আচরণে আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু আক্রান্ত হয়েছেন গোটা পরিবারসহ। শিশু পুত্র শেখ রাসেল থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর গর্ভবতী পুত্রবধূ কেউই বাদ যায়নি। অর্থাৎ পিউর জেনোসাইড।

বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবার বাঙালীর জন্য প্রেরণা ও নির্মোহ আবেগ। সেই আবেগকে আদর্শ হিসেবে নিয়ে বাঙালী যে দুর্বার গতিতে অগ্রযাত্রা শুরু করেছিল তা পাকিস্তান ও পাকিস্তান প্রেমী দেশী-বিদেশীদের জন্য ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সবাইকে মুছে ফেলার ছক করা হয় যেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে একজনও ধারণ এবং ধরে এগোতে না পারে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সকলকে হত্যা শুধুই পলিটিক্যাল মার্ডার নয়, এর উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর ফিলোসোপিটাকেই শেষ করে দেয়া।

সেই ধারাবাহিকতার প্রমাণ মেলে প্রকৃতির আশীর্বাদ বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার জীবনেও। তাঁর জীবন শুধুই সংগ্রামের। এক বাক্যে বললে ঝড়-ঝঞ্ঝা, সংযম ও প্রজ্ঞার পথ পাড়ি দিয়ে নির্মোহভাবে পিতার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে ছুটলেও এ পর্যন্ত প্রায় ২১ বার তাঁকে হত্যা চেষ্টা করা হয়েছে। প্রাসঙ্গিক উদাহরণ- চট্টগ্রামের লালদীঘিতে সরাসরি গুলি, গোপালগঞ্জের হেলিপ্যাডের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা এবং ২১ আগস্ট সরাসরি গ্রেনেড হামলা।

তবে এরপরও শেখ হাসিনার জয়রথ চলছে এবং সেটা পাকিস্তানী মৌলবাদ কিংবা ভিনদেশি চক্রান্তকে উপেক্ষা করেই। আর এই পথ চলায় তাঁর পাথেয় একক বঙ্গবন্ধুর দর্শন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা।

লেখক: ছাত্রনেতা

সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত