5577
Published on নভেম্বর 21, 2020জয়দেব নন্দীঃ
'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'র পর আমরা হাতে পেলাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর আরেকটি মহামূল্যবান গ্রন্থ 'কারাগারের রোজনামচা'। কত কণ্টকাকীর্ণ পথ, কত ষড়যন্ত্র, কত বিশ্বাসঘাতকতা, কত ব্যথা, কত বেদনা, কত রক্তক্ষরণ, কত ক্রান্তিকাল পাড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধু একটি দেশ, একটি জাতীয় পতাকা আমাদেরকে দিয়েছেন; তা অনুধাবন করা যায় গ্রন্থটি পাঠ করলে। বাঙালির ভাগ্য উন্নয়নের জন্য তথা স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের জন্য নিজের জীবন-যৌবন উজাড় করে দিয়ে যে মহান অআত্মত্যাগের পরিচয় তিনি দিয়েছেন, তাই এই গ্রন্থের পাতায়-পাতায় পরম মমতায় শব্দে-বাক্যে গ্রথিত আছে।
১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা উত্থাপনের পর ওই বছরের প্রথম তিন মাসে আটবার গ্রেফতার ও জামিন পান বঙ্গবন্ধু। এরপর মে মাসে আবার গ্রেপ্তার হন। ওই সময়ের বন্দিজীবনের দিনলিপি উঠে এসেছে বইটিতে।
কারাগারের রোজনামচা - গ্রন্থটির নামকরণ করেছেন বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দেবার পর বাঙালি জাতির মহানায়ক গ্রেফতার হন। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কারান্তরীণ থাকেন। সেই সময়ে কারাগারে প্রতিদিন তিনি ডায়েরী লেখা শুরু করেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ঘটনাবহুল জেল-জীবনচিত্র এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জেল-জীবন, জেল-যন্ত্রণা, কয়েদীদের অজানা কথা, অপরাধীদের কথা, কেন তারা এই অপরাধ জগতে পা দিয়েছিলো সেসব বিষয় যেমন সন্নিবেশিত হয়েছে; ঠিক তেমনি তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, কারাগারে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের দুঃখ-দুর্দশা, গণমাধ্যমের অবস্থা, শাসক গোষ্ঠীর নির্মম নির্যাতন, ৬ দফার আবেগকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাস ঘাতকতা, প্রকৃতি প্রেম, পিতৃ-মাতৃ ভক্তি, কারাগারে পাগলদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সংবেদনশীলতার সাথে তুলে ধরেছেন। গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করা হয় দু'বার। প্রথমবার ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পরপরই, দ্বিতীয়বার জেনারেল জিয়া যখন ক্ষমতায়। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের লোমহর্ষক ২টি ঘটনা গ্রন্থটির ভূমিকাতে সবিস্তারে তুলে ধরেছেন:
(প্রথমবার)
'২৫ শে মার্চের পর এই প্রথম বাসায় ঢুকতে পারলাম। সমস্ত বাড়িতে লুটপাটের চিহ্ন, সব আলমারি খোলা, জিনিসপত্র ছড়ানো ছিটানো। বাথরুমের বেসিন ভাঙ্গা, কাচের টুকরা ছড়ানো, বীভৎস দৃশ্য!
বইয়ের সেলফে কোন বই নাই। অনেক বই মাটিতে ছড়ানো, সবই ছেঁড়া অথবা লুট হয়েছে। কিছু তো নিতেই হবে। আমরা এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাই, পাকিস্তান মিলিটারি আমাদের সাথে সাথে যায়। ভাইবোনদের বললাম, যা পাও বইপত্র হাতে হাতে নিয়ে নেও।
আমি মায়ের কথামত জায়গায় গেলাম। ড্রেসিং রুমের আলমারির উপর ডান দিকে আব্বার খাতাগুলি রাখা ছিল, খাতা পেলাম কিন্তু সাথে মিলিটারির লোক, কি করি? যদি দেখার নাম করে নিয়ে নেয় সেই ভয় হল। যাহোক অন্য বই খাতা কিছু হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে একখানা গায়ে দেবার কাঁথা পড়ে থাকতে দেখলাম, সেই কাঁথা খানা হাতে নিলাম, তারপর এর ফাঁকে খাতাগুলি ঐ কাঁথায় মুড়িয়ে নিলাম। সাথে দুই একটা বই ম্যাগাজিন পড়েছিল তাও নিলাম।
আমার মায়ের হাতে সাজানো বাড়ির ধ্বংসস্তূপ দেখে বার বার চোখে পানি আসছিল কিন্তু নিজেকে শক্ত করলাম। খাতাগুলি পেয়েছি এইটুকু বড় সান্ত্বনা। অনেক স্মৃতি মনে আসছিল।"
(দ্বিতীয় বার)
"জেনারেল জিয়াউর রহমান তখন ক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। মে মাসের ৩০ তারিখ জিয়ার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর ১২ই জুন বাড়িটা আমার হাতে হস্তান্তর করে। প্রথমে ঢুকতে পা থেমে গিয়েছিল। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।
যখন হুঁশ হয়, আমাকে দিয়ে অনেকগুলি কাগজ সই করায়। কী দিয়েছে জানি না যখন আমার পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে আসে তখন আমার মনে পড়ে আব্বার লেখা খাতার কথা, আমি হেঁটে আব্বার শোবার ঘরে ঢুকি। ড্রেসিং রুমে রাখা আলমারির দক্ষিণ দিকে হাত বাড়াই। ধূলিধূসর বাড়ি। মাকড়সার জালে ভরা তার মাঝেই খুঁজে পাই অনেক আকাঙ্ক্ষিত রুলটানা খাতাগুলি।
আমি শুধু খাতাগুলি হাতে তুলে নিই। আব্বার লেখা ডায়েরি, মায়ের বাজার ও সংসার খরচের হিসাবের খাতা।
আব্বার লেখাগুলি পেয়েছিলাম এটাই আমার সব থেকে বড় পাওয়া, সব হারাবার ব্যথা বুকে নিয়ে এই বাড়িতে একমাত্র পাওয়া ছিল এই খাতাগুলি। খুলনার চাচির বাসায় খাতাগুলি রেখে আসি, চাচির ভাই রবি মামাকে দায়িত্ব দেই, কারণ ঢাকায় আমার কোন থাকার জায়গা ছিল না, কখনো ছোট ফুফুর বাসা, কখনো মেজো ফুফুর বাসায় থাকতাম।"
* দেশ ও জনগণের প্রয়োজনে যে রাজনীতি; সেই রাজনীতিতে দ্বিচারিতা চলেনা, কপটতা চলে না। ব্যক্তি স্বার্থের চেয়েও সেখানে দেশ ও জনগণের স্বার্থই বড়। বঙ্গবন্ধু দেশ ও জনগণের স্বার্থেই রাজনীতি করেছেন।পূর্বজ রাজনীতিবিদদের মধ্যে দু'একজনের দেশ ও জনগণ-বিরোধী মনোভাব তাকে দারুণভাবে আহত করেছে। সে সম্পর্কেও তিনি সেই সত্যটি তুলে ধরতে দ্বিধা করেননি :
"মওলানা সাহেবকে আমি জানি, কারণ তিনিই আমার কাছে অনেকবার অনেক প্রস্তাব করেছেন। এমন কি ন্যাপ দলে যোগদান করেও। সেসব আমি বলতে চাই না। তবে 'সংবাদে'র সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী সাহেব জানেন। এসব কথা বলতে জহুর ভাই তাঁকে নিষেধও করেছিলেন। মওলানা সাহেব পাকিস্তানে যেয়ে এক কথা বলেন, আর পূর্ব বাংলায় এসে অন্য কথা বলেন। যে লোকের যে মতবাদ সেই লোকের কাছে সেই ভাবেই কথা বলেন। আমার চেয়ে কেউ তাঁকে বেশি জানে না। তবে রাজনীতি করতে হলে নীতি থাকতে হয়। সত্য কথা বলার সাহস থাকতে হয়। বুকে আর মুখে আলাদা না হওয়াই উচিত।" (পৃষ্ঠা: ৫৭-৫৮, ২রা জুন ১৯৬৬, বৃহস্পতিবার)
বাঙালি চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে যেমন বীরের জাত বলেছেন, ঠিক তেমনি বাঙালি যে 'পরশ্রীকাতর ' সেটিও বলতে ভুলেননি। বাঙালিরা অন্যের দুঃখে ব্যথিত হয়, আবার এই বাঙালিই যে অন্যের ভালো দেখতে পারে না, সেটিও উল্লেখ করেছেন তাঁর দিনলিপিতে। আবার সবসময়ই কিছু বাঙালি ছিল বিশ্বাসঘাতক। বাংলার স্বাধীন রাজা দাউদ কারানী থেকে সিরাজউদ্দৌলা ; সবসময়ই বাঙালিরা নিজেদের অস্তিত্ব ভুলে নিজেদের ক্ষতি করেছে, ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার নিমিত্তে ভিনদেশীদের সাথে হাত মিলিয়েছিল। সেই সত্যটি বঙ্গবন্ধু লিখেছেন এইভাবে :
"বাংলাদেশ শুধু কিছু বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতকদের জন্যই সারাজীবন দুঃখ ভোগ করলো। আমরা সাধারণত মীর জাফর আলি খাঁর কথাই বলে থাকি। কিন্তু এর পূর্বেও ১৫৭৬ সালে বাংলার স্বাধীন রাজা ছিল দাউদ কারানী। দাউদ কারানীর উজির শ্রীহরি বিক্রম-আদিত্য এবং সেনাপতি কাদলু লোহানী বেঈমানি করে মোগলদের দলে যোগদান করে। রাজমাবাদের যুদ্ধে দাউদ কারানীকে পরাজিত, বন্দি ও হত্যা করে বাংলাদেশ মোগলদের হাতে তুলে দেয়। এরপরেও বহু বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এই বাঙালি জাত। একে অন্যের সাথে গোলমাল করে বিদেশি প্রভুকে ডেকে এনেছে লোভের বশবর্তী হয়ে। মীররজাফর আনল ইংরেজকে, সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করলো বিশ্বাসঘাতকতা করে। ইংরেজের বিরুদ্ধে এই বাঙালিরাই প্রথম জীবন দিয়ে সংগ্রাম শুরু করে; সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয় ব্যারাকপুর থেকে। আবার বাংলাদেশে লোকের অভাব হয় না ইংরেজকে সাহায্য করবার। ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত এই মাটির ছেলেদের ধরিয়ে দিয়ে ফাঁসি দিয়েছে এদেশের লোকেরাই- সামান্য টাকা বা প্রমোশনের জন্য।
পাকিস্তান হওয়ার পরেও দালালি করার লোকের অভাব হল না- যারা সবকিছুই পশ্চিম পাকিস্তানে দিয়ে দিচ্ছে সামান্য লোভে। বাংলার স্বার্থরক্ষার জন্য যারা সংগ্রাম করছে তাদের বুকে গুলি করতে বা কারাগারে বন্দি করতে এই দেশে সেই বিশ্বাসঘাতকদের অভাব হয় নাই।
এই সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ এতো উর্বর; এখানে যেমন সোনার ফসল হয়, আবার পরগাছা আর আগাছাও বেশি জন্মে। জানি না বিশ্বাসঘাতকদের হাত থেকে এই সোনার দেশকে বাঁচানো যাবে কিনা!"
( পৃষ্ঠা: ১১১-১১২, ২০শে জুন ১৯৬৬, সোমবার)
একদিকে ৬৬ সালের ভয়াবহ বন্যা। চাউলের দাম ৪০-৫০ টাকা মণ। জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী। বাংলার জনগণের মনে শান্তি নাই। অন্যদিকে ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে আওয়ামী লীগসহ সারাদেশের মানুষ সোচ্চার, তখন চলছে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নির্মম নির্যাতন। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ কেউই রক্ষা পাচ্ছে না পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর হাত থেকে। ইত্তেফাক প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে। জাতির সেই সংকট কালে কিছু মানুষকে বঙ্গবন্ধু দেখেছেন বাঙালি জাতির সাথে বেঈমানি করতে। যাদেরকে বঙ্গবন্ধু 'আগাছা-পরগাছার' সাথে তুলনা করেছেন। কেননা বাঙালি হয়েও তারা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর তাঁবেদারি করেছে। এজন্যই বঙ্গবন্ধু বলেছেন:
"দুপুরের দিকে সূর্য মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতে শুরু করছে। রৌদ্র একটু উঠবে বলে মনে হয়। বৃষ্টি আর ভাল লাগছে না। একটা উপকার হয়েছে আমার দূর্বার বাগানটার। ছোট মাঠটা সবুজ হয়ে উঠেছে। সবুজ ঘাসগুলি বাতাসের তালে তালে নাচতে থাকে। চমৎকার লাগে, যেই আসে আমার বাগানের দিকে একবার না তাকিয়ে যেতে পারে না।
বাজে গাছগুলো আমি নিজেই তুলে ফেলি। আগাছাগুলিকে আমার বড় ভয়, এগুলি না তুললে আসল গাছগুলি ধ্বংস হয়ে যাবে। যেমন আমাদের দেশের পরগাছা রাজনীতিবিদ- যারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক তাদের ধ্বংস করে, এবং করতে চেষ্টা করে। তাই পরগাছাকে আমার বড় ভয়। আমি লেগেই থাকি। কুলাতে না পারলে আরও কয়েকজনকে ডেকে আনি। আজ বিকেলে অনেকগুলি তুললাম।"
(পৃষ্ঠা: ১১৭, ২৩ জুন ১৯৬৬, বৃহস্পতিবার)
বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব যখন জেলগেটে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে আসতেন, তখন একটু বেশী করে বিভিন্ন পদের খাবার বঙ্গবন্ধুর জন্য নিয়ে আসতেন। বঙ্গবন্ধু সেই খাবার শুধু নিজেই খেতেন না, অন্যান্য কয়েদীদেরকে সেসব খাবার বণ্টন করে দিতেন। তিনি সারা জীবন মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখেছেন। মাঝে মাঝে তিনি নিজে না খেয়েও অন্য কয়েদিদের নিজের খাবার খেতে দিয়েছেন। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর শাসন আমলে ধনী-গরীবের ব্যবধান এত চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল তা বঙ্গবন্ধু তার লেখায় উল্লেখ করেছেন :
"আমি যাহা খাই ওদের না দিয়ে খাই না। আমার বাড়িতেও একই নিয়ম। জেলখানায় আমার জন্য কাজ করবে, আমার জন্য পাক করবে, আমার সাথে এক পাক হবে না!
আজ নতুন নতুন শিল্পপতিদের ও ব্যবসায়ীদের বাড়িতেও দুই পাক হয়। সাহেবদের জন্য আলাদা, চাকরদের জন্য আলাদা। আমাদের দেশে যখন একচেটিয়া সামন্তবাদ ছিল, তখনও জমিদার তালুকদারদের বাড়িতেও এই ব্যবস্থা ছিল না। আজ যখন সামন্ততন্ত্রের কবরের উপর শিল্প ও বাণিজ্য সভ্যতার সৌধ গড়ে উঠতে শুরু করেছে, তখনই এইরকম মানসিক পরিবর্তনও শুরু হয়েছে, সামন্ততন্ত্রের শোষণের চেয়েও এই শোষণ ভয়াবহ।"
(পৃষ্ঠা: ১৮৯, ৪ঠা আগস্ট ১৯৬৬, বৃহস্পতিবার)
জেলখানার একজন সিপাহী বঙ্গবন্ধুর কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, "স্যার আপনাকে নাকি আপনার বাবা ত্যাজ্যপুত্র করে দিয়েছে, রাজনীতি করার জন্য আর বারবার জেল খাটার জন্য?" বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছেন, "এরকম কথা আমি জীবনে অনেক শুনেছি, আমার বাবা আজও আমাকে যে স্নেহ করেন, তা বোধহয় অনেক পুত্রের কপালেই জোটে না জীবনে।" রাজনীতিবিদদের রাজনীতি করতে গিয়ে, দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে কত কথাই না শুনতে হয়। কত নেতিবাচক খেতাবেও ভূষিত হতে হয়। তাইতো বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলেছেন :
"ওরে আমার রাজনীতি, তোমার জন্য জীবনে কত কথাই না আমাকে শুনতে হল। এগার মাস মন্ত্রিত্ব করেছিলাম। 'চোর' বলতে কারও বাঁধল না। আমি নাকি সিনেমা হল করেছিলাম! একজন সিপাহি জিজ্ঞাসা করে বসল, 'আপনার বলাকা সিনেমা হলটা সরকার নিয়ে গিয়াছিল, ফেরত দেয় নাই, না!' হাসতে হাসতে উত্তর দিলাম, 'আমার সিনেমা হল বলাকা, নিশ্চয়ই বলাকা সিনেমার মালিক এ খবর পেলে হার্টফেল করে মারা যাবে। কারণ বেচারা বহু টাকা খরচ করে ইস্টার্ন ফেডারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে হলটা কিনেছে। আমার একআনা শেয়ারও যদি থাকত তবে আর কষ্ট করতে হতো না।' বেচারা অবাক হয়ে চেয়ে রইল আমার দিকে। 'বলেন কি স্যার, আজও তো অনেকে বলে।' বললাম, 'বলতে দিন, ওটা তো আমাদের কিসমত-যাদের জন্য আমি রাজনীতি করি তাদের কেউ কেউ আমাদের বিশ্বাস করে না।' অনেকক্ষণ ভাবলাম, এই তো দুনিয়া! জনাব সোহরাওয়ার্দীকে 'চোর' বলেছে, হক সাহেবকে 'চোর' বলেছে, নেতাজি সুভাষ বসুকে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে এই বাঙালিরাই 'চোর' বলেছে, দুঃখ করার কি আছে!"
(পৃষ্ঠা: ১৮৮-১৮৯)
ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন। আওয়ামী লীগের জন্মেরও এক বছর আগে বঙ্গবন্ধু এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। জন্মলগ্ন থেকেই এই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এই মাটির জন্য, এই দেশের জন্য যত ত্যাগ স্বীকার করেছে; তা আর অন্য কোন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এতটা করেনি। তাই এই সংগঠনের প্রতি বঙ্গবন্ধুর দরদ, আবেগ, ভালবাসা ছিল অকৃত্রিম। ১৯৬৭ সালের ১৮ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ২য় মামলার সওয়াল-জবাব অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর আত্নীয়-স্বজন ছাড়া সেখানে ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা 'রেজা'ও উপস্থিত হন। এর আগে বঙ্গবন্ধু শুনেছেন ছাত্রলীগের নির্বাচন নিয়ে নিজেদের মধ্যে গোলমাল চলছে। বঙ্গবন্ধু বলেছেন :
"তোমরা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করিও। ছাত্রলীগকে ভেঙে ফেলে দিও না। সকলকে আমার সালাম দিও। ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র প্রতিষ্ঠান আমি গড়েছিলাম কয়েকজন নিঃস্বার্থ ছাত্রকর্মী নিয়ে। প্রত্যেকটি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন, রাজবন্দীদের মুক্তি আন্দোলন, ব্যক্তি স্বাধীনতার আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ও ছাত্রদের দাবী দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে বহু জেল-জুলুম সহ্য করেছে এই কর্মীরা। পূর্ব বাংলার ছয় দফার আন্দোলন ও আওয়ামী লীগের পুরাভাগে থেকে আন্দোলন চালিয়েছে ছাত্রলীগ। এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গোলমাল হলে আমার বুকে খুব আঘাত লাগে।" (পৃষ্ঠা: ২১১, ১৮ মার্চ ১৯৬৭, শনিবার)
দু'বছরের শিশু সন্তান রাসেল পিতৃ স্নেহ থেকে বঞ্চিত। সারাদিন শুধু 'আব্বা' 'আব্বা' বলে ডাকে। কালে ভদ্রে যদি দু'একদিন জেলগেটে আব্বার দেখাও পায়, কিছুক্ষণ পরেই রাসেল তার আব্বাকে হারিয়ে ফেলে। রাসেল তার আম্মাকেই 'আব্বা' ডাকা শুরু করলো। নিজের সন্তান, নিজের স্ত্রী, পরিবার-পরিজন, বাবা-মা সবকিছু ফেলে দেশের জন্য, দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য যিনি কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠকে বেছে নিতে পারেন, তিনিই তো নেতা, তিনিই তো জাতির পিতা। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ রেখে একজন বন্দি পিতার আকুতি আমরা শুনতে পাই :
"৮ ফেব্রুয়ারি ২ বৎসরের ছেলেটা এসে বলে, "আব্বা বালি চলো"। কি উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম, ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দী। ওকে বললাম,"তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।" ও কি বুঝতে চায়!...
দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।"...
"জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে একটু আশ্চর্যই হলাম। আমি যখন রুমের ভেতর যেয়ে ওকে কোলে করলাম আমার গলা ধরে 'আব্বা' 'আব্বা' করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে 'অআব্বা' ' আব্বা' করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে 'আব্বা' বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, 'ব্যাপার কি?' ওর মা বলল, " বাড়িতে 'আব্বা' ' আব্বা' করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে 'আব্বা' বলে ডাকতে।" রাসেল ' আব্বা আব্বা' বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, 'তুমি আমার আব্বা।' আমার উপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।"
( পৃষ্ঠা: ২২১; ১৪ই এপ্রিল- ১৫ই এপ্রিল, ১৯৬৭)
জনগণের নেতাকে জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে অন্ধকার কারাগারে। একদিকে উঁচু প্রাচীর। পাশের সেলে সত্তর জন পাগল। একদিকে শাসক গোষ্ঠীর মানসিক নির্যাতন, অন্যদিকে পরিবার পরিজন ছাড়া একাকী জীবন। সেই দুঃসহ জীবনে তার সঙ্গী হয়েছিল 'প্রকৃতি' আর 'বই'। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন :
"সিভিল ওয়ার্ডের সামনে ছোট একটা মাঠ আছে। সেখানে কয়েকটা আম গাছ আছে। ফুলের বাগান করেছি। জায়গাটা ছাড়তে ইচ্ছে হয় না। আবার কোথায় দিবে কি? রাতে যখন ঘুমাতে পারি না তখন মনে হয় আর এখানে থাকবো না। সকাল বেলা যখন ফুলের বাগানে বেড়াতে শুরু করি তখন রাতের কষ্ট ভুলে যাই। গাছতলায় চেয়ার পেতে বসে কাগজ অথবা বই পড়ি। ভোরের বাতাস আমার মন থেকে সকল দুঃখ মুছে নিয়ে যায়। আমার ঘরটার কাছের আম গাছটিতে রোজ ১০টা- ১১টার সময় দুইটা হলদে পাখি আসে। ওদের খেলা আমি দেখি। ওদের আমি ভালবেসে ফেলেছি বলে মনে হয়। ১৯৫৮ সালে দুইটা হলদে পাখি আসত। তাদের চেহারা আজও আমার মনে আছে। সেই দুইটা পাখির পরিবর্তে আর দুইটা পাখি আসে। পূর্বের দুইটার চেয়ে একটু ছোট মনে হয়।" ( পৃষ্ঠা: ২১৮, ১১ই এপ্রিল-১৩ই এপ্রিল ১৯৬৭)
ভাগ্য বিড়ম্বিত বাঙালি অনাহারে থাকে, বাংলার মানুষের মুখে হাসি নাই, পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নির্মম নির্যাতন; সেই ক্রান্তিকালকে মোকাবেলা করে বাঙালির মুখে হাসি ফোটানোই ছিল তার একমাত্র ব্রত। তাইতো তিনি নিজের জন্মদিনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে বলেছেন :
"আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস!"
(পৃষ্ঠা: ২০৯ ; ১৭ই মার্চ ১৯৬৭, শুক্রবার)
একদিকে দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য ৬ দফা আন্দোলনকে তরান্বিত করা, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নিদারুণ জেল-জীবন, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শাসন ও শোষণ; অন্যদিকে নিজের স্ত্রী, পরিবার, সন্তান-সন্ততি আর অসুস্থ বাবা-মা। নিজের পরিবারের অর্থকষ্ট ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়। মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের আত্নত্যাগের কথা বলতেও বঙ্গবন্ধু ভুলেন নি :
"সংসারের কথা, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, আব্বা আম্মা'র শরীরের অবস্থা আলোচনা করতে করতে চলে যায়। কোম্পানি আজও আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দেয় নাই, তাই একটু অসুবিধা হতে চলেছে বলে রেণু বলল। ডিসেম্বর মাসে আমি চাকরী ছেড়ে দিয়েছি- চারমাস হয়ে গেল আজও টাকা দিল না! আমি বললাম, ' জেল থেকে টেলিগ্রাম করব। প্রথম যদি না দেয় তবে অন্য পন্থা অবলম্বন করব। আমার টাকা তাদের দিতেই হবে। কোনোমতে চালাইয়া নিয়ে যাও। বাড়ির থেকে চাউল আসবে, নিজের বাড়ি, ব্যাঙ্কেও কিছু টাকা আছে, বছর খানেক ভালভাবেই চলবে, তারপর দেখা যাবে। আমার যথেষ্ট বন্ধু আছে যারা কিছু টাকা ধার দিতে কৃপণতা করবে না' ' যদি বেশী অসুবিধা হয় নিজের বাড়ি ভাড়া দিয়ে ছোট বাড়ি একটা ভাড়া করে নিব', রেণু বলল। সরকার যদি ব্যবসা করতে না দেয় তবে বাড়িতে যে সম্পত্তি আমি পেয়েছি আব্বার, মায়ের ও রেণুর তাতে আমার সংসার ভালভাবে চলে যাবে। রেণু বলল, ' চিন্তা তোমার করতে হবে না।' সত্যই আমি কোনোদিন চিন্তা বাইরেও করতাম না, সংসারের ধার আমি খুব কমই ধারি'।"
( পৃষ্ঠা: ২২২ ; ১৪ই এপ্রিল - ১৫ই এপ্রিল, ১৯৬৭)
কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থটি ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সালের দিনলিপি হলেও ; তিনি কখনো ফিরে গেছেন ভাষা আন্দোলনের প্রারম্ভিক পর্যায়ে, কখনোবা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গড়ে ওঠা সেই মহৎ সংগ্রামে।বর্ণনা করেছেন সেই সময়কার সংগ্রামে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের বীরত্বব্যঞ্জক ভূমিকার কথা। ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭, দিনলিপিতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন :-
"ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের দান সবচেয়ে বেশি। ...আওয়ামী লীগ যখন ১৯৫৬ সালে ক্ষমতায় বসল তখন ২১শে ফেব্রুয়ারিকে 'শহীদ দিবস' ও সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করল।"
(পৃষ্ঠা: ২০৬-২০৭)
সমাজের শ্রেনীবৈষম্য, উঁচু তলার মানুষের নিচতলার মানুষদেরকে শোষণ করার মানসিকতা কিভাবে একজন সাধারণ মানুষকে মস্ত বড় চোরে পরিণত করে, বঙ্গবন্ধু তা 'লুদু চোরে'র জীবনের বাস্তবমুখী ঘটনা তুলে ধরে একজন মানুষের 'চোর' হয়ে ওঠার নিগূঢ় সত্যকে উঠিয়ে এনেছেন। একজন মহান, মানবিক নেতার সংস্পর্শে এসে একজন কুখ্যাত 'লুদু চোর' কিভাবে জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তন এনে আলোর পথে যাত্রা শুরু করে, সে সত্যটিও গ্রন্থটিতে সন্নিবেশিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে না আসলে লুদু চোর চোরই থেকে যেত। সারাজীবনটি হয়তো কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে থাকা লাগতো। লুদু চোরকেই বলতে শুনেছি, " আর পকেট মারবো না, ভালোভাবে থাকবো।"
গ্রন্থটি পাঠ করতে গিয়ে পাঠক যেন কোনরকম শব্দ- বিভ্রান্তিতে না পড়েন তার জন্য তিনি দিনলিপি লেখার পূর্বেই কারাগারের প্রচলিত শব্দগুলোর ( যে শব্দগুলো আমরা কখনো শুনি নাই ) অর্থ ঘটনার বিবরণীর মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন। যেমন- আইনদফা, ডালচাকিদফা, হাজতিদফা, ছোকরাদফা, রাইটারদফা, চৌকিদফা ইত্যাদি।
" যেইনা মাথার চুল তার আবার লাল ফিতা "
( পৃষ্ঠা: ৭৬)
" পড়েছি পাঠানের হাতে খানা খেতে হবে সাথে "
( পৃষ্ঠা - ২৫৮)
- জেলখানার নির্মম বাস্তবতা, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বিমাতা সুলভ আচরণ, অধিকার সচেতনতা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তিনি এধরণের প্রবাদ-প্রবচনেরও ব্যবহার করেছেন সেই সংকট কালের দিনলিপিতে।
গ্রন্থটির প্রত্যেকটি দিনলিপিতে বাংলা বা বাঙালিত্বের প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে ভালবাসা, তা ফুটে উঠেছে চমৎকারভাবে। ব্যক্তিকে ছাপিয়ে সমষ্টির জন্য তাঁর যে ক্রন্দন- তাও ফুটে উঠেছে প্রত্যেকটি লাইনে। "সত্য" কঠিন জেনেও সেই কঠিনকে ভালবেসে 'সত্য'কে নির্মোহ ভাবেই তুলে ধরেছেন তিনি। গ্রন্থটির প্রতিটি দিনলিপির শেষে লেখকের একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতার নিদারুণ কষ্ট প্রকাশ পেয়েছে; কেননা, দিন শেষে সন্ধ্যা নামলেই তাঁর কক্ষে তালা লেগে যেত! সহৃদয় পাঠকও যেন তার জীবনের এই অংশ এসে অশ্রুসজল হয়ে পড়ে।